ভাষা আন্দোলন

শহীদ সালামের রক্তমাখা জামা দেখে বিক্ষোভে উত্তাল পটুয়াখালী

শহীদ সালামের রক্তমাখা শার্ট দেখে বিক্ষোভে উত্তাল পটুয়াখালী
পটুয়াখালী শহীদ স্মৃতি পাঠাগার। ছবি: স্টার

১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল পটুয়াখালীর। ঢাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত শহীদ সালামের রক্তমাখা জামা পটুয়াখালীতে ভাষা আন্দোলনের জনসভায় প্রদর্শন করা হলে জনতা আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠে। বিক্ষোভে ফেটে পড়েন তারা। এতে ঢাকার ভাষা আন্দোলনের ঢেউ বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী পটুয়াখালীতেও আছড়ে পড়ে।
 
ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে পটুয়াখালীতে স্থাপিত 'শহীদ স্মৃতি পাঠাগার' আজও স্বমহিমায় উদ্ভাসিত।

ভাষা আন্দোলনে সে সময় সক্রিয় ভূমিকা পালনকারীদের অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই। জীবিতদের মধ্যে পটুয়াখালীর বাসিন্দা আবুল হোসেন আবু মিয়া ও দলিল উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে সে সময়ের অনেক কথা।

পটুয়াখালীতে স্থাপিত প্রথম শহীদ মিনার। ছবি: স্টার

তারা জানান, তখন পটুয়াখালী ছিল বরিশাল জেলার একটি মহকুমা। ঢাকায় যখন ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে নানা কর্মসূচি পালন করা হচ্ছিল, ঠিক সেসময় কবি খন্দকার খালেককে আহ্বায়ক ও জালাল উদ্দিন আহমেদকে যুগ্ম-আহ্বায়ক করে গঠন করা হয় 'পটুয়াখালী রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ'। পরে এ কমিটির নামকরণ করা হয় 'রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ'। 

ওই কমিটির সদস্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আজহারউদ্দিন, আবুল হোসেন আবু মিয়া, অ্যাডভোকেট এমদাদ আলী, বীরেশ্বর বসু, অতুল চন্দ্র দাস, ধ্রুবজ্যোতি দত্ত, অ্যাডভোকেট গোলাম আহাদ চৌধুরী, এ টি এম ওবায়দুল্লাহসহ অনেকে। তবে কমিটিতে না থাকলেও পটুয়াখালীতে ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বাউফলের কৃতি সন্তান সৈয়দ আশরাফ হোসেন।

কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ কমিটির উদ্যোগে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি পটুয়াখালীর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও পটুয়াখালী শহরে হরতাল পালন করা হয়। ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের মিছিলে গুলিবর্ষণ ও শহীদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হওয়ার খবর পৌঁছে যায় পটুয়াখালীতে।

ভাষা সৈনিক এস এম আবুল হোসেন। ছবি: স্টার

সেদিন ঢাকায় অন্যান্যদের সঙ্গে শহীদ হন সালাম। তার মরদেহ নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ময়না তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন সৈয়দ আশরাফের বড় ভাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক সৈয়দ ফজলুল হক। তার কাছ থেকে শহীদ সালামের রক্তমাখা জামা নিয়ে সৈয়দ আশরাফ হোসেন পটুয়াখালীতে আসেন। 

ফেব্রুয়ারির ২৩ তারিখ পটুয়াখালী শহরের বড় মসজিদ সংলগ্ন মাঠে বর্তমানে শহীদ আলাউদ্দিন শিশুপার্কে আয়োজন করা হয় ভাষা আন্দোলন কমিটির প্রথম প্রকাশ্য জনসভা। এমদাদ আলী মোক্তারের সভাপতিতে ওই সভায় বিডি হাবিবুল্লাহ, এ বি এম আব্দুল লতিফ, আব্দুল করিম মিয়া, সৈয়দ আশরাফসহ ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীরা বক্তব্য রাখেন।

ভাষা সৈনিক দলিল উদ্দিন আহমেদ। ছবি: স্টার

দলিল উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'ওই সভায় ঢাকা থেকে নিয়ে আসা শহীদ সালামের রক্তমাখা জামা জনতাকে প্রদর্শন করেন সৈয়দ আশরাফ হোসেন। ওই জামা দেখে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে উপস্থিত জনতা। জনসভার ঘোষণা অনুযায়ী ৩ মার্চ পটুয়াখালী শহরে পালন করা হয় সর্বাত্মক হরতাল, বিক্ষোভ মিছিল ও সরকারি জুবিলী স্কুল মাঠে গণজমায়েত।'

তিনি জানান, প্রশাসন জুবিলী স্কুল মাঠের গণজমায়েত পণ্ড করতে নানা কূটকৌশল চালায়। ভাষা সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করা হয়।

এদিকে জনসভায় বিতরণের জন্য আন্দোলনকারীদের অন্যতম কবি খন্দকার খালেক রচিত 'রক্ত শপথ' লিফলেট আর্টপ্রেস নামের ছাপাখানায় ছাপিয়ে জনসাধারণের মধ্যে বিতরণ করা হয়।

শহরে মোতায়েন ছিল দাঙ্গা পুলিশ। কিন্তু তবুও বাধ মানেনি ছাত্র-জনতার ঢল। পটুয়াখালী শহরের জুবিলী স্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত স্মরণকালের বৃহৎ জনসভা। অ্যাডভোকেট এমদাদ আলী সভায় সভাপতিত্ব করেন। জনস্রোত দেখে দাঙ্গা পুলিশসহ প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হয়।

'রক্ত শপথ' লিফলেট ছাপানোর অভিযোগে তৎকালীন প্রশাসন সরকারি কাজের ক্ষেত্রে আর্টপ্রেসের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে, যা পরবর্তী ৫ বছর কার্যকর ছিল।

আবুল হোসেন আবু মিয়া বলেন, 'পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে পটুয়াখালীতে একটি পাঠাগার স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯৫৪ সালের ১৭ এপ্রিল পটুয়াখালীর পুরান বাজার স্টিমার ঘাটের একটি বাড়ির দোতলায় প্রথমে প্রতিষ্ঠা করা হয় শহীদ স্মৃতি পাঠাগার এবং প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন যুক্তফ্রন্টের এমপি আব্দুল করিম মিয়া ও সম্পাদক হন জালাল উদ্দিন আহমেদ।'

পরে কয়েকবার স্থানান্তরের পর শহরের এসডিও অফিসের পুকুরের পশ্চিম-উত্তর কোণে নিজস্ব ভবনে নির্মিত হয় পটুয়াখালী শহীদ স্মৃতি পাঠাগার, যার কার্যক্রম এখনো চলমান। পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন ২৫ জন। বর্তমানে ৩৬ জন আজীবন সদস্যসহ ১০০ জন সদস্য আছেন পাঠাগারটিতে।

এ পাঠাগারের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, বাংলা বর্ষবরণ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, প্রখ্যাত কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীদের জন্ম-মৃত্যু বার্ষিকীসহ নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নাটক আয়োজনের জন্য খ্যাতি অর্জন করে এ অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিদিন এখানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার শতাধিক মানুষ পত্রিকা, ম্যাগাজিন এবং বিভিন্ন লেখক কবিদের বই অধ্যয়ন করেন।

অন্যদিকে ভাষা শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে পটুয়াখালী সরকারি কলেজ চত্বরে ১৯৬৩-৬৪ অর্থবছরে স্থাপিত হয় শহীদ মিনার। পটুয়াখালী জেলার প্রথম শহীদ মিনার হিসেবে মাথা উঁচু করে আজও দাঁড়িয়ে আছে শহীদ মিনারটি। প্রতিবছর সেখানে প্রভাতফেরি করে শহীদ দিবস তথা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়।

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

7h ago