একুশের একাত্তর

প্রথম শহীদ মিনার গড়া হয়েছিল রাজশাহীতে

রাজশাহীতে নির্মিত দেশের প্রথম শহীদ মিনার। ছবি: সংগৃহীত

(ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পূর্ণ হচ্ছে চলতি বছর। ভাষা আন্দোলনের একাত্তরতম বছরে দ্য ডেইলি স্টারের ধারাবাহিক বিশেষ আয়োজন 'একুশের একাত্তর'। ধারাবাহিক এই আয়োজনে  ২১ দিনে ডেইলি স্টার প্রকাশ করবে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ২১টি জনপদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। আজকের প্রথম পর্বে রইল রাজশাহীর ভাষা আন্দোলনের চিত্র।) 

'উদয়ের পথে শুনি কার বাণী,

ভয় নাই ওরে ভয় নাই।

নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান,

ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।'

সদ্য নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভের দেয়ালে সাঁটানো ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'সুপ্রভাত' কবিতার অমর ২টি চরণ। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজশাহী কলেজের নিউ হোস্টেলের সামনে ছাত্রদের হাতে ইট-কাদামাটি দিয়ে নির্মিত সেই স্মৃতিস্তম্ভটিই ছিল ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ মিনার।

ঢাকার পরে রাজশাহীতেই সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিল ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উত্থাপিত পরিষদের ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি নাকচ হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় রাজশাহীতে প্রতিবাদ সংঘটিত করে ছাত্রসমাজ। 

সে বছরের ১১ মার্চ পালিত হয় হরতাল। ভুবনমোহন পার্কে আয়োজিত হয় প্রতিবাদ সভা। আন্দোলনের স্লোগান ছিল, 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।' এদিন রাজশাহী কলেজ থেকে আন্দোলনকারী ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বরেন্দ্র জাদুঘরের সামনে পৌঁছালে পুলিশ গুলি চালায়। ভাষা আন্দোলনে এই ঘটনাতেই প্রথম রক্ত ঝরেছিল। তৎকালীন সময়ে রাজশাহী কলেজ ও নগরীর ভুবনমোহন পার্ক ছিল সকল আন্দোলন সংগ্রামের সূতিকাগার।

আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলনে রাজশাহীতে আন্দোলনের নেতৃত্বে দিয়েছিলেন মোহাম্মদ সুলতান, একরামুল হক, গোলাম রহমান। স্থানীয় ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন তসিকুল ইসলাম, আবুল কাশেম চৌধুরী, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান প্রমুখ।

রাজশাহীর ভাষা আন্দোলনে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন রাজশাহী কলেজের অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুল হাই, ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, ড. গোলাম মকসুদ হিলালী প্রমুখ।

১৯৫০-৫১ সালের শেষ নাগাদ রাজশাহীতে ছাত্রনেতৃত্বে নতুন মুখ আসে। সে তালিকায় ছিলেন এস বারী এ টি, গোলাম আরিফ টিপু, মহসিন প্রামাণিক, আনসার আলী, আবুল কালাম চৌধুরী, এস এম এ গাফফার প্রমুখ। 

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে রাজশাহী নগরীতে ছাত্রদের মিছিল। ছবি: সংগৃহীত

১৯৫২ সালের শুরু থেকেই রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। প্রায় প্রতিদিনই ছিল মিছিল-মিটিং।

রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনে ছাত্রদের সার্বক্ষণিক কর্মী নিয়োজিত করা হয়েছিলো। স্টেশনে নিয়োজিত ছাত্ররা ঢাকায় আন্দোলনের সর্বশেষ খবর পাওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকতেন। ঢাকা থেকে কেউ  ট্রেনে করে এসে স্টেশনে নামলেই ছাত্ররা প্রথমেই ঢাকার আন্দোলনের সর্বশেষ খবরাখবর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন।

৪ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে পতাকা দিবস পালিত হয়। এদিন রাজশাহীর শিক্ষায়তনগুলোতে ধর্মঘট পালিত হয়। ছাত্রদের মিছিল রাজশাহী শহর প্রদক্ষিণ শেষে ভুবনমোহন পার্কে এসে জমায়েত হয়। সেখানে বক্তব্য দেন আনোয়ারুল আজিম, মোহসেনা বেগম, মমতাজউদ্দিন আহমদ, মেডিকেল ছাত্র মেসবাহুল হক, ইয়াসিন আলী প্রমুখ। এর মধ্যে গঠিত সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির সভাপতি এবং সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন এস এম এ গাফফার এবং গোলাম আরিফ টিপু। উপদেষ্টা ছিলেন অ্যাডভোকেট মাদার বক্স। 

২১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীর ছাত্ররা আগেই আশংকা করেছিলেন যে ঢাকায় ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাঙতে পারে। আর ১৪৪ ধারা ভাঙলে পুলিশ গুলি চালাবেই। এদিন বিকেলের দিকে রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনে খবর আসে ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়েছে। বহু ছাত্র শহীদ হয়েছেন।

২১ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে রাজশাহীতে ছিল দিনব্যাপী হরতাল। ভুবনমোহন পার্কে অনুষ্ঠিত হয়েছিল জনসভা। সেখানে সভাপতিত্ব করেছিলেন রাজশাহী কলেজের ছাত্র হাবিবুর রহমান। জনসভা চলার সময়েই ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গুলিতে অনেকের শহীদ হওয়ার খবর পৌঁছে যায়।

খবরটি ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছাত্রনেতা আবদুস সাত্তার স্লোগান দেন। সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র এবং উপস্থিত জনতা ফেটে পড়ে বিক্ষোভে। সবাই সমস্বরে মিছিলে স্লোগান তোলেন, 'শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দিবোনা। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।' এই জনসভা থেকেই ছাত্রদের রাজশাহী কলেজ নিউ হোস্টেলের মাঠে উপস্থিত থাকার জন্য বলা হয়।

এরপর রাজশাহী নগরীর সব মেস, বাড়িঘর থেকে ছাত্ররা বেরিয়ে আসেন। কয়েক শ ছাত্র জমা হন রাজশাহী কলেজের নিউ হোস্টেলের সামনের মাঠে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ছাত্র এস এম গাফফারের সভাপতিত্বে সভা শুরু হলো।  সবার কণ্ঠেই তখন এক ধ্বনি, 'ছাত্র হত্যার বিচার চাই, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।'  এই সভায়  ২টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো।  ১. ভাষা আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হবে, ২. শহীদ ছাত্রদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হবে। 

ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি করা হলো মেডিকেল কলেজের ছাত্র এস এম গাফফারকে। যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয় রাজশাহী কলেজের ছাত্র গোলাম আরিফ টিপু ও হাবিবুর রহমানকে।

যেভাবে তৈরি হলো প্রথম শহীদ মিনার

২১ ফেব্রুয়ারি রাতে লন্ঠন, মশাল আর হারিকেন জ্বালিয়ে রাজশাহী কলেজের ছাত্ররা সারারাত জেগে রাজশাহী কলেজ হোস্টেলের মাঠে ইট ও কাদা দিয়ে বানিয়েছিলেন স্মৃতিস্তম্ভ। নির্মাণ শেষে শহীদ মিনারের নামকরণ করা হয়েছিল 'শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ'। শহীদ মিনারের গায়ে সেঁটে দেয়া হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের 'সুপ্রভাত' কবিতার অমর ২ চরণ। জোগাড় করা হয়েছিল একটি ক্যামেরাও। সেই ক্যামেরায় তোলা হয়েছিল ছবি।

২২ ফেব্রুয়ারি ছিল ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে হরতাল। এদিন রাজশাহী শহরের ভুবনমোহন পার্কে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রতিবাদ সভা ছিল। কিন্তু পুলিশ পার্ক দখল করায় সভা হলো রাজশাহী কলেজের লন টেনিস কোর্টে। হরতালে সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দেয়। যোগ দেয় ছাত্রদের মিছিলে। পুরো শহর পোস্টারিং করা হয়েছিল। ছাত্ররা পিকেটিংয়ের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই মুসলিম লীগের কর্মী এবং পুলিশ গুঁড়িয়ে দেয় এই অস্থায়ী শহীদ মিনার।

রাজশাহীতে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন ভাষা সংগ্রামী মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জি। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'রাজশাহীতে আমাদের নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভটিই ছিল দেশের প্রথম শহীদ মিনার। এটি নির্মিত হলো ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে আর ঢাকায় ২৩ ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনার গড়ল ছাত্ররা। দেশের প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের স্বীকৃতিটা রাজশাহীর প্রাপ্য।'

রাজশাহীতে শহীদ মিনার নির্মাণের ২ দিন পর ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকায় ছাত্ররা যে শহীদ মিনারটি নির্মাণ করেছিলেন তার নকশা করেছিলেন সাঈদ হায়দার।

তথ্যসূত্র:

১. রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলন/ সম্পাদক ড. তসিকুল ইসলাম

২. ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া/ আহমদ রফিক।

Comments

The Daily Star  | English
july charter draft by national consensus commission

July Charter runs into a snag

Jamaat, NCP and IAB have voiced reservations about the draft while BNP has expressed partial agreement with the proposed reforms

10h ago