তাবলিগ জামাত ও বিশ্ব ইজতেমার শুরু যেভাবে

তাবলিগ জামাত
মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভী। ছবি: সংগৃহীত

ভারতের হরিয়ানা ও রাজস্থানের উত্তরে জনবিরল এক অঞ্চলের নাম মেওয়াত। সালটা ছিল ১৯১০। উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুর জেলার মাজাহির উলুম মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভী কয়েকজন মুসলমানের ওপর এক নিরীক্ষা চালান।

ইসলামি জ্ঞান 'শূন্য' কয়েকজনকে পুরোপুরি ইসলামি শিক্ষায় দীক্ষিত করতে তিনি মেওয়াতে ইসলামি শিক্ষার পরীক্ষণ চালান। পরে ১০ বছরে ওই এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় এই ধারা। যদিও তা মৌখিক আকারেই বিদ্যমান ছিল।

১৯২০ সালে দক্ষিণ দিল্লির পশ্চিম নিজামুদ্দিন এলাকার এক মসজিদে তাবলিগের মূল কার্যক্রম গড়ে তোলেন ইলিয়াস কান্ধলভী। এটি এখন নিজামুদ্দিন মারকাজ নামে পরিচিত।

১৯২৪ সালে দ্বিতীয়বারের মতো হজে যান মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভী। মক্কায় তিনি তাবগিগের নতুন কর্মপদ্ধতির বিষয়ে পরিকল্পনা করেন।

হজ শেষে দেশে ফিরে তিনি প্রথমে মেওয়াতে যান। গিয়ে দেখেন আগের কোনো প্রভাব নেই সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে। সে সময় মেওয়াতের মক্তবগুলোয় সবার পক্ষে ইসলামি শিক্ষা নেওয়া সম্ভব ছিল না। তখন ধর্মপ্রচারের কাজে নিজেকে পুরোপুরি নিয়োগ করতে শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে দেন ইলিয়াস কান্ধলভী।

সে সময় তার ধারণা ছিল সমাজের একটি অংশের মানুষের মধ্যে বাস্তবে ইসলামি অনুশীলন পরিচালিত না হলে পুরোপুরি ইসলামি পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। তাই তিনি নতুন কর্মপদ্ধতি চালু করেন। এর মধ্যে আছে—ছোট ছোট দলে মসজিদের ধর্মীয় পরিবেশে অল্প সময়ের জন্য ইসলামি শিক্ষা নেওয়া। এর মধ্যে আছে 'গাশত', যা দলবদ্ধভাবে ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোর প্রতি আহ্বানকে বোঝায়।

অন্যটি ছিল— একটি দল ঘর ছেড়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বের হয়ে ইসলামের প্রতি মানুষকে আহ্বান করবে।

এভাবেই পরবর্তীতে গড়ে উঠে তাবলিগ জামাতের রূপরেখা।

তাবলিগ জামাত
মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভী। ছবি: সংগৃহীত

তাবলিগের কার্যক্রম পুরোপুরি পরিচালিত করতে শায়খুল হাদিস জাকারিয়া কান্ধলভীর 'ফাজায়েলে আমল' (কর্মের পুণ্যের ফলাফল) ও 'ফাজায়েলে সাদাকাত' (ধার্মিকতার গুণাবলী) বইকে তাবলিগের পাঠ্যক্রম হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। প্রতিদিন যেকোনো ওয়াক্তে নামাজের পর এই ২ বই পড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়।

দিল্লিসহ ভারতের বেশ কয়েকটি এলাকায় তবলিগের কার্যক্রম দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৪ সালে মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভী মৃত্যুবরণ করেন। তখন তার ছেলে প্রখ্যাত হাদিসবিশারদ মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভীকে তাবলিগের আমির করা হয়।

সেসময় প্রথমবারের মতো পাকিস্তানে তাবলিগের আমির নির্বাচিত হন হাজী শফি কুরাইশি। ১৯৪৬ সালে দিল্লি থেকে সৌদি আরবে ও ব্রিটেনে প্রচারণার জন্য কয়েকজন তাবলিগ অনুসারীকে সেখানে পাঠানো হয়।

১৯৪৮ সালে মাওলানা আবদুল আজিজের প্রচেষ্টায় ঢাকায় তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর তা দ্রুত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। মাওলানা আবদুল আজিজ ছিলেন বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের প্রথম আমির।

১৯৬৫ সালে মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভীর মৃত্যুর পর দিল্লিতে মাওলানা এনামুল হাসানকে তাবলিগের আমির করা হয়। সেসময় মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভীর বই 'হায়াতুস সাহাবা' ও 'মুন্তাখাবে হাদিস' তাবলিগের পাঠ্যক্রমে সংযুক্ত করা হয়।

অবিভক্ত ভারতে তাবলিগ জামাতের জন্ম ও ক্রমবিকাশ শুরু হয়। এটি পরবর্তীতে দ্রুত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টারের মতে, বর্তমানে ১৫০টির বেশি দেশে তাবলিগ জামাতের প্রায় ৮ কোটি অনুসারী আছে।

ইজতেমা ও বিশ্ব ইজতেমার শুরু

১৯৪১ সালে দিল্লির নিজামুদ্দিনে এক বার্ষিক আলোচনা সভায় প্রায় ২৫ হাজার তাবলিগ অনুসারী যোগ দেন। এটিকেই বর্তমানের ইজতেমার প্রভাবক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

১৯৪৬ সালে মাওলানা আবদুল আজিজের প্রচেষ্টায় ঢাকার কাকরাইল মসজিদে প্রথমবারের মতো বার্ষিক ইজতেমা আয়োজিত হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন তাবলিগের বিশ্ব আমির মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভীও।

১৯৫৪ সালে ঢাকায় লালবাগ শাহী মসজিদ ও এর আশপাশের এলাকায় অনুষ্ঠেয় বার্ষিক ইজতেমায় যোগ দেন প্রায় ৫ হাজার মুসল্লি। ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রামের হাজী ক্যাম্পে তাবলিগের ইজতেমা আয়োজিত হয়।

১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে আয়োজিত হয় আরও একটি ইজতেমার।

১৯৬০ সালে ঢাকার রমনা উদ্যানে অনুষ্ঠিত ইজতেমাই ছিল প্রথমবারের মতো বড় পরিসরের আয়োজন। যেখানে যোগ দিয়েছিলেন প্রায় ১৫ হাজার মুসল্লি। এরপর ১৯৬২ ও ১৯৬৫ সালে রমনায় বার্ষিক ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়।

তাবলিগ জামাত
টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমা। ছবি: স্টার ফাইল ফটো

১৯৬৫ সালে রমনায় অনুষ্ঠেয় ইজতেমায় সমাগম হয় প্রায় ২৫ হাজার মুসল্লির। সেখানে স্থান সংকুলান সম্ভব হয়নি। ইজতেমায় মুসল্লি ও অনুসারীদের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকায় ১৯৬৬ সালে রমনার পরিবর্তে গাজীপুরের টঙ্গীতে তুরাগ নদের তীরে পাগার গ্রামের খেলার মাঠে প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হয় বার্ষিক ইজতেমার।

মহান মুক্তিযুদ্ধের পর তথা ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টঙ্গীতে তুরাগের তীরবর্তী বিস্তীর্ণ ও সুবিশাল পাগার গ্রামের মাঠ তাবলিগ জামাতের বাৎসরিক ইজতেমার জন্য বরাদ্দ দেন। এর পরের বছর থেকে খেলার মাঠটি ছাড়াও তুরাগের উত্তরপূর্ব তীরে ডোবা-নালা, উঁচু-নিচু এলাকা ও রাজউকের হুকুমদখলের ১৬০ একর বিশাল ময়দানে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

১৯৮০-র দশকের শুরু থেকেই টঙ্গী ইজতেমায় বাংলাদেশ ছাড়াও বেশ কয়েকটি দেশ থেকে আসা বিপুল সংখ্যক মুসল্লি যোগ দিচ্ছেন। একই সময়ে পাকিস্তানের লাহোরের কাছে রায়উইন্ড শহরে ও ভারতের ভূপালে বড় ইজতেমার আয়োজন করা হয়।

এই ২ ইজতেমার চেয়ে টঙ্গীর ইজতেমায় বেশি মুসল্লি যোগ দিলে তা পরবর্তীতে 'বিশ্ব ইজতেমা' হিসেবে পরিচিতি পায়।

মুসল্লির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেলে টঙ্গীর সুবিশাল ময়দানেও মুসল্লিদের স্থান সংকুলান না হলে ২০১১ সালে প্রথমবারের মতো ২ ভাগে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হতে শুরু করে।

এর এক পর্বে অংশ নেন দেশের ৩২ জেলার ও অন্য পর্বে বাকি ৩২ জেলার মুসল্লি। তাতেও মুসল্লিদের স্থান সংকুলান না হওয়ায় ২০১৩ সালে সিদ্ধান্ত হয় প্রতি বছর ইজতেমা ২ পর্বে হলেও বাংলাদেশের মুসল্লিরা অংশ নেবেন ৪ ভাগে বিভক্ত হয়ে।

প্রথম বছরে ২ পর্বে অংশ নিবেন ৩২ জেলার ও দ্বিতীয় বছর ২ পর্বে অংশ নিবেন বাকি ৩২ জেলার মুসল্লি।

ইজতেমা যেভাবে আয়োজিত হয়

টঙ্গীতে 'বিশ্ব ইজতেমা'র কার্যক্রম সাধারণত প্রতি জানুয়ারির দ্বিতীয় বা তৃতীয় সপ্তাহের শুক্রবার ফজরের পর আম বয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হয়।

সেদিন সকাল ১০টায় শুরু হয় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য বিশেষ বয়ান। সেসময় তাবলিগের পুরনো অনুসারী ও বিদেশিদের জন্য আলাদা বয়ান হয়।

জুমার পর হয় আরেক দফা বয়ান। বাদ আসর ও বাদ মাগরিব হয় আলাদা ২ বয়ান।

শনিবার ফজরের পর প্রথম বয়ানের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় দিনের ইজতেমার কার্যক্রম শুরু হয়। ওইদিন সকাল ১০টায় শুরু হয় আলেমদের উদ্দেশ্যে বয়ান। অন্যদিকে, চলে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ বয়ান।

একই সময়ে অন্যত্র চলে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ বয়ান। অন্যত্র হয় বিদেশিদের জন্য ইংরেজিতে বিশেষ বয়ান। বাদ যোহর, আসর ও মাগরিবের পর হয় ৩ ভিন্ন বয়ান।

রোববার ফজরের পর আম বয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় শেষ দিনের কার্যক্রম। সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ বয়ান। এরপর আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হয় বিশ্ব ইজতেমার কার্যক্রম।

টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ছাড়াও দেশের ৬৪ জেলাতেই প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় জেলাভিত্তিক পৃথক ইজতেমা।

যে কারণে ইজতেমার আয়োজন

ইজতেমা অর্থ সমাগম। বিশ্ব ইজতেমা বাংলাদেশে তো বটেই বৈশ্বিকভাবেও তাবলিগ অনুসারীদের সবচেয়ে বড় জমায়েত।

ইজতেমা আয়োজনের প্রধান কারণ হলো—সারা বছর দেশব্যাপী তাবলিগের কর্মপদ্ধতি কীভাবে চলবে তা নিয়ে ইজতেমায় আলোচনা হয়। একই সঙ্গে ইজতেমাকে কেন্দ্র করে দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা বেশিরভাগ তাবলিগ অনুসারী নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ধর্মপ্রচারের কাজে বের হন।

ইজতেমার মধ্য দিয়েই মূলত দেশব্যাপী তাবলিগের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতিসহ অন্যসব কার্যক্রম প্রণীত হয়।

তাবলিগ জামাতে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ও বর্তমান অবস্থা

ভারতে মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভীর হাতে সৃষ্ট তাবলিগ জামাত শুরু থেকেই ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখেছিল কওমি মাদ্রাসার সঙ্গে। বাংলাদেশেও সেভাবেই এর সূচনা হয়। তাবলিগ জামাতে মাদ্রাসা শিক্ষক ও ছাত্রদের উপস্থিতি বেশি দেখা যায়।

১৯৯৫ সালে মাওলানা ইনামুল হাসান কান্ধলভী মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি তাবলিগের ১০ সদস্যকে নিয়ে শুরা ব্যবস্থা প্রণয়ন করেন। যেন তার অনুপস্থিতিতে শুরা সদস্যরা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এটি ২০১৫ সাল পর্যন্ত বলবৎ ছিল।

২০১৫ সালে তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইলিয়াস কান্ধলভীর প্রপৌত্র মাওলানা সাদ কান্ধলভীকে তাবলিগ জামাতের বিশ্ব আমির করা হয়।

২০১৭ সালে মাওলানা সাদ কান্দলভীর কয়েকটি বিবৃতি দেওবন্দ মাদ্রাসার অনুসারীদের বিরুদ্ধে যায়। দক্ষিণ আফ্রিকার মুফতি ইব্রাহিম দেসাই এই বিষয়ে 'আস্কইমাম' ওয়েবসাইটে ফতোয়া দেন। এতে মাওলানা সাদের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।

২০১৮ সালে তাবলিগ জামাতের মধ্যে ২ পক্ষের সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে চরম দ্বন্দ্ব শুরু হয় দিল্লির নিজামুদ্দিনে। মাওলানা সাদ কান্দলভীকে নিয়ে এই দ্বন্দ্বে পৃথক হয়ে পড়েন তাবলিগের অনুসারীরা। মাওলানা সাদের বিরুদ্ধে পৃথক ফতোয়া দিয়ে বৈশ্বিকভাবে দারুল উলুম দেওবন্দের নীতি অনুসরণ করা হয় কওমি ও দেওবন্দী মাদ্রাসাগুলোয়।

এই দ্বন্দ্বের রেশ এসে পড়ে বাংলাদেশেও।

দেওবন্দ মাদ্রাসার অনুসরণে বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসার অনুসারীরাও মাওলানা সাদের বিপক্ষে অবস্থান নেন। তারা মাওলানা সাদকে বাংলাদেশে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন।

পরবর্তীতে ২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশে ২ ভাগে বিভক্ত তাবলিগের অনুসারীরা ২ পর্বে ইজতেমার আয়োজন করে আসছেন।

সূত্র: তাবলীগ জামায়াত/ ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্‌ইয়া আখতার

ahmadistiak1952@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

Nowfel gained from illegal tobacco trade

Former education minister Mohibul Hassan Chowdhoury Nowfel received at least Tk 3 crore from a tobacco company, known for years for illegal cigarette production and marketing including some counterfeit foreign brands.

9h ago