কামালপুর রণাঙ্গণে যারা এনেছিলেন বিজয়ের বার্তা

কামালপুর রণাঙ্গণ : যারা এনেছিলেন বিজয়ের বার্তা
কামালপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের নায়ক বশির আহমেদ বীর প্রতীক (বামে) ও আনিসুল হক সঞ্জু বীর প্রতীক। ছবি: বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক হারুন হাবীব

ভারতীয় ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেডের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লেয়ারের সামনে তখন হাজারো মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনার জমায়েত। উপস্থিত সবার মধ্যেই পিনপতন নীরবতা। মৃত্যুর মুখে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের কথা যেন হারিয়ে গেছে। প্রস্তাবটি যেন মৃত্যুর কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়া। সবাই জানেন, এ যাওয়া হবে নিশ্চিতভাবেই শেষ যাত্রা।

কে পারবেন দেশের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে? ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ারের প্রস্তাব—'কে যাবে কামালপুরে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে তাদের আত্মসমর্পণ প্রস্তাবের চিঠি নিয়ে?' উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধারা তখনো ভেবে পাচ্ছিলেন না কী করবেন।

হঠাৎই রোগা পাতলা এক কিশোর সটান হয়ে দাঁড়িয়ে বললো, 'আমি যাবো।'

ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ারের মুখে তখন অবিশ্বাসের ছোঁয়া—'এই ছেলে যাবে!' ঠাট্টা নাকি সত্য। তিনি আবারো প্রশ্ন করলে অনড় উত্তর সেই কিশোরের—'স্যার, আমিই যেতে চাই।'

ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার আর বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে থাকলেন না। সেই কিশোরের হাতে তুলে দিলেন সাদা পতাকা আর একটি খাম। সেই খামে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশে লেখা আত্মসমর্পণ প্রস্তাবের চিঠি।

কামালপুর রণাঙ্গণ : যারা এনেছিলেন বিজয়ের বার্তা
বশির আহমেদ বীর প্রতীক। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক/স্টার

সেদিনের সেই কিশোর বর্তমানে ৬৫ বছরের বশির আহমেদ বীরপ্রতীক। এই কিংবদন্তিতুল্য বীর মুক্তিযোদ্ধা থাকেন জামালপুরের বকশীগঞ্জে। আত্মসমর্পণের সেই ঐতিহাসিক ঘটনা শুনতে উপস্থিত হই তার বাড়িতে।

বাকিটা শুনি তার মুখেই।

'ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার আমার পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, "বহুত আচ্ছা, বহুত আচ্ছা। ঠিক হ্যায়!" এরপর তিনি আমার হাতে চিঠির খাম ও সাদা পতাকা দিয়ে বললেন, 'এগুলো নিয়ে তুমি কামালপুর বিওপিতে যাবে। চিঠিটা তুমি পাকিস্তানি অফিসারের হাতে দেবে। তবে প্রথমে তুমি ক্যাম্পে ঢুকবে না। ক্যাম্প থেকে দূরে দাঁড়িয়ে ইশারায় সাদা পতাকা আর খাম দেখিয়ে ওদের আসতে বলবে। যদি ওরা গুলি করে তুমি শুয়ে পড়বে। তখন আমরা এ পাশ থেকে আর্টিলারি ফায়ার শুরু করবো। তুমি ক্রল করে এখানে চলে আসবে।'

বশির আহমেদ যখন সেদিনের বর্ণনা দিচ্ছিলেন তখন তিনি যেন ফিরে যাচ্ছিলেন সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে।

জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলায় সীমান্তবর্তী কামালপুরের যুদ্ধ ছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ ও বিপজ্জনক যুদ্ধ। ১৮০ দিনের এই যুদ্ধে 'পরিকল্পিত ও মুখোমুখি' যুদ্ধই হয়েছে ৪ বার। বর্তমানে কামালপুরের যুদ্ধ পড়ানো হয় বিশ্বখ্যাত অনেক সামরিক কলেজে।

১৯৭১ সালের নভেম্বরের শেষ দিকে কামালপুর বিওপিতে অবস্থান নেওয়া পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর মরণকামড় বসান মুক্তিবাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধারা। একপর্যায়ে ২৪ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পুরোপুরি অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে কামালপুরে থাকা পাকিস্তানি সেনারা। বন্ধ হয়ে যায় তাদের রসদ ও গোলাবারুদ সরবরাহ। বহু চেষ্টা করেও মুক্তিযোদ্ধাদের অবরোধ ভাঙতে ব্যর্থ হয় তারা।

টানা ১১ দিন অবরুদ্ধ রাখার মধ্য দিয়ে কামালপুরে থাকা হানাদারদের সমস্ত প্রাণশক্তি শুষে নেয় মুক্তিবাহিনী।

কামালপুর রণাঙ্গণ : যারা এনেছিলেন বিজয়ের বার্তা
আনিসুল হক সঞ্জু বীর প্রতীক। ছবি: সংগৃহীত

সে বছরের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতে আক্রমণ করলে সে রাতেই শুরু হয় পাক-ভারত যুদ্ধ। তখন মুক্তিবাহিনীর সাহায্যে আনুষ্ঠানিকভাবে এগিয়ে আসে ভারতীয় বাহিনীও।

আবার ফিরে যাই বশির আহমেদের কথায়। তিনি বলতে থাকেন, 'আমাদের কোম্পানির অবস্থান ছিল বানরোডের কাছে। সন্ধ্যার দিকে ভারতীয় মেজর জওহর সিং এসে জানালেন, পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। একটু পর ইন্দিরা গান্ধী এ বিষয়ে ঘোষণা দিবেন। তোমরা বিমান হামলা থেকে বাঁচতে ট্রেঞ্চ খুঁড়ে নাও। তখন আমি আর এক ভারতীয় হাবিলদার ট্রেঞ্চ খুঁড়ে সেখানে আশ্রয় নিলাম।'

রাতেই মহেন্দ্রগঞ্জে ব্যাটেলিয়ন হেডকোয়ার্টারে বৈঠক হয় ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেডের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লেয়ার ও ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক স্কোয়াড্ৰন লিডাৱ এম হামিদুল্লাহ খানসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।

বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় পরদিন ৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেওয়া হবে। যদি তারা প্রস্তাবে রাজি না হয় তবে বিমান হামলা চালিয়ে কামালপুর বিওপি উড়িয়ে দেওয়া হবে।

বশির আহমেদ বললেন, 'সে রাতেই মুক্তিবাহিনীর কয়েকটি ক্যাম্পে খবর পাঠানো হলো পরদিন সকালে যেন ব্রাহ্মণপাড়া গ্রামে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে পাঠানো হয়। পরদিন সকালে ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার আমাদের ক্যাম্পে আসলেন। ততক্ষণে অনেক মুক্তিযোদ্ধা হাজির হয়ে গেছেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে বললেন, "তোমাদের মধ্যে কোনো একজনকে কামালপুর বিওপিতে আত্মসমর্পণের চিঠি নিয়ে যেতে হবে। কে চিঠি নিয়ে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে যেতে পারবে?'"

'আমরা জানি পাঞ্জাবিরা রুক্ষ মেজাজের। ওদের সামনে যাওয়া মানেই নিশ্চিত মৃত্যু। সুতরাং সবাই নীরব থাকলেন। তখন তিনি কয়েকটি ক্যাম্পে ওয়্যারলেসে প্রস্তাব দিয়ে জানতে চাইলেন। কিন্তু, কেউই রাজি হলেন না। তখন ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার খুব রাগান্বিত হয়ে বললেন, "দেখো, তোমাদের দেশের জন্য আমরা জীবন দিচ্ছি। অথচ তোমরা একজন মুক্তিযোদ্ধাও মরতে রাজি হচ্ছো না।" একপর্যায়ে আমার মনে হলো—মৃত্যু তো জীবনে একবার আসবেই। দেশের জন্যই নয়তো মরবো। আমি তখন হাত উঠিয়ে বললাম, "স্যার, আমি যাবো"।'

কামালপুর রণাঙ্গণ : যারা এনেছিলেন বিজয়ের বার্তা
কামালপুর বিওপি। এখানে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক/স্টার

বশির আহমেদের চোখেমুখে ভিড় করে রাজ্যের উৎসাহ। আমরাও কান পাতলাম। তিনি বললেন, 'বর্ডার থেকে কামালপুর বিওপির দূরত্ব প্রায় ২ হাজার গজ। তখন পুরোটা ফাঁকা থাকায় পরিষ্কার দেখা যেত। আমি চিঠি আর পতাকা নিয়ে কামালপুর বিওপির পাকিস্তানি ক্যাম্পের দিকে রওয়ানা হলাম। পাকিস্তানি সেনারা আমাকে দূর থেকে আসতে দেখে বাঙ্কারে ঢুকে গেল। আমি তখন হাত উঁচিয়ে পতাকা আর সাদা খাম দেখালাম। প্রথমে ওরা কেউ আসছিল না। কিছুক্ষণ পর আমাকে ইশারায় ক্যাম্পের দিকে আসার জন্য ডাকলো।'

'আমি মনে মনে আল্লাহর নাম স্মরণ করে হেঁটে বিওপির গেটে চলে এলাম। একজন অফিসার আমার হাত থেকে পতাকা আর খাম নিয়ে বসতে বলে ভিতরে গেল। একজন হাবিলদারকে বলে গেল আমাকে দেখতে।'

'কিন্তু, দেখলাম অনেকক্ষণ হয়ে গেলেও ওরা ক্যাম্পের বাইরে আসছে না। এর কয়েক মিনিট পর কামালপুর বিওপির ওপর ভারতীয় বিমান বাহিনীর আক্রমণ শুরু হলো। বোমার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমাকে নিয়ে সেই হাবিলদার বাঙ্কারের ঢুকে গেল।'

বশির আহমদ বিওপি থেকে ফিরে না আসায় যৌথবাহিনী ভেবেছিল তাকে হয়তো হত্যা করেছে পাকিস্তানি সেনারা। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিলেন আরও এক মুক্তিযোদ্ধাকে পাঠানো হবে। কিন্তু, এবার তো আরও অনিশ্চয়তা। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে কে রাজি হবেন? রাজি হলেন সেই সময় এসএসসি পরীক্ষার্থী কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আনিসুল হক আকন্দ সঞ্জু।

বশিরের মতো তাকেও পাঠানো হয়েছিল একইভাবে। হাতে দেওয়া হয়েছিল ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ারের লেখা আরেকটি চিঠি। ওতে লেখা ছিল—পাকিস্তানি বাহিনী যদি আত্মসমর্পণ প্রস্তাবে এখনো রাজি না হয়, তবে বিমান হামলা চালিয়ে পুরো বিওপি নিমিষেই মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হবে। আনিসুল হক সঞ্জুও যথা নিয়মে উপস্থিত হন কামালপুর বিওপির সামনে।

'২০০৮ সালে সঞ্জু মারা গেছেন,' উল্লেখ করে বশির আহমেদ বলেন, 'সে ঠিক আমার মতোই এলো। দূর থেকে ওকে দেখতে পেয়ে ক্যাপ্টেন আহসান মালিক আমাকে বললো, "মুক্তি তোমারা দুসারা আদমি আয়ে গি।" ওকে ডেকে নিয়ে ওর হাত থেকে চিঠির খামটি নিয়ে ভিতরে চলে গেল ক্যাপ্টেন মালিক। আমি সঞ্জুকে বললাম, "আমি মরেছি তো মরেছি, তুমি আসলে কেন?" ও বললো "দেশের জন্য এসেছি"।'

'কিছুক্ষণ পর ভারতীয় বিমান বাহিনী বোমা ফেলতে শুরু করল কামালপুর বিওপির ওপর। বোমার স্প্লিন্টারে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা আহত হলো। তখন ক্যাপ্টেন আহসান মালিক দৌড়ে এসে আমাদের হাতে সাদা পতাকা ও চিঠি দিয়ে বললো "তোমরা বিমানকে এটা দেখাও, আমরা আত্মসমর্পণ করবো।" আমরা তখন বেরিয়ে এসে বিওপির সামনের খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে বিমানের উদ্দেশে পতাকা আর চিঠিটা উঁচু করে ধরে নাড়তে লাগলাম। তখন ভারতীয় বিমান ফিরে গেল।'

আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ার আগে ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লেয়ারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন ক্যাপ্টেন আহসান মালিক। সেই প্রস্তাব নিয়ে চিঠি তুলে দেওয়া হয় বশির আহমদের হাতে।

বশির আহমদ বলেন, 'ক্যাপ্টেন মালিক আমার হাতে চিঠি দিয়ে উর্দুতে বললো "চিঠিটা ব্রিগেডিয়ার সাহেবের হাতে দিয়ে একটা চিঠি নিয়ে আসবে।" আমি চিঠিটা নিয়ে রওয়ানা দিতেই দেখলাম বর্ডারের পাশেই সবাই উপস্থিত। ভারতীয় লেফটেন্যান্ট আবদুল মালেক ও গোর্খা রেজিমেন্টের এক ক্যাপ্টেন দৌড়ে এসে আমাকে কোলে তুলে ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ারের কাছে নিয়ে গেলেন।' 'বুঝলাম তারা ততক্ষণে বুঝে গেছেন পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণে রাজি হয়েছে। আমি ব্রিগেডিয়ারের হাতে চিঠি দিতেই তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।'

এরপর ২ পক্ষের মধ্যে প্রায় দেড় ঘণ্টা আলাপের পর ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় শুরু হয় আত্মসমর্পণের পর্ব। ক্যাপ্টেন আহসান মালিকের নেতৃত্বে প্রায় ১৫০ পাকিস্তানি সেনা এবং ৩০ মিলিশিয়া ও রেঞ্জার সেনা আত্মসমর্পণ করে যৌথবাহিনীর কাছে। এর সঙ্গে মুক্ত হয় জামালপুরের ঐতিহাসিক রণাঙ্গন কামালপুর। ২ কিশোরের হাত ধরেই প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ে কামালপুরের মাটিতে।

সেদিনের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের বর্ণনা দিতে গিয়ে বশির আহমেদ বীর প্রতীকের চোখ ছলছল করে উঠে। তিনি বললেন, 'আমার তখনো বিশ্বাস হচ্ছিল না যে আমাদের কামালপুর স্বাধীন হয়ে গেছে।'

এবার আমাদের উঠার পালা। তখন সন্ধ্যা নামছে। যদিও তা ৫১ বছর আগের সন্ধ্যার মতো ঐতিহাসিক সন্ধ্যা নয়।

আহমাদ ইশতিয়াক, ahmadistiak1952@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

Ending impunity for crimes against journalists

Though the signals are mixed we still hope that the media in Bangladesh will see a new dawn.

10h ago