গণঅভ্যুত্থানে সংবিধানের শক্তি ‘জনগণ’

বাংলাদেশে অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম ফ্যাসিস্ট শাসক দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। ক্ষমতার দম্ভে ধরাকে সরাজ্ঞান করা শেখ হাসিনা গণক্ষমতাকে অবজ্ঞা করার ফল হাতেনাতে পেয়েছেন। তিনটি বিতর্কিত, প্রশ্নবিদ্ধ ও একচেটিয়া নির্বাচন করে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশন চাপ সামলে ওঠার মধ্য দিয়ে তিনি ভেবেছিলেন তিনি সকলের ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে বাংলাদেশের আপামর জনগণের নজিরবিহীন গণজাগরণ শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। বিদায় নেয়ার আগে শেখ হাসিনার নির্দেশে আনুষ্ঠানিক হিসাবে অন্তত ছয় শতাধিক প্রাণ ঝরে পড়েছে। আহত হয়েছে কয়েক হাজার মানুষ।

সংবিধান মেনে কখনো গণঅভ্যুত্থান হয় না; এ কথা অনুধাবন করাটা হয়তো খুব কঠিন নয়। কিন্তু গণঅভ্যুত্থান ক্ষমতার বিন্যাসে নানা ধরনের পরিবর্তন আনে যার নিশানা শুধুমাত্র স্বৈরাচারী সরকারই হয় না; সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজনীতির বিভিন্ন খাতে ক্ষমতাসীন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীও নতুন পরিস্থিতিতে হুমকিতে পড়ে। ফলে যেকোনো মূল্যে তারা পুরোনো ক্ষমতাকাঠামো বহাল রাখতে চায়।

গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর নতুন করে সংবিধান বিতর্ক উঠেছে। বাহাত্তরের সংবিধান নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন আগে থেকেই ছিল। বিশেষ করে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য শাসনতন্ত্র প্রণয়নের উদ্দেশে আয়োজিত সত্তুরের নির্বাচনে জয়ীদের দ্বারা স্বাধীন দেশের সংবিধান প্রণয়নের আইনি-রাজনৈতিক ভিত্তি নিয়ে তখন থেকেই প্রশ্ন ছিল। দ্বিতীয়ত, ওই সংবিধানের একব্যক্তিকেন্দ্রীক ও স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতাকাঠামো নিয়ে প্রশ্নও নব্বই দশক থেকে ছিল।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর আবারও সংবিধান বিতর্ক শুরু হয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতার ভিত্তি কী— এমন প্রশ্ন নিয়ে অভ্যুত্থানপন্থী বিভিন্ন অংশের মধ্যেও নানা ধরনের মতামত দেখা যাচ্ছে। কেউ বলছেন, সংবিধানের ভেতর থেকেই এই সরকারের আইনি বৈধতার ব্যাখ্যা তৈরি করা সম্ভব; কেউ বলছেন, না, বাংলাদেশের সংবিধানের কোথাও 'অন্তর্বর্তী সরকার' বলতে কোনো বিধান নাই। কাজেই বিদ্যমান সংবিধান বর্তমান সরকারের আইনি বৈধতার ভিত্তি হতে পারে না। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অর্জিত গণসার্বভৌমত্বই বর্তমান সরকারের আইনি বৈধতার ভিত্তি। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে শপথ গ্রহণ করলেও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস সাহেবকে বারবার "ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সৃষ্ট সরকার" — এমন বরাত দিতে দেখা যাচ্ছে।

সংবিধান মেনে কখনো গণঅভ্যুত্থান হয় না; এ কথা অনুধাবন করাটা হয়তো খুব কঠিন নয়। কিন্তু গণঅভ্যুত্থান ক্ষমতার বিন্যাসে নানা ধরনের পরিবর্তন আনে যার নিশানা শুধুমাত্র স্বৈরাচারী সরকারই হয় না; সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজনীতির বিভিন্ন খাতে ক্ষমতাসীন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীও নতুন পরিস্থিতিতে হুমকিতে পড়ে। ফলে যেকোনো মূল্যে তারা পুরোনো ক্ষমতাকাঠামো বহাল রাখতে চায়।

অভ্যুত্থানপন্থী অনেকেই তর্ক তুলেছেন যে, বর্তমান সরকারকে আইনি ন্যায্যতা দিতে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অর্জিত গণসার্বভৌমত্বই যথেষ্ট। এ ব্যাপারে সবচেয়ে শক্তিশালী মত পাওয়া যায় কবি ও ভাবুক ফরহাদ মজহারের লেখা ও বক্তব্যে। কিন্তু অনেকে ভাবছেন ফরহাদ মজহার অনেক বেশি 'বিপ্লবী' অবস্থান নিয়েছেন। যদিও বিপ্লব নয়; একটা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের ধ্রুপবী পথের কথাই বলছেন বলে ফরহাদ মজহার দাবি করেছেন।

বিদ্যমান সংবিধানের ভেতর থেকে গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে এবং বিদ্যমান সংবিধানের বিপক্ষে কি কোনো যুক্তি তুলে ধরা যায়? ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি গণঅভ্যুত্থান নিজেই নিজের ন্যায্যতা তৈরি করতে সক্ষম, এর জন্য কোনো সাংবিধানিক দোহাইয়ের প্রয়োজন হয় না। তবু, আমাদের সমাজে সংবিধানবাদী অবস্থান বেশ শক্তিশালী, এই সত্য অস্বীকারের কোনো উপায় নাই। কাজেই গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে এবং বিদ্যমান সংবিধানের বিরুদ্ধে কোনো 'সাংবিধানিক' যুক্তি খোঁজা যায় কি না, সেই প্রয়াস নিতে পারি।

বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধানের প্রস্তাবনার একেবারে শুরুর বাক্যটা এরকম "আমরা, বাংলাদেশের জনগণ.." ; এর সামান্য নিচেই লেখা রয়েছে: "বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিস্বরূপ এই সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রাখা…"

অর্থাৎ, সংবিধান আর কিছু নয়, গণঅভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি মাত্র— এমনকি বিদ্যমান গণবিরোধী সংবিধানেও এর স্বীকৃতি রয়েছে। এ কথার আরেক তাৎপর্য এই যে, গণঅভিপ্রায়ই সাংবিধানিক প্রাধান্য পাবে।

৭ (২) এ 'সংবিধানের প্রাধান্য' কথাটা ব্যাখ্যা করা হয়েছে এভাবে: "জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসমঞ্জস হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে.."

তথা গণঅভিপ্রায়ই সংবিধান এবং সংবিধানই প্রজাতন্ত্রের 'সর্বোচ্চ আইন'। তার মানে সংবিধানের যা কিছু গণঅভিপ্রায়ের বিপরীতে অবস্থান নেয়, তা কিছু অসাংবিধানিক তথা বাতিল হিসেবে গণ্য হবে।

যেকোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণঅভিপ্রায় যাচাইয়ের পন্থা হিসেবে নির্বাচনের ভূমিকা তর্কাতীত। কিন্তু ২০১১ সালে দুই-তৃতীয়াংশ সংসদীয় আসনে জোরে— প্রাপ্ত ভোটের হিসাবে যা আবার মোট প্রদত্ত ভোটের অর্ধেকেরও কম—

আওয়ামীলীগ সরকার পঞ্চদশ সংশোধনী আনে। এই সংশোধনীর মাধ্যমে ত্রয়োদশ সংশোধনী তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা খুব আহামরি কোনো ব্যবস্থা ছিল না; এ নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। আপাতত সে সকল বিতর্ক পাশ কাটিয়ে এটুকু বলা দরকার যে, গণআন্দোলনের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছিল তা ভুলে গেলে চলবে না। আওয়ামীলীগও সেই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে আওয়ামীলীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। এ ক্ষেত্রে তারা আদালতকেও ব্যবহার করে গণআন্দোলনের ফসল আদালতের মাধ্যমে বাতিল করার বাজে নজির সৃষ্টি করেছে। শুধু তাই নয়, সংবিধানে ৭ অনুচ্ছেদের পরে ৭ (ক) ও ৭ (খ) অনুচ্ছেদ সংযোজন করে 'সংবিধান বহির্ভূত' পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের পথ রুদ্ধ করা হয়। অর্থাৎ, একদিকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন তথা শান্তিপূর্ণ উপায়ে গণঅভিপ্রায় যাচাইয়ের পথ বন্ধ করে দেয়া হয়; অন্যদিকে, এই সংবিধানকে পরিবর্তনের অযোগ্য করে তোলা হয়। 'সর্বোচ্চ শাস্তি' তথা মৃত্যুদণ্ডকে সংবিধান 'লঙ্ঘনের' শাস্তি নির্ধারণ করা হয়।

এর মধ্য দিয়ে সাংবিধানিক পথে ক্ষমতা হস্তান্তরের সকল পথ আসলে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এর সাথে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সংক্রান্ত ৫৭ (৩) অনুচ্ছেদ মিলিয়ে পাঠ করা যাক: (৩) "প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই অযোগ্য করিবে না।"

৫৭ (১ক) অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির নিকট পদত্যাগপত্র জমা দিলে প্রধানমন্ত্রীর পদ 'শূন্য হইবে' ঠিকই; কিন্তু ৫৭(৩) অনুযায়ী নতুন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণ করার আগ পর্যন্ত পদত্যাগকারী প্রধানমন্ত্রীই 'স্বীয় পদ' অলঙ্কৃত করে থাকবেন। "সংবিধান অনুযায়ী আমার মা এখনো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী" — সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র জয়ের দাবি এ আলোকেই বুঝতে হবে।

আমাদের দাবি, এই সংবিধান নিজেই নিজেকে বাতিল করে দিয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, সাংবিধানিকভাবেই বর্তমান সংবিধান অবৈধ ও বাতিল। কীভাবে? প্রস্তাবনা মোতাবেক সংবিধান জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের দলিল। বিদ্যমান সংবিধানের প্রস্তাবনায় 'জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়' ধারণাটি স্বীকৃত। অন্যদিকে, পঞ্চদশ সংশোধনীর দরুন এই সংবিধানের সংযোজন, বিয়োজন, পরিবর্তন কিংবা পরিবর্ধন করা যাবে না। নতুন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণের আগ পর্যন্ত পূর্বের প্রধানমন্ত্রীই বহাল থাকবেন।

সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর বা পরিবর্তনের সকল পথ রূদ্ধ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, নাগরিকের বেশ কিছু সহজাত ও অবিচ্ছেদ্য অধিকার— যেমন জীবন ধারণের অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার ইত্যাদি— ধ্বংস করেছিল ফ্যাসিবাদী আওয়ামীলীগ সরকার। আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এম এ মতিন মনে করেন, এমন অবস্থায়: "যখন কোনো রাজা বা শাসক সেই অধিকারগুলো ধ্বংস করে, তখন সেই শাসন ব্যবস্থা বদলানোর দায়িত্ব জনগণের ওপর বর্তায়। জনগণ তখন সেই শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তন অথবা বিলোপের অধিকার রাখে।" ("বিপ্লব যখন সফল হয়, তখন পুরোনো সংবিধান অকার্যকর", সাবেক বিচারপতি এম এ মতিন, সমকাল, ১১ আগস্ট, ২০২৪)

অর্থাৎ এই সংবিধান প্রস্তাবনায় ঘোষিত জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ফলে গাঠনিক ক্ষমতার জোরে জনগণ এই সংবিধানের অসাংবিধানিকতাকে উৎখাত করতে পারে। গণঅভ্যুত্থানে সেটাই ঘটেছে। দর্শন ও আইন শাস্ত্রে গাঠনিক ক্ষমতা একটি আইনি-রাজনৈতিক বর্গ।

গাঠনিক ক্ষমতার বলে জনগণ দুটি কাজ করতে পারে। এক, যেকোনো অসাংবিধানিক সংশোধনী (যেমন পঞ্চদশ সংশোধনী) প্রত্যাখ্যান করতে পারে। দুই, গণঅভ্যুত্থানকে "জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়" রূপে বৈধতা দিতে পারে।

এখানে আরও দুটি বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি। সংবিধানের প্রস্তাবনা সংশোধনের অধীন নয়; অর্থাৎ চাইলেই একে বদলানো যায় না। বাংলাদেশের আইন বিশারদগণ প্রয়োজনে একেই সংবিধানের মৌল কাঠামো তথা বেসিক স্ট্রাকচার হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন যা আদালতের ব্যাখ্যার অধীন। কিন্তু এতকাল আদালত নির্বাহি বিভাগের কুক্ষিগত হওয়ায় জনগণের পক্ষ নিতে ব্যর্থ হয়েছেন।

কাজেই আদালতের ব্যাখার অধীন সংবিধানের মৌল কাঠামো তথা বেসিক স্ট্রাকচার থেকে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, সংবিধানের স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতাকাঠামো এবং পঞ্চদশ সংশোধনীর বলে এই মৌল কাঠামো অবলবৎযোগ্য। এক দিকে অসংশোধনীয়, অন্যদিকে অবলবৎযোগ্য। এই দুইয়ে মিলে একটি সাংবিধানিক প্যারালাইসিসের সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটেই জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে বোঝা দরকার। গণঅভ্যুত্থান সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লিখিত জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিরূপে সিদ্ধ। জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিরূপে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট আইনি মুহূর্তই এখন বাংলাদেশের (অলিখিত) সংবিধান। এই ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের লিখিত রূপ দেয়া আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

এ ক্ষেত্রে আরও একবার সাবেক বিচারপতি এম এ মতিনের মন্তব্য উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেছেন, "তারা যেহেতু এই বিপ্লবে সফল হয়েছে, সেহেতু বিদ্যমান সংবিধান আর বহাল থাকছে না। কিন্তু এই বিজয়ী শক্তি যদি বলে, তারা বিদ্যমান সংবিধানের আংশিক বা অর্ধেক বা বাছাইকৃত অংশ মেনে নিচ্ছে, তখন সেটাই আইন। কারণ, জনগণই আইনের উৎস। এ বেছে নেওয়ার অধিকারের বলেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আইনিভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে… সংবিধানের দুটি অংশ– একটি লিখিত, অন্যটি অলিখিত। অলিখিত সংবিধান হলো সেটাই, যা নাকি জনগণের মৌলিক অধিকার। পৃথিবীতে হাম্মুরাবির আইন থেকে এ যাবত যত আইন বা লিগাল ডিক্টাম এসেছে, যেমন ন্যাচারাল ল, ডিভাইন ল—সেসব থেকেই জনগণ তার অধিকার আদায়ের আইনী যুক্তি গ্রহণ করবে।"

কাজেই গণঅভ্যুত্থানের পরে জনগণ বিদ্যমান সংবিধানের যতটুকু রেখে দিতে চাইবে সংবিধান ততটুকুই প্রাসঙ্গিক, বাকিটুকু বাতিল।

তার মানে দাঁড়াচ্ছে, গণঅভিপ্রায়ের বিপরীতে অবস্থান নেয়া বিদ্যমান সংবিধানের স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতাকাঠামো এবং পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ক্ষমতা চিরস্থায়ীকরণের দুরভিসন্ধি অবৈধ ও অসাংবিধানিক। অন্যদিকে, গণঅভ্যুত্থান রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধ ও সাংবিধানিক। বিদ্যমান সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখিত "বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিস্বরূপ'' বাক্যাংশ থেকে অভ্যুত্থানের পক্ষে সাংবিধানিক বৈধতা আদায় করা সম্ভব।

দার্শনিক আলাঁ বাদিউ মহাশয় মনে করেন, কেবলমাত্র দুই ক্ষেত্রেই "জনগণ" ধারণাটা সদর্থক। এক, যখন সংঘবদ্ধ মানুষ কোনো নতুন রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করে। দুই, যখন সংঘবদ্ধ মানুষ কোনো বিদ্যমান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়; যে রাষ্ট্র ইতিমধ্যেই গণঅভিপ্রায় ও গণরায়ের বিপরীতে দাঁড়িয়েছে। 

গণক্ষমতাই গণতন্ত্র। রাষ্ট্রশক্তি গণক্ষমতার বিরুদ্ধে দাঁড়ালে "রাষ্ট্র নাকি জনগণ?" — এমন দ্বিধায় বিন্দুমাত্র না ভুগে গণক্ষমতার পক্ষে দাঁড়ানোই কর্তব্য। কারণ গণক্ষমতা টিকে গেলে এবং নিজেকে হেফাজত করতে পারলে, অতি দ্রুত এটা নতুন একটা রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে, গণক্ষমতাকে দমন করে যে রাষ্ট্রশক্তি টিকে থাকতে চায়, তাকে উৎখাত করাই গণঅভিপ্রায় তথা গণতন্ত্র।

বাংলাদেশের গণবিরোধী রাষ্ট্রশক্তি গণক্ষমতার অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। এ কারণেই মাত্র ২০ দিনে জুলাই গণঅভ্যুত্থান সফল হয়েছে। তবে গণঅভ্যুত্থানের চৈতন্যগত ও বস্তুগত শর্ত সমাজে মজুদ ছিল। শেখ হাসিনা নেতৃৃত্বাধীন মাফিয়া সিন্ডিকেট রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে গণঅভিপ্রায় প্রকাশ ও বাস্তবায়নের সকল পথ রূদ্ধ করে দিয়েছিল। ফলে 'জনগণ' নামক সুপ্ত আগ্নেয়গিরি গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে জ্বলন্ত লাভায় পরিণত হয়েছে এবং নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের আইনি শর্ত হাজির করেছে। বাংলাদেশকে এই ঐতিহাসিক মওকা কাজে লাগাতে হবে।

 

Comments

The Daily Star  | English

At least 30 hurt as clashes engulf part of Old Dhaka

Suhrawardy college, hospital vandalised as protests over student’s death turn violent

2h ago