ইতিহাসের আড়ালে

স্বাধীন ও সাহসী নবাব সিরাজউদ্দৌলা

ভারতের মুর্শিদাবাদে পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার আবক্ষমূর্তিছবি: প্রথম আলো

বাংলা, বিহার ও ওডিশার সর্বশেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন হয় ২৩ জুন। ৩ জুলাই ছিল নবাব তার ২৬৮ তম মৃত্যুদিন। কত গল্প, কত রক্তের আখ্যান, রয়ে গেছে ইতিহাসের আড়ালে। ১৭১৭ সালে মুর্শিদ-কুলি খাঁ-এর মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয় বাংলায় নবাবী আমল। সেই অর্থে তিনি প্রথম স্বাধীন নবাব এবং শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। 

সতের সালের পর থেকে দিল্লীর কোন সম্রাট বাংলায় কোন সুবাদার নিযুক্ত হয়নি। তখন চলছিল মোগল বাদশাহীর দুর্দিন। কার্যত তারা ছিলেন নামমাত্র দিল্লীর বাদশাহ। মুর্শিদ-কুলি খাঁ থেকে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পর্যন্ত প্রায় সাতচল্লিশ বছর বাংলার সবাই ছিলেন স্বাধীন নবাব।

সিরাজের ছোটবেলার নাম মীর্জা মুহাম্মদ ; তেইশ বছরের একজন টগবগে যুবা যখন বাংলা বিহার উড়িষ্যা সুবা'র নবাবের তখত- এ বসেন তখন উপাধি সহ তাঁর নাম হয় নবাব মনসুর- উল-মূলক সিরাজদ্দৌলা শাহকুলী খাঁ মীর্জা মুহাম্মদ হায়দার জঙ্গ বাহাদুর। সেদিনের সেই ছোট্ট মীর্জা মুহাম্মদ পরবর্তীতে, ইতিহাসে নবাব সিরাজউদদৌলা নামেই সমধিক পরিচিত একটি নাম।  ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল নবাব আলীবর্দীর মৃত্যুর পর তিনি হন নবাব।

১৭৫৬ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশী ট্রাজেডি পর্যন্ত, তার শাসনামল সর্বসাকুল্যে মাত্র চৌদ্দ মাসের জন্য। ঘরে বাইরে শত্রুতার কারণে কোন সময়ের জন্যও অনুকূল ছিল না, নবাব সিরাজউদ্দৌলার শাসনামলের সময়কাল। প্রিয় দৌহিত্র সিরাজ নবাবী পেয়েছিলেন দূরদর্শী নবাব আলীবর্দীর উত্তরাধিকারী হিসেবে। তরুণ সিরাজ সর্বক্ষণের জন্য আলীবর্দির সহযোগী ছিলেন বর্গী দমনের কঠিন সময় গুলিতে , এদেশের সাধারণ মানুষের প্রিয় পাত্র হয়েছিলেন এই অসীম সাহসিকতার জন্য। পরবর্তীতে নবাব হিসেবে আলীবর্দির উত্তরাধিকারীতাও অর্জন করেছিলেন। 

নবাব হওয়ার পর ঘরে বাইরে সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধাচরণের শেষ ছিলনা। যে কোন মূল্যে এদেশ থেকে বহিঃশত্রু ইংরেজদের উৎখাত করবার ব্রত গ্রহণ করেছিলেন নবাবী লাভের প্রথম দিন থেকেই। বিরুদ্ধবাদীরা অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরানোর উদ্দেশ্যে, ক্ষমতাসীন তরুণ সিরাজের বিরুদ্ধে রটানো হয়েছে অনেক অপবাদ। অথচ সত্যিকারের জাতীয় স্বার্থের প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক বলতে তাঁকেই বোঝায়। শেষপর্যন্ত  তাঁর হাতেই দেখা গেছে খামচে ধরে রাখা স্বাধীনতার পতাকা।

একথা ভুললে চলবে না নবাব সিরাজউদদৌলাই দেশপ্রেমের একজন সত্যিকারের সার্থক প্রতিকৃতি ; ছিলেন এ মাটিরই সন্তান। এ দেশের মাটির সঙ্গে বেইমানি করেননি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। তাই বিদেশি বেনিয়াদের গ্রাস থেকে এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে কার্পণ্য করেননি। ইচ্ছা করলে ব্রিটিশ বেনিয়াদের বানিজ্যে তিনি কিছু সুযোগ- সুবিধা দিয়ে, মুখ বুজে ঔদ্ধত্য সহ্য করে নবাবী আগলে থেকে যেতে পারতেন আমৃত্যু। কিন্তু তার কোনটাই তিনি করেন নি। অথচ অনেক অসাধু ঐতিহাসিক ইংরেজদের সামান্যতম আনুকূল্য লাভের আশায় নবাব সিরাজদ্দৌলার ব্যক্তিগত জীবন ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে লাগাতার মিথ্যা ও বানোয়াট গল্প বুনে তা প্রচারের আলোয় আনার অপচেষ্টা করে গেছেন এবং সে সব বিকৃত ইতিহাসের ধারা বহমান। 

ড. মুহাম্মদ মোহর আলীর ' হিস্ট্রি অব দ্য মুসলিম অব বেঙ্গল' গ্রন্থে উল্লেখ আছে  'পলাশীর যুদ্ধের অব্যবহিত পর থেকেই সিরাজ চরিত্র হননের একটি অসুস্থ প্রবণতা তৈরি হতে থাকে এবং যুদ্ধে পরাজয়ের সব দায়-দায়িত্ব তার উপরই নিক্ষেপ করা হয়। এটি খুব সহজেই বোধগম্য হয় যে, সিরাজের বিরোধীরাই পলাশী যুদ্ধ পরবর্তী প্রায় দুই শতাব্দীকাল শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেছে এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সিরাজ সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত ও মূল্যায়নকে প্রভাবিত করেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যে, এই মূল্যায়ন ও সিদ্ধান্ত সম্পর্কে সিরাজউদদৌলার সমর্থকদের কাছ থেকে অদ্যাবধি আমরা কোনো প্রামাণ্য দলিল পাইনি। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত সব দলিলপত্র ও মূল্যায়ন সিরাজের বিরোধিতা করেই রচিত হয়েছে। সেসব  রচনা ও উৎসের ওপর আমাদের অপ্রতিরোধ্য নির্ভরতা দূর্ভাগ্যবান নবাব সম্পর্কে আমাদেরকে  একটি বিপরীতমুখী ভাবনায় অভ্যস্ত করে তুলেছে।' 

একাধারে তিনি ছিলেন 'নিখাদ দেশপ্রেমিক', 'অসীম সাহসী যোদ্ধা', 'সব বিপদে পরম ধৈর্যশীল', ' কঠোর নীতিবাদী', 'নিষ্ঠাবান', 'ধার্মিক'এবং 'যে কোনো পরিণামের ঝুঁকি নিয়েও ওয়াদা রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব'।

মোহর আলীর এই বক্তব্য নানাদিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। আসলে নবাব সিরাজ বিরোধীদের লেখা এইভাবে প্রচারিত হয়েছে যে, সেখানে প্রকৃত ইতিহাস ধামাচাপা। ব্রিটিশ শাসনামলে যা কিছু লিখিত হয়েছে, তা সবই নবাব সিরাজকে বিরোধিতা করে। ফলে নবাবের পক্ষে প্রামাণ্য দলিল ও রচনার মতো সাহসী ব্যক্তিত্বের সন্ধান তেমন পাওয়া যায় না।'( বাংলার মসনদ ও নবাব সিরাজউদ্দৌলা'/মুহাম্মদ ফজলুল হক)। 

অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় 'সিরাজউদ্দৌলা' গ্রন্থটিতে ইংরেজ ও তাদের অনুগত ঐতিহাসিকদের সব ষড়যন্ত্র ছিন্ন করার চেষ্টা করেছিলেন। সততার সঙ্গে নির্মোহ সাহসী বক্তব্য রেখেছিলেন তিনি বহুল প্রচারিত এই গ্রন্থে। এই বক্তব্যের জন্য বাঙালি জাতি তাঁর কাছে চিরদিন কৃতজ্ঞ থাকবে। তিনি লিখেছেন-' সিরাজউদ্দৌলা মাত্র ১৪ মাস ১৪ দিন রাজত্ব করলেও শাসক হিসেবে তাঁর যোগ্যতা কোনো দিক দিয়ে কম ছিল না। একাধারে তিনি ছিলেন 'নিখাদ দেশপ্রেমিক', 'অসীম সাহসী যোদ্ধা', 'সব বিপদে পরম ধৈর্যশীল', 'কঠোর নীতিবাদী', 'নিষ্ঠাবান' এবং 'যে কোনো পরিণামের ঝুঁকি নিয়েও ওয়াদা রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব'।

একসময় প্রাচ্যের স্বর্গের অভিধা পেয়েছিল বাংলা, ধনে মানে সে সময়ের বাংলা ছিল সত্যিই সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলা। লুটেরার দল ইংরেজ কোম্পানির লক্ষ্য ছিল সোনার বাংলার সর্বস্ব লুটে নিয়ে ইংল্যান্ডকে সমৃদ্ধ করা। লুটেরার দলকে সেই সুযোগ করে দিয়েছিল এ দেশের এক শ্রেণীর বেইমানের দল। পিছনের দিকে ফিরে গেলে দেখা যাবে, ১৬০০ সালে ইংল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাণীর সনদে প্রথম ব্যবসার জন্য আসে পূর্ব ভারতে। এর আগে ভারতে প্রবেশ করেছিল ফরাসী ও পর্তুগিজরা। কোম্পানির কর্মচারীরা মূলত: ছিল কূট বুদ্ধিসম্পন্ন। দিল্লীর শাসন ব্যবস্থা শক্ত না থাকায় দিনের পর দিন বেপরোয়া হতে থাকে।

১৭১৭- ১৭৫৭ পলাশী বিপর্যয় পর্যন্ত বাংলা বিহার ওড়িশা সুবা'য় নবাবী আমলে  যৌথ শাসন ব্যবস্থা পরিচালিত হতো হিন্দু-মুসলমান মিলে। মুসলমান শাসকেরা আরব, তুর্কী আফগান পারস্য প্রভৃতি জায়গা থেকে এলেও এদেশে তাঁরা স্হায়ী বাসিন্দা হয়ে গিয়েছিলেন, ফিরে যাননি আর ফেলে আসা দেশে।
 
বাংলা বিহার ওড়িশা সুবা'র শাসনভার হাতে পেয়েই নবাব সিরাজউদদৌলা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিসহ এ দেশীয় অপশক্তিগুলির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। মারাঠা দমনে সত্যিকারের একজন বীরযোদ্ধা হিসেবেই তিনি এর আগে ব্যাপক পরিচিতি লাভ  করেছিলেন। সর্বোপরি তিনি ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক এবং অতিশয় তীক্ষ্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক নৃপতি।  ইংরেজদেরকে দুর্গ নির্মাণের মতো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে দিলে এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে ভবিষ্যতে মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে- এ বিষয়ে তাঁর ছিল সম্যক ধারণা। তাই নবাব সিরাজউদদৌলা প্রথমেই কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি অবরোধ করে কলকাতার অবাধ্য, ঔদ্ধত্য ইংরেজদের সমুচিত শিক্ষা দেবার উদ্দেশ্যেই কলকাতা আক্রমণ করেন এবং ১৭৫৬ সালের ২০ জুন ইংরেজদের গর্ব ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ দখল করেন। 

গভর্নর রজার ড্রেকসহ অন্যান্য ইংরেজরা ভয়ে দুর্গ থেকে পালিয়ে জাহাজে আশ্রয় নেন। দুর্গে অবস্হানকারী হলওয়েল সমেত অবশিষ্টরা নবাবের হাতে বন্দী হন। বন্দীদের প্রতি নবাব কোন প্রতিশোধমূলক ব্যবস্হা বা দুর্ব্যবহার করেননি। ব্রিজেন কে গুপ্তেরও একই মত 'কোম্পানির সাথে নবাব তার বিরোধ মেটাতে বলপ্রয়োগ করেননি। বরং তিনি ইংরেজদের সম্পত্তির দেখাশোনাও করতেন। অর্থাৎ তার হস্তগত ইংরেজ সম্পত্তির  যথাযথ যত্ন নিতেন। ইংরেজদের প্রতি নবাবের ইচ্ছাকৃত নিষ্ঠুরতার কোন প্রমাণ আমি পাইনি। বরং আমরা দেখি যে ওয়াটস, কালেট এবং হলওয়েলকে নিজের হাতে পেয়েও প্রতিশোধ গ্রহণের কোন চেষ্টাও তিনি করেননি।'  কলকাতা পতনের পর ড্রেক, হলওয়েল ইংরেজদের পরবর্তীতে ফলতায় আশ্রয় দেয়া থেকে নানাভাবে সহায়তা করেন প্রভাবশালী উমিচাঁদ, জগৎশেঠ,মানিকচাঁদ, রায়দুর্লভ প্রমুখ। 

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীতে সংঘটিত যুদ্ধে পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের বিপরীতে মাত্র তিন হাজার সৈন্যের কাছে বীরযোদ্ধা,বিচক্ষণ,দেশপ্রেমিক নবাব সিরাজউদদৌলার পরাজয় নিছক বিপর্যয় ছাড়া আর কিছুই নয়। মূলতঃ সেদিনে তাঁর পরাজয় ছিল বিশ্বাসঘাতকতার কাছে স্রেফ আত্মসমর্পণ- এছাড়া তাঁর অন্য কোন উপায়ও ছিল না। 

পলাশী বিপর্যয়ের পর বিধ্বস্ত নবাব কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষীর পরামর্শে তড়িৎ গতিতে পলাশী যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে রাজধানী মুর্শিদাবাদ ফিরে আসেন। কালবিলম্ব না করে স্ত্রী, কন্যাসহ সাধের হীরাঝিলকে বিদায় জানিয়ে দ্রুত স্হান  ত্যাগ করে স্হলপথে ভগবানগোলা গিয়ে নৌকায় ওঠেন। উদ্দেশ্য তাঁর গন্তব্য হবে পাটনা; সেখানে ফরাসী সেনাপতি জীন ল'  এবং পাটনার নায়েব নাজিম রামনারায়ণের সঙ্গে মিলিত হয়ে তাঁদের সহায়তায় পুনরায় সৈন্য সংগ্রহ করে বহিঃশত্রু ইংরেজদের সঙ্গে লড়ে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। কিন্তু হায়, বিধি বাম! 

৩০ জুন ১৭৫৭ সাল, সিরাজ পলাতক অবস্থায় রাজমহল অতিক্রমকালে নদীপথে নতুন নবাব মীরজাফর বাহিনীর হাতে আটক হন। গোপনে কারারুদ্ধ অবস্থায় সিরাজকে মুর্শিদাবাদ এনে জাফরাগন্জ রাজপ্রাসাদের একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে বন্দী অবস্থায় রাখা হয়। দুরাত্মা মিরনের নির্দেশে মোহাম্মদী বেগ ২ জুলাই দিবাগত গভীর রাত্রে শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদদৌলাকে মর্মান্তিক ভাবে হত্যা করে।

অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় তার 'সিরাজউদ্দৌলা' গ্রন্থে লিখেছেন, 'সিরাজউদ্দৌল্লাকে নিহত করিবার জন্যই তাহাকে মীরণের তত্ত্বাবধানে জাফরাগন্জে কারারুদ্ধ করিতে হইল। কিন্তু হায়! যাহাকেই এই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করিবার জন্য আহ্বান করা হইল সেই শিহরিয়া উঠিতে লাগিল। কেউ সহজে সম্মত হইল না।...

এ জগতে কোনো কার্যই অসম্পূর্ণ থাকিয়া যায় না। সিরাজউদ- দৌলাকে বধ করিবার জন্যও অবশেষে একজন দুরাত্মা অর্থলোভী শানিত খরসান গ্রহণ করিল'। এরপর আবার ফিরে যাই অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়- এর হৃদয়বিদারক বর্ণনায়, 'মুর্শিদাবাদের নর-নারী এই রাজহত্যার আকষ্মিক সংবাদে হাহাকার করিয়া উঠিল। তাহাদিগের আকুল আর্তনাদ মুসলমানের উচ্চ অবরোধবেষ্টিত বেগম মহলে প্রবিষ্ট ও সিরাজ জননী আমিনা বেগমের কর্ণগোচর হইল। 

বিদ্রোহী দল তখন বিজয়োৎসবে উন্মত্ত হইয়া সিরাজের ক্ষত-বিক্ষত দেহ হস্তী পৃষ্ঠে সংস্থাপিত করিয়া নগর প্রদক্ষিণে বাহির হইয়াছিল। রাজপথ লোকে লোকারণ্য হইয়া গেল। সিরাজ জননী হাহাকার করিতে করিতে লজ্জা ভয় বিসর্জন দিয়া রাজপথে আসিয়া ধূলি বিলুন্ঠিত হইয়া পড়িলেন। তাহাকে দেখিয়া শবদেহ বহনকারী হস্তী সহসা রাজপথে বসিয়া পড়িল। স্নেহময়ী জননী সন্তানের মাংসপিণ্ড বুকে ধরিয়া মুর্ছান্বিত হইয়া পড়িলেন। মীরজাফরের অনুচর কদম হোসেন তখন নানারূপে তাড়না করিয়া সিরাজ জননী আমিনা বেগমকে পুনরায় অন্তঃপুরে কারারুদ্ধ করিয়া সিরাজের শবদেহ সমাধিস্থ করিবার জন্য ভাগিরথী পশ্চিম তীরবর্তী আলীবর্দীর সমাধি মন্দিরে উপনীত করিল।'

কমিটিকে সর্বপ্রকারে সাহায্য প্রদান করিয়া আমাদের জাতীয় বীরের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করিবার জন্য আমি জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকলের নিকট আবেদন জানাইতেছি। বিদেশির বন্ধন-শৃঙ্খল হইতে মুক্তিলাভের জন্য আজ আমরা সংগ্রামে রত। সিরাজ-উদ-দৌলাহ'র জীবনস্মৃতি হইতে যেন আজ আমরা অনুপ্রাণিত হই--- ইহাই আমার প্রার্থনা।' কবি কাজী নজরুল ইসলাম

অথচ নবাব সিরাজউদদৌলা চরম বিপদের মুহূর্তেও কারোর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি আবার কারো প্রতি প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেন নাই। এ সবই ছিল নবাবের উদারতা। বরং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় শাহাদত বরণ করে নবাব হিসেবে নিজের নাম ইতিহাসে চিরস্থায়ী করে গেছেন। ব্যক্তিগত স্বার্থ অপেক্ষা বাংলার মর্যাদা ও স্বাধীনতা রক্ষা করাই ছিল তার প্রধান উদ্দেশ্য।

সিরাজ স্মৃতি উদযাপনের আবেদন জাতীয় কবির  

এই ইতিহাস নাড়া দিয়েছিল বিদ্রোহী বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুলকেও। তাই তিনি সিরাজ স্মৃতি উদযাপনের ডাক দিয়েছিলেন দৈনিক 'আজাদ' পত্রিকার মাধ্যমে, ২৯ জুন ১৯৩৯ সালে। সেখানে কবি লিখেন, হিন্দু-মুসলমানের প্রিয় মাতৃভূমির জন্য নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাহ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। সর্বোপরি বাংলার মর্যাদাকে তিনি ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরিয়াছেন এবং বিদেশি শোষণের কবল হইতে দেশকে রক্ষা করিবার জন্য আপনার জীবন যৌবনকে কোরবানি করিয়া গিয়াছেন।

মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ

মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ-র নেতৃত্বে কলিকাতার সিরাজ-উদ-দৌলাহ স্মৃতি কমিটি উক্ত অনুষ্ঠানকে সাফল্যমণ্ডিত করিবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করিতেছেন। কলিকাতা কমিটিকে সর্বপ্রকারে সাহায্য প্রদান করিয়া আমাদের জাতীয় বীরের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করিবার জন্য আমি জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকলের নিকট আবেদন জানাইতেছি। বিদেশির বন্ধন-শৃঙ্খল হইতে মুক্তিলাভের জন্য আজ আমরা সংগ্রামে রত। সিরাজ-উদ-দৌলাহ'র জীবনস্মৃতি হইতে যেন আজ আমরা অনুপ্রাণিত হই--- ইহাই আমার প্রার্থনা।'

নবাব সিরাজ-উদ- দৌলার প্রয়াণ দিবস উদযাপন 

উল্লেখ্য মুর্শিদাবাদের খোশবাগে কবিতায়, গানে, আলোচনার মধ্য দিয়ে পালিত হল নবাব সিরাজ-উদ- দৌলার প্রয়াণ দিবস। বীর শহিদের কবরে ফুল রেখে শ্রদ্ধা জানান রাজ্য সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়্যারম্যান, 'পুবের কলম'-এর সম্পাদক আহমদ হাসান ইমরান।

খোশবাগে নবাব সিরাজের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন আহমদ হাসান ইমরান। রয়েছেন ছোটে রেজা আলি মির্জা, আলিমুজ্জমান প্রমুখ।

উপস্থিত ছিলেন ছোটে নবাব সৈয়দ রেজা আলি মির্জা, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাহ্ স্মরণ সমিতির সম্পাদক বিপ্লব বিশ্বাস, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সনৎ কর, প্রাবন্ধিক আলিমুজ্জমান, মুর্শিদাবাদ ডিস্ট্রিক্ট মাইনোরিটি অফিসার রেণুকা খাতুন, মুর্শিদাবাদের অতিরিক্ত জেলাশাসক শামসুর রহমান, কবি কাজী নজরুল গবেষক সোমঋতা মল্লিক, অনল আবেদিন, নজরুল ইসলাম, কাজী আমিনুল ইসলাম, হাসিবুর রহমান, বিশ্বকোষ পরিষদের মুর্শিদাবাদ জেলা সম্পাদক জাহাঙ্গির আলি, আবুল হাসনাত প্রমুখ।

Comments