অনুভবের যৎসামান্য- ২২

সরলতা ও বিস্ময়ের খোঁজে 

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ লেখকদের একজন লিও তলস্তয়। তার ব্যাখ্যাটা লক্ষ করুন প্রিয় পাঠক। তিনি নাকি প্রথম পাঠে এন্ডারসনের লেখা বুঝতেই পারেননি!

বড় হয়ে যাওয়ার মধ্যে একটা দুঃখবোধ আছে -- এরকম একটা পঙক্তি পড়েছিলাম কোনো এক গল্পে। কিছুতেই মনে করতে পারছি না, কোন গল্প ছিল সেটি। কী সেই দুঃখবোধ তা লেখা ছিল না গল্পে, কিন্তু কথাটা আমাকে খুব স্পর্শ করেছিল। নিজের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল, এই দুঃখবোধের কারণ-- বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা অনেক কিছু হারাই, তার মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো সরলতা এবং বিস্ময়বোধ। আর এই দুই সম্পদ হারানোর ফলে হারাই শর্তহীন ভালোবাসার অনিঃশেষ ক্ষমতাও। মনে হয়েছিল, সরলতা-বিস্ময়বোধ-ভালোবাসা এই ব্যাপারগুলো বোধহয় পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।

লক্ষ করলে দেখবেন, শিশুরা খুব অল্পতেই বিস্মিত হয়। প্রথমবারের মতো যা-কিছু দেখে তারা, তা যত সামান্যই হোক, গভীর বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। একটা নতুন খেলনা দেখলে যেমন বিস্মিত হয়, একটা পাখি দেখলেও হয়। জীবজগৎই হোক আর জড়জগৎই হোক, ফড়িঙের মতো ছোট্ট পতঙ্গই হোক আর হাতির মতো বিশাল প্রাণীই হোক, সবই তাদের বিস্মিত করে। এই বিস্ময় আসে অকৃত্রিম সরলতা থেকে। জীবনের গভীর সংকট তাদের গ্রাস করেনি, ক্লেদ-গ্লানি-ঘৃণা-বিদ্বেষ তাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি, শুভ্র-সুন্দর-আলোকোজ্জ্বল হৃদয়ের অধিকারী তারা, সরলতাই তো থাকবে সেখানে।  

শিশুদের পছন্দ-অপছন্দ খুব তীব্র, সেগুলোর প্রকাশও খুব তীব্র। যাকে তারা ভালোবাসে, সেটি সাড়ম্বরে জানিয়ে দিতে এতটুকু কার্পণ্য করে না। আবার, যাকে অপছন্দ করে তার ধারেকাছেও ভিড়তে চায় না। প্রকাশের এই ধরনটাও সরলতার ফল। আমরা বড় হয়ে যাওয়ার পর তো এভাবে প্রকাশ করতে পারি না। অপছন্দ তো লুকিয়ে রাখিই, ভালোবাসাও প্রকাশ করি হিসাব করে, ভেবেচিন্তে, সীমিত আকারে। শিশুদের এই ভালোবাসা কেবল মানুষের জন্যই নয়। সমস্ত পশুপাখি-কীটপতঙ্গের জন্যও। এমনকি তাদের খেলনার জন্যও। একটু লক্ষ করলে দেখবেন, শিশুরা তাদের খেলনাগুলোকে ভীষণ আদর করে। রীতিমতো হাত বুলিয়ে, কোলে নিয়ে, জড়িয়ে ধরে, চুমু দিয়ে আদর। শুধু তাই নয়, যখন ওরা খেলনা দিয়ে খেলে তখন ক্রমাগত ওগুলোর সঙ্গে কথা বলে। 

কান পেতে শুনলে বোঝা যায়, কথাবার্তাগুলো একতরফা নয়। শিশুটি হয়তো একটা প্রশ্ন করে, এরপর একটু বিরতি নেয়, তারপর আরেকটি প্রশ্ন করে। দ্বিতীয় প্রশ্নটি শুনলে মনে হয়, প্রথম প্রশ্নের উত্তরে খেলনাটি কিছু একটা বলেছে, সেই ধারাবাহিকতায় এসেছে দ্বিতীয় প্রশ্নটি। আমার মাঝেমধ্যে ভীষণ কৌতূহল হয়, ইচ্ছে হয় জিজ্ঞেস করি-- কী বললো তোমার খেলনাটি? কিন্তু জিজ্ঞেস করলে উত্তর তো মেলেই না, উল্টো থেমে যায় ওদের কথোপকথন। আমি তাই গভীর আগ্রহ নিয়ে, নীরবে, ওই কথাগুলো শুনি। বলাবাহুল্য, শুনি কেবল শিশুটির কথাই, খেলনার কথা শোনে কেবল সেই শিশুটি। ভাবি, কতটা সরল হলে একটা জড়বস্তুর সঙ্গে কথা বলা যায়? আমরা, বড়রা, কেন সেটি পারি না? আমাদেরও অনেক প্রিয় বস্তু থাকে। যেমন নিত্যসহচর ফোন, কলম, পানির গ্লাস বা চায়ের কাপ! কখনো তো ওদের জিজ্ঞেস করি না, কেমন আছ, কী খেয়েছ! কখনো তো হাত বুলিয়ে আদর করি না!

রূপকথায় কিংবা ছোটদের জন্য লেখা গল্পে সব বস্তুই কথা বলে, কথা বলে সব প্রাণীও। যেন এক অবারিত ভাষার জগৎ। এবং শিশুরা অবলীলায় তা বিশ্বাসও করে। রূপকথার রচয়িতা কে বা কারা জানার উপায় নেই। যেমন আমাদের ঠাকুরমার ঝুলি। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র সেগুলোর সংকলন ও সম্পাদনা করেছিলেন, রচনা করেননি। এরকম রূপকথা কিন্তু সকল দেশেই আছে, এবং সব দেশেই রচয়িতার নাম অজানা। হয়তো এগুলো একজনের সৃষ্টি নয়ও। দীর্ঘকাল ধরে লোকমুখে সেগুলো রচিত এবং বিবর্তিত হয়েছে। রচয়িতা যাঁরাই হন না কেন, তাঁরা যে শিশুদেরকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং তাদের মনস্তত্ত্ব বুঝতেন তার প্রমাণ এই সবকিছুকে কথা বলানোর মধ্যে লুকিয়ে আছে। শিশুরা যেমনটি ভাবে, হয়তো তারাও ভেবেছেন, ভাষা কেবল মানুষেরই থাকবে কেন, অন্য প্রাণীরা কী দোষ করলো? এই নীল গ্রহ তো কেবল মানুষের নয়। অন্য সব পশুপাখি এবং কীটপতঙ্গেরও, এমনকি বৃক্ষদেরও। এই ব্যাপারটি যে শিশুরাই সবচেয়ে ভালো বোঝে, সেটা বোঝা যায় তাদের আচরণ দেখলে। সবকিছুর জন্য তাদের অপার ভালোবাসা, পশুপাখি তো বটেই এমনকি একটা ছোট্ট ফড়িঙ বা প্রজাপতির কষ্টে তাদের চোখে জল আসে। সম্ভবত শিশুদের জন্য যারা কালজয়ী লেখা লেখেন, তাঁদের অনুভূতিও একইরকম। 

এ প্রসঙ্গে তলস্তয়ের একটা কথা মনে পড়লো। ম্যাক্সিম গোর্কির একটা স্মৃতিগদ্যের বই আছে তলস্তয়কে নিয়ে, Reminiscences of Leo Nikolaevich Tolstoy শিরোনামে। সেখানেই এই প্রসঙ্গটি আছে। হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসন প্রচুর রূপকথা লিখেছেন, বিশ্বব্যাপি সেসব অনূদিত এবং জনপ্রিয় হয়েছে। রুশ ভাষায় অনূদিত হওয়ার পর তলস্তয়ও পড়েছিলেন। কিন্তু প্রথমবার তিনি নাকি কিছু বুঝতে পারেননি! বছর দশেক পর দ্বিতীয় পাঠের পর তিনি উপলব্ধি করেন, এন্ডারসন খুব নিঃসঙ্গ ছিলেন এবং সম্ভবত ভবঘুরেও ছিলেন, ঘর-সংসার বলতে তাঁর কিছু ছিল না। সেজন্যই তিনি শিশুদের সঙ্গে মিশতে চাইতেন, কথা বলতে চাইতেন। 

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ লেখকদের একজন লিও তলস্তয়। তাঁর ব্যাখ্যাটা লক্ষ করুন প্রিয় পাঠক। তিনি নাকি প্রথম পাঠে এন্ডারসনের লেখা বুঝতেই পারেননি! অবাক লাগে না কথাটা শুনে? রূপকথা বুঝতে না পারার কী হলো? এসব তো নিছকই উদ্ভট গল্প, শিশুদের আনন্দ দেওয়ার জন্য আর কল্পনাকে উসকে দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়। তলস্তয় কি তা বুঝতেন না? নিশ্চয়ই বুঝতেন। তাঁর দেশেও তো রূপকথা কিছু কম ছিল না। 'রুশদেশের উপকথা' নামের সেই অপূর্ব বইটির গল্পগুলোর কথা নিশ্চয়ই আমরা ভুলে যাইনি!

তাহলে তলস্তয় কী খুঁজেছিলেন লেখাগুলোর মধ্যে? আমার ধারণা, লেখাগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থ আর এগুলো লিখবার কারণ। ছোটদের জন্য লেখা সব রচনারই দুটো উদ্দেশ্য থাকে। একটি শিশুদের আনন্দের জন্য, অপরটি বড়দের ছোটবেলায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। যাহোক, তলস্তয় দ্বিতীয় পাঠে বুঝেছিলেন, এন্ডারসন নিঃসঙ্গ ছিলেন বলেই শিশুদের কাছে যেতেন। এই পর্যবেক্ষণটা গুরুত্বপূর্ণ। নিঃসঙ্গ মানুষ তো তার জন্য সমবয়সী-সমমনা একজন যোগ্য সঙ্গী চায়, এন্ডারসন কেন শিশুদের কাছে যেতেন? ধারণা করি, যেতেন সরলতার সন্ধানে, বিস্ময়বোধের সন্ধানে, যা তিনি নিজে হারিয়ে ফেলেছিলেন। নিশ্চয়ই সেসবের সন্ধান তিনি পেয়েছিলেন ফের, নইলে ওসব তিনি লিখলেন কী করে?

বয়স বাড়ার সঙ্গে জটিলতা 'অর্জন' করে মানুষ, হারাতে থাকে সরলতা। আবার সেই সরলতা ফিরেও পেতে পারে কেউ কেউ। কীভাবে? যদি আপনি বিস্মিত হবার ক্ষমতা হারিয়ে না ফেলেন এবং বিস্ময়বোধ ফিরে পান। 

যাহোক, আমরা বড় হতে থাকি, প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের বিচ্ছেদ ঘটতে থাকে, আমরা ভুলেই যাই যে আমরা প্রকৃতিরই অংশ। প্রকৃতিপ্রদত্ত মায়া-মমতা-ভালোবাসা-সরলতা-বিস্ময়বোধের সঙ্গেও আমাদের বিচ্ছেদ ঘটতে থাকে। প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ হারাতে হারাতে আমরা ক্রমশ মানুষের নির্মিত সমাজ-সংস্কৃতি-ধর্ম-সভ্যতার ভেতর প্রবেশ করতে থাকি আর আমাদের ভেতরে প্রবেশ করতে থাকে হিংসা-বিদ্বেষ-ক্রোধ-লোভ-ঘৃণা। মায়া-মমতা-ভালোবাসার মতো এগুলোও মানবিক অনুভূতি। কিন্তু দুরকম অনুভূতির ফলাফল এক নয়। প্রথমটি হৃদয়কে শুদ্ধ ও পবিত্র আর আর্দ্র করে, দ্বিতীয়টি হৃদয়কে কালিমালিপ্ত করে। আমরা সরলতা হারাই, বিস্ময়বোধ হারাই, হারাই ভালোবাসার অনিঃশেষ ক্ষমতা; হয়ে উঠি অসহিষ্ণু-অসহনশীল-অবিবেচক-নিষ্ঠুর-নির্মম-প্রেমহীন। 

একসময় আমরা হয়তো ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে সরল হয়ে উঠতে চাই, কারণ আমরা অনুভব করে উঠতে পারি -- সরলতাই সবচেয়ে সুন্দর। কিন্তু সরল হওয়াটা কঠিন, হতে চাইলেই হওয়া যায় না। কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। সকল মানুষই সরল হয়ে জন্মায়, সেটি বোঝা যায় শিশুদের দিকে তাকালেই। তাদের চিন্তার জগৎটি কী আশ্চর্য সরল ও সুন্দর! তারপর বয়স বাড়ার সঙ্গে জটিলতা 'অর্জন' করে মানুষ, হারাতে থাকে সরলতা। আবার সেই সরলতা ফিরেও পেতে পারে কেউ কেউ। কীভাবে? যদি আপনি বিস্মিত হবার ক্ষমতা হারিয়ে না ফেলেন এবং বিস্ময়বোধ ফিরে পান। 

কিন্তু বিস্মিত হবো কীভাবে? আমাদের চারপাশে, প্রকৃতিতে, বিস্মিত হবার মতো বহুকিছু ছড়িয়ে আছে, সেগুলো দেখে। দু-একটা উদাহরণ দিই। পানি তো আমাদের কাছে কেবল পানিই। খুবই সাধারণ, সহজলভ্য এবং নিত্য-ব্যবহার্য। এত সহজলভ্য বলেই আমাদের মধ্যে এ নিয়ে কোনো বিস্ময়বোধ নেই। আমরা পানির আণবিক গঠনও জানি। দুই অণু হাইড্রোজেন আর এক অণু অক্সিজেন মিলে তৈরি করে এক অণু পানি। এই বৈজ্ঞানিক তথ্যও আমাদের বিস্মিত করে না। কিন্তু আরেকটু গভীরভাবে ভেবে দেখুন। হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন দুটোই গ্যাস। হাইড্রোজেন কিন্তু দাহ্য, মানে একটা স্ফুলিঙ্গের স্পর্শ পেলেও জ্বলে ওঠে। এটি তাই জ্বালানিরও প্রধান উৎস। 

অন্যদিকে অক্সিজেন নিজে দাহ্য নয়, অর্থাৎ নিজে জ্বলে না, কিন্তু অন্য পদার্থকে দ্রুত জ্বলে উঠতে এবং পুড়ে যেতে সাহায্য করে। অর্থাৎ একজন জ্বলতে চায়, আরেকজন জ্বালাতে চায়। তো, এই দুটো গ্যাসকে মিলিয়ে দিলে কী হবে? আগুন জ্বলে উঠবে বলে মনে হয় না? অথচ তারা যখন একটা নির্দিষ্ট অনুপাতে মিলিত হয় (দুই অণু হাইড্রোজেন আর এক অণু অক্সিজেন), তখন জ্বলে ওঠার বদলে পরিণত হয় পানিতে, যা আবার আগুন নেভানোর কাজে লাগে। কী অবাক ব্যাপার, তাই না? পানিই তো সবচেয়ে আশ্চর্য সৃষ্টি, প্রকৃতির অপার করুণাধারা। পানি ছাড়া জীবনের জন্ম এবং টিকে থাকা কোনোটাই সম্ভব হতো না। এই সত্যটি জানার পরও যদি আপনার ভেতরে অপার বিস্ময় জেগে না ওঠে তাহলে বুঝতে হবে, আপনি সরলতার পথ থেকে বহুদূরে আছেন।

আরেকটি উদাহরণ দিই। আমরা নিঃশ্বাসের সঙ্গে যে গ্যাস গ্রহণ করি সেটিও অক্সিজেনই। আমাদের বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ প্রায় শতকরা ২১ ভাগ (বাকিটাও অন্যান্য গ্যাস)। এই ২১ ভাগ অক্সিজেন কিন্তু সবার জন্যই। আপনি যে জাতিরই হন না কেন, যে ভাষারই হন না কেন, যে ধর্মেরই হন না কেন, বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী যা-ই হন না কেন, সবার জন্য পরিমাণ একই। কমও নয়, বেশিও নয়। এমনকি সকল পশুপাখি-কীটপতঙ্গের জন্যও তাই। তারাও নিঃশ্বাসের সঙ্গে অক্সিজেনই গ্রহণ করে। তাদের জন্যও কম-বেশি নেই। এইসব নিদর্শন দিয়ে প্রকৃতি আমাদের কী ইঙ্গিত দেয়?

আমার মনে হয়, সে বলতে চায়-- তার সকল ঐশ্বর্য, সকল সৃষ্টি, সকল মমতা সবার জন্যই সমানভাবে বরাদ্দ। তাহলে

কিসের ভিত্তিতে আপনি নিজেকে শ্রেষ্ঠ দাবি করেন? আপনার জাতির অহমবোধ, ধর্মের অহমবোধ, ভাষার অহমবোধ, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের অহমবোধ, জানা-বোঝা-জ্ঞানের অহমবোধ কি মিলিয়ে যাবে না, যখন আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন যে, প্রকৃতির ঐশ্বর্য সকলের জন্যই সমান?

অনেকেই আবার প্রকৃতি শব্দটি পছন্দ করেন না। ঠিক আছে, আপনি আপনার স্রষ্টার কথাই ভাবুন। যে ধর্মেরই হন না কেন, ভাবুন যে, আপনার আল্লাহ/ঈশ্বর/ভগবান/খোদা/প্রভু, সেই মহান স্রষ্টা, যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তা সকলের জন্য সমানভাবে বন্টন করেছেন। এমনকি যারা তাকে অস্বীকার বা অবিশ্বাস করে তাদের কাছ থেকেও তিনি তার সৃষ্টিজগতের অপার ঐশ্বর্য ছিনিয়ে নিচ্ছেন না। তিনি করুণাময়, তিনি দয়ালু, তিনি এক গ্র্যান্ড ডিজাইনার, এবং তিনি সকলের। সব ধর্মের, সব বর্ণের, সব জাতির মানুষের জন্য তাঁর অপার সৃষ্টিসুধা সমভাবে বন্টিত। এমনকি সকল পশুপাখি-কীটপতঙ্গ-বৃক্ষরাজির জন্যও তাই। তিনি যদি এমনটি করতে পারেন, তাহলে আমরা কেন এত বিভাজন সৃষ্টি করি? কেন নিজের বিশ্বাসকেই শ্রেষ্ঠ ভাবি, অন্যদেরকে ভাবি ভুল?    

প্রকৃতির এইসব বিস্ময় আমাদের নত ও বিনয়ী হতে সাহায্য করে, সহিষ্ণু ও সহনশীল হতে সাহায্য আরে। কেবল তাই নয়, প্রকৃতির ইঙ্গিত-ইশারা-ঐশ্বর্য দেখে একবার বিস্মিত হলে সে বারবার বিস্মিত হবার সুযোগ করে দেয়। আর বিস্মিত হতে হতে আমরা ফের ফিরে পাই সরলতা। আমাদের হৃদয় তখন শিশুদের হৃদয়ের মতো কোমল মায়াবী আলোয় ভরে ওঠে। আমরা তখন উপলব্ধি করতে পারি, এই নীল গ্রহ কেবল মানুষের নয়। অন্য সব পশুপাখি এবং কীটপতঙ্গেরও, এমনকি বৃক্ষদেরও।

এদের অনেকের স্বল্পদৈর্ঘ্যের জীবন, অনেকের আবার দীর্ঘ জীবন। কিন্তু জীবনের দৈর্ঘ্য যেমনই হোক না কেন, এরা প্রায় সবাই পূর্ণাঙ্গ জীবন কাটায়। সম্ভবত কোনো খেদ নিয়ে মরে না ওরা। কেবল মানুষের খেদ থাকে, জীবন অসম্পূর্ণ বলে মনে হয় তার। এর কারণ সম্ভবত এই যে, মানুষ ছাড়া অন্য সবাই প্রকৃতির নির্বাচিত জীবন-প্রণালি মেনে চলে, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সবকিছু।

মানুষের তৈরি সভ্যতার সঙ্গে আমাদের জীবন এমনভাবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেছে যে চাইলেও আর পুরোপুরি প্রাকৃতিক জীবন যাপন করা সম্ভব নয়। তবু, বড় হয়ে যাওয়ার পরও যদি সরলতার দেখা পেতে চাই আমরা, যদি বিস্মিত হতে চাই, যদি চাই জীবনের পূর্ণতা তাহলে প্রকৃতির কাছে যাওয়া ছাড়া, প্রকৃতিকে বোঝার চেষ্টা ছাড়া, আমাদের ভিন্ন কোনো পথ খোলা নেই।

Comments