আহমদ শরীফের পারিবারিক জীবন
১৯৯৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে কয়েকবার লুজ মোশন, এরপর স্ট্রোক। তারপরও দোতলা থেকে সিঁড়ি ভেঙে গিয়েই ক্লিনিকমুখো গাড়িতে উঠে বসেছিলেন ৭৮ বছরের বিশালদেহী আহমদ শরীফ। রাত তখন ১টা ৪০ মিনিট। চিরপ্রস্থান ঘটে অনন্য মনীষী, শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ আহমদ শরীফের।
স্বভাবতই ২৪ ফেব্রুয়ারির খবরের কাগজে আহমদ শরীফের মৃত্যুর খবর প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। তবে ওই দিন প্রভাতে বিবিসি বাংলা ও বাংলাদেশ বেতারে খবরটি প্রচারিত হয়। হাজারো ছাত্র-ছাত্রী, সহকর্মী, সুহৃদ-বন্ধুর মাধ্যমে খবরটি ছড়িয়ে পড়ে মুহূর্তেই।
জীবনের প্রায় শেষ দিন পর্যন্ত লিখে গেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এই অধ্যাপক। হাতের লেখা ছিল আলাদা এক সুর। তখন (১৯৯৮) আজকের কাগজ পত্রিকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করি। কাজের ফাঁকে গিয়ে বসি সম্পাদকীয় বিভাগের সালাম সালেহ্উদ্দিনের দপ্তরে। তার টেবিলে প্রথম দেখি আহমদ শরীফের কলামের মূল কপি। তখন ওই পত্রিকাটিতে নিয়মিত লিখতেন। হাতেই লিখতেন। বাক্যের মাঝে হাইফেন, ড্যাশ ও কমা ব্যবহার করতেন। এতে বাক্য বড় হলেও পড়তে আলাদা রকমের আনন্দ ছিল।
আহমদ শরীফের জন্মও এই ফেব্রুয়ারি মাসে—১৯২১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি, চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার সুচক্রদণ্ডী গ্রামে। তার পরিবারে শিক্ষাদীক্ষা শুরু হয় উনিশ শতকেই। এ দেশের পুঁথি সাহিত্যের নামী গবেষক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ তাঁরই চাচা ছিলেন। পটিয়া হাইস্কুল, চট্টগ্রাম কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার আগে ছয় বছর সরকারের দুর্নীতি দমন বিভাগ, লাকসাম ও ফেনীর দুটি কলেজে চাকরি করেন আহমদ শরীফ। কিছুদিন কাজ করেছেন রেডিও পাকিস্তানে প্রযোজক হিসেবে। মধ্যযুগের কবি সৈয়দ সুলতানের ওপর গবেষণা করে ১৯৬৭ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৭২ সালে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্যকালের বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান, কলা অনুষদের ডিন, সিন্ডিকেট সদস্য এবং শিক্ষক সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সুদীর্ঘ ৩৩ বছর অধ্যাপনা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৩ সালের ৩০ জুন অবসর গ্রহণ করেন। পরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছরের জন্য নজরুল অধ্যাপক পদে সমাসীন ছিলেন। অধ্যাপক শরীফের মৃত্যুর দুই বছরের মাথায় বেরিয়েছিল একটি বই—আহমদ শরীফ শ্রদ্ধাঞ্জলি। স্বদেশ চিন্তা সংঘের উদ্যোগে বইটি প্রকাশ করেছিল অনন্যা। বইটির সম্পাদনা পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক।
এই বইয়ে মূলত কাছের মানুষেরাই তার স্মৃতিচারণা ও মূল্যায়ন করেন। এই বইয়ে একটি নিবন্ধ আছে, যেটি লিখেছেন তারই পুত্রবধূ রহিমা নেহাল। 'অধ্যাপক আহমদ শরীফ: তার ব্যক্তিজীবন' শিরোনামে এই লেখা যেন একজন বড় মানুষের সাদাসিধে জীবনের প্রতিচ্ছবি। এই মানুষটির অন্তর্জগৎ বুঝতে এই লেখা অনন্য।
কেমন ছিলেন আহমদ শরীফ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিতে যোগদান থেকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত প্রায় ৪৯ বছরে আহমদ শরীফ পর্যায়ক্রমে তিনটি বাড়িতে থেকেছেন। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকার ৩৭/সি ভবন, এরপর নিউ ইস্কাটনের ১২৫ নম্বর বাসা, পরে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার ১ নম্বর সড়কের ২৫/বি বাড়ি। ১৯৭৯ সালের ৫ অক্টোবর আহমদ শরীফের দ্বিতীয় পুত্রবধূ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাড়িতে আসেন এই প্রবন্ধের লেখিকা রহিমা নেহাল। মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিন সন্তান, তিন পুত্রবধূ ও চার নাতি নিয়ে যৌথ পরিবারে বাস করতেন আহমদ শরীফ। এ যুগে কেউ এমন কল্পনাও করতে পারবে না, এ কথা উল্লেখ করে রহিমা নেহাল লিখেছেন, 'শুধুমাত্র প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী হবার কারণে এই চারটি পরিবার সহাবস্থান করতে পেরেছে।'
প্রতিদিন ভোট পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে দুই গ্লাস পানি খেয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হাঁটতে যেতেন তিনি। ৬টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত হাঁটতেন। ১৯৬৭ সাল থেকেই বহুমূত্র রোগে ভুগছিলেন তিনি। প্রাতর্ভ্রমণ থেকে ফিরে এসে চা–বিস্কুট খেতে খেতে বিবিসি শুনতেন। এরপর বাংলাদেশ বেতার ও আকাশবাণী কলকাতার খবর শুনে স্নান করতে যেতেন। স্নান সেরে পড়ার টেবিলে বসতেন। হয় লিখতেন, না হয় পড়তেন। সকাল আটটায় দিল্লির বাংলা সংবাদ শুনে সোয়া আটটা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত শুনতেন রবীন্দ্রসংগীত। এ সময়ে খবরের কাগজ ও নাশতা তাঁর টেবিলে পৌঁছে যেত। টেবিল থেকে উঠে সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেন।
ক্লাস নিয়ে পৌনে দুইটার দিকে বাসায় ফিরতেন। আকাশবাণী রেডিওর বেলা দুইটার সংবাদ শুনতে শুনতে দুপুরের খাওয়া সেরে নিতেন। রহিমা নেহাল লিখেছেন, 'আব্বা সারা দিনে শুধু একবারই খাওয়ার টেবিলে আসতেন, সেটা হলো দুপুরবেলায় ঠিক দুইটার সময়। টেবিলে আব্বা, তার সন্তানেরা, আমরা তিন জা বসতাম। একসাথে খাওয়া ছাড়া ওই সময়টাতে সমাজ, দেশ, রাজনীতি, সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা হতো। সকলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তা প্রায় ৫০ মিনিট স্থায়ী হতো। এই সময়টা আমরা সবাই উপভোগ করতাম।'
দুপুরের খাওয়ার পর আহমদ শরীফ ঘুমিয়ে পড়তেন, যা নিয়মিতই ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো সভা থাকলে একটু বিশ্রাম নিয়ে উঠে পড়তেন। সভা শেষে বিকেলে কলাভবনে হাঁটাহাটি করতেন। সন্ধ্যার পরে ফুলার রোডের বিখ্যাত গুঁড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গে দেশকাল, সমাজ নিয়ে গল্পগুজব করতেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত এই 'গুঁড়ি আড্ডা' চালু ছিল।
গুঁড়ি আড্ডা থেকে বাসায় ফিরে টিভিতে বাংলা সংবাদ দেখতে দেখতে রাতের আহার করতেন আহমদ শরীফ। এরপর রাত ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত পড়তেন, লিখতেন, না হয় পরীক্ষার খাতা দেখতেন। এই সময় অনেকেই তার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। যাঁরা আসতেন, তারা জানতেন এই সময় তাঁকে নিরিবিলি পাওয়া যাবে। রাত ১১টার সময় ঘুমাতে যেতেন তিনি।
দিনের বেলা বাসায় হুঁকো টানতেন। বাসার বাইরে সিগারেট খেতেন। এই হলো মোটাদাগে তাঁর প্রাত্যহিক দিনলিপি।
এই দিনলিপির ছন্দপতন ঘটে ১৯৮৪ সালে নিউ ইস্কাটন রোডের বাসায় যাওয়ার পর। এই সময় তিনি সকালে নয়, দুপুরের পর হাঁটতে বেরোতেন। প্রতিদিনই জনা চল্লিশেক সঙ্গী জুটে যেত। ১৯৮৮ সালে ধানমন্ডির বাসায় আসেন আহমদ শরীফ। রহিমা নেহাল লিখেছেন, নিউ ইস্কাটনের বাসার তুলনায় ধানমন্ডির বাসায় একটু বেশি সপ্রতিভ ছিলেন তার শ্বশুরমশাই। প্রতি শুক্রবার সকালে এই বাসায় আড্ডা বসত।
নিজে কিছু কিনতেন না
ঘরে সব সময় পায়জামা-পাঞ্জাবি পরতেন অধ্যাপক আহমদ শরীফ। কিন্তু ঘরের বাইরে সুট বা শার্ট-প্যান্ট পরতেন। তিন সন্তানকেও তিনি ঘরে পায়জামা পরানোর অভ্যাস করিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন উদার মনের মানুষ। আর্থিকভাবে অসচ্ছল, পরিচিত–অপরিচিত আত্মীয়স্বজনকে তিনি সাধ্যমতো সাহায্য করতেন। এই প্রবন্ধের এক জায়গায় রহিমা নেহাল লিখেছেন, 'তিনি বা তাঁর সন্তানেরা কেউ ধর্মকর্ম না করলেও বাসায় আমার শাশুড়ি, আমরা তিন জা, বাড়ির কাজের সহযোগীরা রোজা, নামাজ প্রতিবছরই করে আসছিলাম। আব্বার দর্শন ছিল কারও ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করা, এবং যার যার বিশ্বাসমতো চলা।'
আহমদ শরীফ নিজে কখনো বাজার করতে যেতেন না। এমনকি নিজের কোনো পোশাক বা কারও জন্য কিছু কিনতেও যেতেন না। এই বিষয়টা রহিমা নেহালকে অবাক করেছিল। আহমদ শরীফের কাপড়চোপড় সব কিনতেন তাঁর স্ত্রী আর বাজারসদাই করতেন পুত্রবধূরা। উৎসব ছাড়া কোনো আত্মীয়স্বজনের বাসায় সাধারণত যেতেন না আহমদ শরীফ। একাধিক আমন্ত্রণ পেয়েও যুক্তরাষ্ট্রে যাননি তিনি। তার যুক্তি ছিল, 'যাদের সমালোচনা করি, অপছন্দ করি, তাদের অনুষ্ঠানে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে নিজের বিবেকের সঙ্গে, আদর্শের সঙ্গে প্রতারণা করা।'
অধ্যাপক শরীফ তাঁর তিন সন্তান, তিন পুত্রবধূ, চার নাতি নিয়ে যৌথ পরিবারে বসবাস করতেন, এ কথা আমরা ইতিপূর্বে লিখেছি। কিন্তু খোরাকি বাবদ একটা পয়সাও তিনি সন্তানদের কাছ থেকে নিতেন না। টেলিফোন, বিদ্যুৎ, পানি, সবকিছুর ব্যয় তিনি নিজে বহন করতেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর যুক্তি ছিল, খোরাকি নিলে বিশেষ করে খাওয়া নিয়ে সন্তান এবং তাদের স্ত্রীদের দাবি থেকে যাবে। মাছ বা মাংসের ভালো অংশটি তারা চেয়ে বসবে। তখন আর একসঙ্গে থাকা–খাওয়া সম্ভব হবে না। তিনি মনে করতেন, সন্তানদের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা না নিলে এমন কোনো দাবি উত্থাপিত হবে না।
প্রসঙ্গে নেহাল রহিম লিখেছেন, 'বাবার বিশাল ব্যক্তিত্ব, আত্মসম্মানবোধ, সহনশীলতার দ্বারা আমাদের সকলকে একই ছাদের নিচে, একই পাকে খাওয়াতে এবং রাখতে পেরেছিলেন; নয়তো সহাবস্থান অসম্ভব ছিল।'
Comments