নজরুল-পূর্ব প্রথম বিদ্রোহী মাইকেল
মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্ম ও মৃত্যু ব্রিটিশ-ঔপনিবেশিক সময়ে। এই বাস্তবতায় সাহিত্য- রুচি-সংস্কৃতি আর আধিপত্য তাঁর চিন্তার শক্তি যুগিয়েছিলো। তার সমসাময়িক বা সামান্য আগের ইউরোপীয় কবিদের তালিকা করলে একটা বিষয় চোখে পড়ে।
উদাহরণ হিসেবে শার্ল বোদলেয়ার, আর্তুর র্যাবো, মালার্মে কিংবা ইংরেজি সাহিত্যের বিখ্যাত রোমান্টিকরা পিবি শেলী জন কীটস ব্রাউনিং এর নাম নেওয়া যেতে পারে। এঁদের মধ্যে ফরাসিরা বাংলা কবিতায় রবীন্দ্র পরবর্তী আধুনিক বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্তদের প্রভাবিত করেছেন। ইংরেজির সাহিত্যের 'দুকুলপ্লাবি' রোমান্টিকেরা রবীন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করলেও মাইকেল এঁদের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন বলে জানা যায় না।
মাইকেলের যে বছর জন্ম বায়রনের সে বছর মৃত্যু হয়। বায়রন মাইকেলের প্রিয় কবি ছিলেন। অথচ সেকালে অন্য রোমান্টিকদের প্রতি তাঁর আগ্রহের কথা শোনা যায় না। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত 'কাব্যের মুক্তি' প্রবন্ধে 'বিশ্বভ্রমাণ্ড' ঘুরে ঘুরে বীজ সংগ্রহের করে 'কবিতার কল্পতরু' জন্মানোর কথা বলেছেন। তিনি মনে করতেন, বিশ্বভ্রমাণ্ড ঘুরে ঘুরে বীজ সংগ্রহ না করলে কবিতার কল্পতরু জন্মাবে না। এটাকে তিনি আধুনিকতার শর্ত মেনেছেন। সে প্রবন্ধটিতে আধুনিক হবার জন্যে আর যা যা হতে হবে বলেছেন তার কিছুই মাইকেলে পাওয়া যায় না, পাওয়ার কথাও নয়। তবে এ প্রবন্ধটিকে বাংলা কবিতার আধুনিকতার ম্যানিফেস্টো হিসেবে গ্রহণ করলে বলা যায় রবীন্দ্রনাথসহ মাইকেল কেউ আধুনিক নন। নীরদচন্দ্র চৌধুরী রবীন্দ্রনাথে আধুনিকতার চূড়ান্ত সমুন্নতি দেখেছেন।
তারপর অবক্ষয় হয়েছে বলে রায় দিয়েছেন। আনিসুজ্জামান বলেছেন ইংরেজের ইতিহাসের আদলে বাংলার সাহিত্যের ইতিহাসের যুগবিভাগ হওয়ায় এটা ঠিক ঠিক খাপ খায় না বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে। সে হিসেবে আধুনিকতা নিজের পাকের মধ্যে ডুবে যাওয়া গোলমেলে বিষয়। মাইকেল তাঁর সময় ও জায়গার ইউরোপ থেকে বীজ সংগ্রহ করেননি।
মাইকেল বাংলা সাহিত্যে প্রথম আধূনিকের অভিধা পেলেও তিনি ইংরেজদের অনেক আগের সাহিত্য থেকে উপকরণ নিয়েছিলেন। ডেভিড লেস্টার রিচার্ডসনের সিলেকশনস ফ্রম দি ব্রিটিশ পোয়েটস গ্রন্থে চসার থেকে টেনিসন পর্যন্ত স্থান পেয়েছিলো। ছাত্রকালে তাঁর ইউরোপীয় সাহিত্যরুচি গড়ে তুলতে এ-সংকলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ-সংকলনে অব্রিটিশ ইউরোপীয় সাহিত্যিকদের ইংরেজি অনুবাদে রচনাও ছিলো। এর অর্থ মাইকেল চাইলে সেসময়কার কবিদের পড়তে পারতেন। মাইকেলের আগ্রহ ছিলো মোটাদাগে আরও পুরনোদের প্রতি।
ইংরেজি সাহিত্যের নিও-ক্লাসিকদের কালের সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর প্রধান সখ্য। জন মিল্টন তাঁর প্রধান পছন্দের কবি। সে দিক থেকে মাইকেল আধুনিক নন মোটেও, অন্তত পশ্চিমা যে সাহিত্য থেকে মাইকেল নিয়েছেন, তা পশ্চিমের আধুনিক সাহিত্য নয়। আরও পরে মাইকেল যখন ইংল্যান্ড আর ফ্রান্স মিলে বসবাস করেছেন প্রায় আট বছর, তখনো তিনি ইতালির পেত্রার্কের (১৩০৪-৭৪) থেকে নিয়েছেন সনেটের ধারণা। কিন্তু ইউরোপের আধুনিকদের প্রতি আগ্রহ দেখান নি। নিও-ক্লাসিকদের থেকে নিয়ে মহাকাব্য লিখে মাইকেল হলেন বাংলার আধুনিক। এটা সোনার পাথরবাটি মাত্র। তার জন্মের দুশ বছর পর মাইকেলকে আমরা স্মরণ করছি বাংলা সাহিত্যের ইউরোপীয় ঘরাণার আধনিক হিসেবে। পাশ্চাত্য থেকে তিনি নিয়েছেন সেটা মধ্যযুগের পাশ্চাত্য, আধুনিকের নয়। তাহলে কি আমাদের বলতে হবে পাশ্চাত্যের মধ্যযুগ মানে আমাদের আধুনিক? পাশ্চাত্যের সাহিত্যের ইতিহাস বিভাজনের কায়দায় আমাদের ইতিহাস বিভাজন কোনো কাজের কিছুই নয়।
দুই
দুশ বছর পরও বাংলা সাহিত্যে কারো কারো কাছে মাইকেল স্মরণীয়-বরণীয়, আবার কারো কারো কাছে অস্বস্ত্বিজনিত উপেক্ষার শিকার। এর প্রধান কারণ 'আর্য-রামায়ণে'র অর্থ পাল্টে দিয়েছিলেন তিনি। অন্যায় কাপুরুষিত যুদ্ধে লক্ষ্মণের কাছে মেঘনাদকে হারিয়ে রাবণ গর্জে উঠেছিলো। 'মেঘনাদবধ কাব্যে'র নবম বা শেষ সর্গে সন্তান হারানো পিতার শোকের মাতমে বীরত্বের জায়গা দখল করে রাবণের অসহায়ত্ব। রাবণ বলে, "…কহ শীঘ্র! প্রাণদান পাইল কি পুনঃ/ কপট-সমরী মূঢ় সৌমিত্রী? কে/ জানে ̶ / অনুকূল দেবকুল তাই বা করিল!/ অবিরাম স্রোতে বাঁধিল কৌশলে/ যে রাম; ভাসিল ষিলা যার/ মায়াতেজে।" রবীন্দ্রনাথ অনেক উদাহরণ টেনে মাইকেলের এই রাবণকে স্ত্রীসুলভ বলে মত দিয়েছিলেন।
আর রামকে 'আর্য-রামায়ণে'র প্রক্ষাতি থেকে সরিয়ে দুর্বল করে অনেকটা ভিলেনসুলভ করে তোলায় রবীন্দ্রনাথের যত আক্ষেপ : "রামায়ণের নায়ক মহাবীর রাম মেঘনাদবধ কাব্যের কবি তাঁহার এ-কী দুর্দশা করিয়াছেন। তাঁহার চরিত্রে তিলমাত্র উন্নত-ভাব অর্পিত হয় নাই, এরূপ পরমুখাপেক্ষী ভীরু কোনোকালে যুদ্ধ ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয় নাই।" রবীন্দ্রাথের দুটো মূল্যায়নই সীমিত অর্থে যথার্থ। মাইকেল রামকে এমন করেই তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তরুণ রবীন্দ্রনাথের পছন্দ হয় নি এই যা।
এ-বিষয়ে কথা এখানে কথা বলার পরিসর কম। প্রশ্ন হলো, রাবণ চরিত্রের এমন বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ধারণা কোথায় পেয়েছিলেন? এটা মাইকেলের স্বকীয় উদ্ভাবন? নিশ্চয়ই নয়। মাইকেল ১৮৪৭ থেকে ১৮৫৬ এ আট বছরের কালপর্বে মাদ্রাস ছিলেন। মাইকেলের রাবণ সেখান থেকে সংগৃহীত হয়েছিলো বলে আমাদের ধারণা। ভারতের দক্ষিণের (কর্ণাটক) কবি ও গবেষক এ কে রামানুজন। তিনি দেখিয়েছেন ভারতের দক্ষিণ অংশে তিনশর মতো রামায়ণের ভাষ্য পাওয়া যায়। সেগুলো থেকে তিনি ৫টি রামায়ণ বাছাই করে দেখিয়েছেন গল্পগুলো নানানভাবে বদলে গেছে।
যেমন, 'রামায়ণের জৈন গল্প হিন্দু মূল্যবোধ বহন করে না। ব্রাহ্মণ্যসংস্কৃতি রাবণকে অপদস্তকরেছে, তাকে ভিলেন বানিয়ে ছেড়েছে'। ২০১১সালে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় এ কে রামানুজনের প্রবন্ধ 'থ্রি হান্ড্রেড রামায়ণস : ফাইভ অ্যাকজাম্পলস অ্যান্ড থ্রি থটস অন ট্রান্সলেশন' প্রবন্ধটি পাঠ্য তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেয়। এ থেকে বোঝা যায় সংস্কৃত রামায়ণের বিপরীতে দক্ষিণের রামায়ণগুলোর অস্তিত্ব এখনো ব্রাহ্মণ্য-সংস্কৃতির অস্বস্তির কারণ হয়ে আছে। মাইকেল জন্মদ্রোহী একজন মানুষ। এ রামায়ণগুলো থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন বলে মনে করা যায়। স্বাভাবিকভাবে ব্রাহ্মণ্যরামায়ণের প্রবল চাপ মাইকেলেও পড়েছে। বাংলা সাহিত্যের প্রথম 'আধুনিক' তিনি, তাঁর জন্মের ২০০বছর নীরবে নিভৃতে পার হয়ে গেল বলে।
চার
মাইকেল সাহিত্যের জন্য যে ভাষা গ্রহণ করেছিলেন তা সেকালের ইংরেজ কর্তৃক প্রচলিত বাংলা নয়। তাঁর আবির্ভাবের আগে বাংলাভাষার যে নমুনা ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে পাওয়া যায় তা প্রায় পাল্টে যায় পরবর্তী ৭০/৮০ বছরে। ঔপনিবেশিকতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে যে বাংলাভাষা গড়ে ওঠে মাইকেল তা থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিলেন কি? তিনি সেকালের ইউরোপীয় উদারনীতিবাদের সৃষ্টি, এমন করে তাঁকে ভাবা যায় না। কিন্তু ঔপনিবেশিকতার ভেতরে থেকে এর বিরুদ্ধে সহজাত প্রতিরোধ শক্তি মাইকেল অর্জন করেছিলেন এটা বল যায়। তাঁর রচনাগলোতে স্থানীয় রক্ষণশীলতা যেমন আক্রান্ত হয়েছে তেমনি ইউরোপীয় আধুনিকতাও আত্রমণের শিকার হয়েছে।
কলকাতায় মাইকেলের লেখালিখির সবচেয়ে ফলপ্রদ সময়ের আগেই বাংলা ভাষার ওপর ঔপনিবেশিক প্রভুর এক প্রস্থ সংস্কার হয়ে গেছে। দুতরফে এ সংস্কার চলে। একদিকে সাহেবদের হাতে অন্যদিকে সংস্কৃত পণ্ডিতদের হাতে। ফলে বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়ন আর ইংরেজায়নের প্রভাবে বাংলা স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে। তাঁর কবিতায় বিশেষ করে মহাকাব্যে ঔজস্বিতাসম্পন্ন ভাষা নির্মাণের জন্য তিনি সংস্কৃত শব্দের কাছে হাত পেতে ছিলেন। তবে সেকালে আরবি-ফারসির সঙ্গে অর্ধতৎসম-তদ্ভব শব্দ বাদ দিয়ে যে বাংলা লেখা হয়েছে মাইকেলের তাতে কতোটা সায় ছিলো সন্দেহ থেকে যায়। অন্তত তাঁর নাটকগুলো যেখানে জীবনযাপনের প্রয়োজনে ব্যবহৃত ভাষার বেশি প্রকাশ ঘটেছে সেগুলো পরীক্ষা করলে বিষয়টা বোঝা যায়। 'একেই কি বলে সভ্যতা' প্রহসনে ইংরেজ শাসনে জাতে ওঠার ঔপনিবেশিক-হীনম্মন্যতায় বাংলার হাল কী হয়েছিলো তার নমুনা দিয়েছিলেন।
নিজবর্গকে তিনি এক্ষেত্রে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের বিষয় করেছিলেন। আমরা ছোট একটা উদাহরণ দেবো। চৈতন বলছে, "…একটা ট্রাইফ্লীং কথা নিয়ে মিছে ঝকড়া কেন?" জবাবে নব বলছে, "ট্রাইফ্লীং! ̶ ও আমাকে লাইয়র বললে — আবার ট্রাইফ্লীং? ও আমাকে বাঙ্গালা করে বল্লে না কেন? ও আমাকে মিথ্যাবাদী বললে না কেন? তাতে কোন শালা রাগতো? কিন্তু — লাইয়র — এ কি বরদাস্ত হয়?"
এ সংলাপ শুনলেই বোঝা যায় বাংলার ঝাঁঝ যে তলানিতে ঠেকেছিলো ইংরেজির বদৌলতে তা আর ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু মাইকেল প্রহসনের মধ্যে কেবল ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করেন নি, বাংলা ভাষার প্রবহমান বৈশিষ্ট্যটাও তুলে ধরেছিলেন। যেমন, 'বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ'তে হানিফের রাগের ভাষার গুরুত্ব প্রকাশ পেয়েছে এভাবে, "এমন গরুখোর হারামজাদা কি হেঁদুদের বিচে আর দুজন আছে? শালা রাইওৎ বেচারীগো জানে মার্যে, তাগোর সব লুটে লিয়ে তারপর এই করে।
আচ্ছা দেখি, এ কুম্পানি মুলুকে এনছাফ আছে কি না। বেটা কাফেরকে আমি গরু খাওয়ায়ে তবে ছাড়বো। বেটার এতবড় মক্দুর। আমি গরিব হলাম বল্যে বয়ে গেল কি? আমার বাপদাদা নওয়াবের সরকারি চাকরি করছে, আর মোর বুন কখনো বারয়ে গিয়ে তো কসবগিরি করে নি।" এখানে সেকালের সাধারণ্যে প্রচলিত শব্দ ব্যবহার করে মাইকেল সমাজব্যবস্থার ছবিটা তুলে ধরেন। মাইকেলের গদ্যচর্চা আলোচনার বিষয় হয় না, কিন্তু গদ্যেই মাইকেল সেকালের প্রতিষ্ঠিত আমলাতান্ত্রিক ভাষাদর্শ পরিহার করেন। গদ্যের মাইকেল গুরুত্বপূর্ণ এজন্যে যে গদ্যেই আমাদের যাপিত- ভাষার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটে। অবশ্য কবিতার ভাষায়ও মাইকেল পাল্টে যাচ্ছিলেন দ্রততার সঙ্গে।
পাঁচ
ইংরেজ রোমান্টিকেরা (শেলি, কিটস) মাইকেলকে আকৃষ্ট করতে পারে নি (বৈশিষ্ট্যগত কারণে বায়রন বাদে), মাইকেল নিয়েছেন প্রধানত মিল্টনদের থেকে। সেকালটা নিও-ক্লাসিকদের কাল পূর্বেই বলেছি। নিও-ক্লাসিকরা যেভাবে তাদের প্রাচীনকালকে ফিরিয়ে এনেছিলেন মাইকেল তেমনি ভারতবর্ষের পুরাণ আর ঐতিহ্যকে বিষয় করে তুলেছিলেন। আদতে পুরাণের ছত্রছায়ায় তিনি আত্মজৈবনিক লিখেছেন। তাঁর বয়সও সরাসরি আত্মজীবনী লেখার মতো দীর্ঘ হয় নি। প্রথাগত আত্মজীবনী হয়তো নয়, মাইকেল ঘুরে ফিরে নিজের জীবনকে প্রকাশ করেছেন পৌরাণিক কাহিনির আবরণে। মেঘনাদবধ কাব্যের রাবণ আদতে মাইকেল নিজেই।
মাদ্রাসে তাঁর চেয়ে অযোগ্য সাদা যখন তিনগুণের বেশি বেতন পেয়েছে, কিংবা সকল যোগ্যতা সত্ত্বেও যখন তাঁকে বিবেচনা না করে সাদা খুঁজে জ্যেষ্ঠ পদে বসানোর আয়োজন চলছে তখন মাইকেল পত্রিকায় লিখছেন: 'যাঁরা চামড়ার রঙের পার্থক্যের কাছে নতি স্বীকারের শোচনীয় ক্রোধের আগুন জ্বালানো অব্যাহত রাখেন, সেই অবলুণ্ঠিত মোশাহেবি এবং মানসিক দাসত্বের নিন্দা করার মতো কঠোর ভাষা আমাদের জানা নেই।' ভেঙে চুরে যাবার পরও এই মাইকেল রাবণের মুখোশে বলেন, "জন্ম ভূমি রক্ষা হেতু কে ডরে মরিতে?' অন্য সাহিত্যগুলোতে আরও স্পষ্ট আরও নিরাবরণ মাইকেলকে পাওয়া যাবে। 'বীরাঙ্গনা' কাব্যের প্রথম সর্গের শুরুতে দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা যে প্রশ্ন করে তা আদতে রেবেকা ম্যাকটাভিশের প্রশ্ন মাইকেলে প্রতি : 'যদিও তুমি ভূলিয়াছ তারে,/ ভুলিতে তোমারে পারে কি/ অভাগী?" এভাবে বীরাঙ্গনার প্রতিটি সর্গে রেবেকা কিংবা হেনরিয়েটা যেন কথা বলেছে — উদ্দিষ্ট আর কেউ নন, স্বয়ং মাইকেল।
একই কাহিনী ঘুরে ফিরে আসে 'শর্মিষ্ঠা'য়। যযাতির দুটো স্ত্রী। এক স্ত্রীকে ফেলে যযাতি অন্য স্ত্রীকে নিয়ে সংসার করে। মাইকেলের জীবনে রেবেকা কোনোদিন প্রশ্ন করতে আসে নি, কিন্তু শর্মিষ্ঠা এসেছে। যযাতির প্রশ্নে আত্মদহনে জর্জরিত মাইকেলকে যেন খুঁজে পাওয়া যায়: "বাড়বানলে পরিতৃপ্ত হলে সাগর যেমন উৎকণ্ঠিত হন, আমিও কি অদ্য সেরূপ হলেম?" শেষ জীবনে প্রবাসে যখন সনেট লেখা শুরু করেছেন তখনও স্মৃতিভারাতুর মাইকেল আত্মজৈবনিকের আশ্রয় নিয়েছেন। 'বঙ্গভাষা' 'কপোতাক্ষনদ' , 'ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত', 'ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর' কবিতাগুলোতে তাঁর আত্মজৈবনিকতার ছায়া পড়ে বারবার।
শেষ নাটক 'মায়াকাননে' মাত্র ৪৭ বছর বয়সে মাইকেল জীবনের এক গভীর তাৎপর্য পৌঁছান। জীবন এক প্রহেলিকা, মায়াকানন মাত্র, রোগ-শোক-অর্থাভাব জর্জরিত মাইকেল মায়াকাননের গোলক ধাঁধাঁয় জীবনটা পার করে দেন। তাঁর রচনায় এভাবে আত্মজৈবনিকতার প্রভাব সেকালের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধের প্রকাশ। মাইকেলের কালে উপযোগিতাবাদের প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিলো শিক্ষিত সমাজে , মাইকেলও এর ব্যতিক্রম নন। তাঁর 'ব্রজাঙ্গনা'র রাধা তাই 'মিসেস', অনেক বেশি শরীরী আবেদনে কাতর।
বাংলা সাহিত্যের যুগবিভাগকে ইংরেজদের রাজনৈতিক ইতিহাসের যুগবিভাগের সঙ্গে মিলিয়ে পড়ার ফলে মাইকেলকে ঠিকভাবে ধারণ করা যাচ্ছে না। বরং রাজনৈতিক ইতিহাসের মতো করে নামকরণ বাদ দিয়ে মাইকেলকে দ্রোহ-পর্বের কবি হিসেবে বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক নয়, 'প্রথম বিদ্রোহী' বলতে পারি।
Comments