আমেরিকা

নিষিদ্ধ বইয়ের পাঠ সপ্তাহ উদযাপন

পড়ার স্বাধীনতা আমাদের গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য কিন্তু তা এটা ক্রমাগত হামলার শিকার হচ্ছে বলে বিবৃতি দেয় যা এখনো সময়োপযোগী।
ছবি: সংগৃহীত

পাঠকের পড়ার স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ণ  রাখতে প্রতিবছর অক্টোবরের শুরুতে আমেরিকায় নিষিদ্ধ বইয়ের পাঠ সপ্তাহ উদযাপন হয়। তারই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের উদযাপন গতকাল শেষ হয়েছে। সচেতনতামূলক কার্যক্রমটি আয়োজন করে আমেরিকান লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশন। 

জানা যায়, আমেরিকার সংবিধানের প্রথম সংশোধনী-- ধর্ম, মতপ্রকাশ, সমাবেশ এবং আবেদন করার অধিকার সংক্রান্ত স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়। তাই এই আইনের ছায়ায় মানুষ কথা বলা, বই লেখায় ভোগ করে স্বাধীনতা। জাতীয়ভাবে আমেরিকায় বই নিষিদ্ধের ঘটনা স্মল পক্স এবং ভিনাইল রেকর্ডের মতো এখন শুধুই ইতিহাস। তবুও স্থানীয়ভাবে মাঝে মাঝে স্কুল কমিটি বা স্থানীয় প্রশাসনের অধীন লাইব্রেরিগুলো নানা কারণে কিছু বই নিষিদ্ধ করে। তাদের অভিযোগ এই সমস্ত বইতে আছে যৌনতা, সমকামিতা, সহিংসতা, জাতিগত সংঘাত, বর্ণবাদ, কালো আর বাদামী মানুষের লেখা এবং বইয়ে অশ্লীল বলে বিবেচিত বিষয়বস্তু।

নিষিদ্ধ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই-- মার্গারেট অ্যাটউডের উপন্যাস 'দ্য হ্যান্ডমেইডস টেল' এর গল্পে ধর্মের নাম ব্যবহার করে মহিলা যারা এখনও সন্তান ধারণ করতে সক্ষম তাদেরকে বাধ্য করা হয় অভিজাতদের জন্য সন্তান ধরণে। বইটিতে সমালোচকরা যৌন সহিংসতা এবং ধর্মের প্রতি প্রবল অবিশ্বাসকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। কিন্তু অ্যাটউড দাবি করেছেন, দ্য হ্যান্ডমেইডস টেলে এমন কিছুই ঘটেনি যা ইতিমধ্যেই ইতিহাস জুড়ে মহিলাদের সাথে ঘটেনি, এই বইয়ের কাহিনীতে একটি ভয়ঙ্কর সত্য বলা হয়েছে।

হার্পার লি'র টু কিল এ মকিংবার্ড পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী উপন্যাস যেখানে একজন শ্বেতাঙ্গ আইনজীবী অ্যালাব্যামা'র একটি ছোট শহরে ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত একজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে রক্ষা করেন, এটি ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর এর চলচ্চিত্রায়নের জন্য অস্কার পায় এবং মঞ্চ নাটকের জন্য পায় টনি-এয়ার্ড যা খুব বিরল ঘটনা। বইটি প্রকাশের প্রায় ষাট বছর পরেও টু কিল এ মকিংবার্ড এখনও শীর্ষ দশটি সর্বাধিক বার নিষিদ্ধ বইয়ের একটি।
লি-এর বইটির বিরুদ্ধে অভিযোগ জাতিগত শ্লীলতাহানির ব্যবহার এবং প্রকাশ্য বর্ণবাদের অদম্য চিত্রণ। এ সম্পর্কে লি'র অভিমত সাহিত্যের একটি উদ্দেশ্য, আমাদের সমাজের অস্বস্তিকর বিষয়গুলোর তুলে আনা পাশাপাশি খারাপ ব্যক্তিদের কাছে একটি আয়না ধরে রাখা।

টনি মরিসনের প্রথম উপন্যাস, দ্য ব্লুয়েস্ট আই, যৌন নির্যাতন এবং অজাচারের বেদনাদায়ক দৃশ্যের জন্য নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকার আসে। মরিসনের পরবর্তী উপন্যাস, 'বিলভড' ও সম্প্রতি উত্তপ্ত বিতর্কের অংশ হিসাবে আলোচিত হয়েছে, যেখানে আলোচনা করা হয়েছে জাতিগত বৈষম্য এবং ইতিহাস। এই রকম বইগুলো হলো—

ছবি: সংগৃহীত

রে ব্র্যাডবেরি'র ফারেনহাইট ৪৫১, আর্ট স্পিগেলম্যানের মাউস, জর্জ অরওয়েলের ১৯৮৪, উইলিয়াম গোল্ডিং-এর লর্ড অফ দ্য ফ্লাইস, জর্জ অরওয়েলের এনিম্যাল ফার্ম, জন স্টেইনবেক দ্বারা অফ মাইস এন্ড মেন, অ্যাঞ্জি থমাসের দ্য হেট ইউ গিভ, খালেদ হোসেইনির দি কাইট রানার- নিষিদ্ধ বইয়ের এই তালিকা অনেক দীর্ঘ।

ঐতিহাসিকভাবে, অশ্লীলতাকে কেন্দ্র করে বই নিষিদ্ধ হওয়া কিভাবে আমেরিকার সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর সাথে সম্পর্কিত- তাই নিয়ে ২০ এবং ২১ শতক জুড়ে চলেছে বিতর্ক হয়েছে একাধিক মামলা এবং বিষয়টি অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে আজকের অবস্থায় এসেছে। ১৮৮৫ সালে শেষ হওয়া গৃহযুদ্ধের এক দশক পর, অ্যান্থনি কমস্টক নামে একজন নৈতিকতা-বাদী সরকারী কর্মকর্তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসকে "পর্নোগ্রাফিক" সামগ্রী ডাকে পাঠানো নিষিদ্ধ করার জন্য একটি আইন পাস করতে রাজি করিয়েছিলেন। পর্নোগ্রাফিক-শব্দটি তার সংজ্ঞায় অস্পষ্ট ছিল-- তাই অ্যানাটমি পাঠ্যপুস্তক, প্রজনন সম্পর্কে ডাক্তারদের প্যামফ্লেট, অস্কার ওয়াইল্ডের কিছু রচনা, এমনকি ক্যান্টারবেরি টেলসও ডাকের মাধ্যমে পাঠানো কে 'যৌনতা' হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছিল।

এই নিষেধাজ্ঞা "কমস্টোকারি" আইন হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে যা নতুন শতাব্দীতেও ছিল অব্যাহত। কিন্তু ১৯২০ এর দশকের মধ্যে, রাজনীতি এবং সামাজিক প্রথার পরিবর্তনে বই বিক্রেতারা জনগণের যা ইচ্ছা তা পড়ার অধিকারকে সমর্থন করতে শুরু করেন। তারপর ১৯৩৩ সালে মামলা হয় যা আদালতে "দ্য ইউনাইটেড স্টেটস বনাম ওয়ান বুক কলড ইউলিসিস" নামে অভিহিত। এই মামলায় আমেরিকার সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর আইনি ব্যাখ্যার নতুন যুগের সূচনা হয়।

মামলায়, বিচারক জন এম. উলসি জেমস জয়েসের 'ইউলিসিসে' এর উপর ফেডারেল নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে দেন- যেটি ১৯২২ সাল থেকে কার্যকর ছিল, এবং আদালত রায়ে বলেন যে-- বিচারক যিনি বইটিকে নিষিদ্ধ করেছিলেন তিনি মন্তব্য করেছিলেন যে "এটি একটি বিশৃঙ্খল মনের কাজ"। অবশ্য বিচারক উলসি, যিনি উপন্যাসটি পছন্দ করেননি, তিনি শিল্পের জন্য যৌনতার সংজ্ঞা দেন আর সিদ্ধান্ত দেন "যৌনতার চিত্রণ, এমনকি অপ্রীতিকর হলেও, সিরিয়াস সাহিত্যে অনুমতি দেওয়া উচিত।" তার চূড়ান্ত আদেশটিতে বলেন "যদিও অনেক জায়গায় পাঠকের উপর ইউলিসিসের প্রভাব নিঃসন্দেহে কিছুটা আবেগপূর্ণ, তবে কোথাও এটি কামোদ্দীপক হওয়ার প্রবণতা নেই।" মামলাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ নজির স্থাপন করেছিল এবং কমস্টক আইন ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত বহাল ছিল। এর মাঝে সুপ্রিম কোর্টে 'রথ বনাম যুক্তরাষ্ট্র' নামের আরেকটি মামলা হয়।

বাদী ছিলেন স্যামুয়েল রথ, একজন লেখক এবং বই বিক্রেতা, যিনি গ্রাহকদের কাছে পর্নোগ্রাফিক ম্যাগাজিন ডাকে পাঠানোর জন্য দোষী সাব্যস্ত হন, এবং হাজতবাস করছিলেন। তার বিচার আমেরিকান আইনি ব্যবস্থাকে আবারও অশ্লীলতার সংজ্ঞা পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করে। আদালতের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত রথের জন্য খারাপ ছিল কারণ তার দোষী সাব্যস্ততা বহাল ছিল, এবং তিনি ১৯৬১ সাল পর্যন্ত কারাগারে ছিলেন, যদিও রায়টি বই প্রেমীদের অনুকূলে গিয়েছিল। আদালত যৌনতার সংজ্ঞাটি সংকীর্ণ করে শুধু "সামাজিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে" গুরুত্ব দেয়।

সাধারণভাবে অশ্লীলতার অভিযোগে ১৯৬০ এবং ৭০ এর দশকে বই নিষিদ্ধের দৃষ্টান্ত কমে গিয়েছিল। শিল্পী এবং লেখকরা আগের চেয়ে স্বাধীন বোধ করেছেন। জন আপডাইক এবং এরিকা জং-এর উপন্যাসে যৌনতা ছিল মূলধারা।

আমেরিকান বুকসেলার ফর দ্য ফ্রি এক্সপ্রেশন (এবিএফই) যারা প্রতি বছর কোথায় কোন বই কি কারণে নিষিদ্ধ করা হলো তার তালিকা প্রকাশ করে তাদের তথ্য মতে, গত কয়েক বছরে আবার চ্যালেঞ্জ করা বইয়ের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমেরিকার পাবলিক লাইব্রেরি এবং আমেরিকান লাইব্রেরি এসোসিয়েশন নিষিদ্ধ করা বইগুলোর বিরুদ্ধে জোড়াল ভূমিকা পালন করছে। বইগুলো যাতে মানুষ পড়তে পারে তাই প্রতিবছর বিশেষ সপ্তাহ বা পক্ষ পালন করে পড়তে মানুষকে উৎসাহিত করে।

গত ৪০ বছর যাবত আমেরিকার পাবলিক লাইব্রেরিগুলো অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে নিষিদ্ধ বই পড়ার সপ্তাহ হিসেবে উদযাপন করে আসছে। এই সময় তারা কখনো নিষিদ্ধ হয়েছে এই সব বই পড়তে মানুষকে উৎসাহিত করে। নানা রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আমেরিকান লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশনের ১৯৫৩ সালে "পড়ার স্বাধীনতা আমাদের গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য কিন্তু তা এটা ক্রমাগত হামলার শিকার হচ্ছে।" বলে বিবৃতি দেয় যা এখনো সময়োপযোগী।

Comments

The Daily Star  | English
What constitutes hurting religious sentiments

Column by Mahfuz Anam: What constitutes hurting religious sentiments?

The issue of religious tolerance have become a matter of great concern as we see a global rise in narrow-mindedness, prejudice and hatred.

6h ago