এক চিঠিতে বদলে গেছে সেসব সাহিত্যিকদের জীবন

ইন্টারনেটের মাধ্যমে মুহূর্তে সহজ হয়েছে আমাদের যোগাযোগ। কিন্তু একসময় চিঠিই ছিল শেষ ভরসা। সে সময় কত চিঠি যে মানুষের জীবন পাল্টে দিয়েছে তার হিসাব নেই। আজ আমরা স্মরণ করবো এমন ৬জন সাহিত্যিকদের, যাদের জীবন বদলে দিয়েছিলো একটি অমূল্য চিঠি। পরবর্তীতে যারা অবদান রেখেছেন বাংলা সাহিত্যে, পরিণত হয়েছেন কালজয়ী কীর্তিমানে।

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ যে একজন আইনজীবীও ছিলেন তা আমরা অনেকেই জানি না। ১৯১৫ সালে তিনি পশ্চিম বঙ্গের বশীরহাট আদালতে আইনজীবী হিসেবে যোগ দেন। আইনজীবী হিসেবেই কাজ করছিলেন একনাগাড়ে। কিন্তু ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের একটি চিঠি পান তিনি, যে চিঠি পুরোপুরি বদলে দিয়েছিলো তাঁর জীবন। চিঠিতে লেখা ছিল: "Shahidullah, bar is not for you, come to our University." এ সম্পর্কে 'বাংলা সাহিত্যের কথা' দ্বিতীয় খণ্ডের উৎসর্গপত্রে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ লিখেছেন: "যিনি একদিন ১৯১৯ সালে Shahidullah, bar is not for you, come to our University বলে আমাকে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থান দান ক'রে আমার জীবনের গতিপথ বদলিয়ে দিয়েছিলেন।" 

স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় যদি ঠিক সময়ে সেই চিঠিটি না পাঠাতেন তাহলে আমরা একজন আইনজীবী পেতাম, কিন্তু ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্'র মতো জ্ঞানের চলন্ত বিশ্বকোষ পেতাম না। 

কাজী নজরুল ইসলাম
নজরুল তখন পরিবারসহ বাস করছেন কৃষ্ণনগরে। ভয়াবহ অর্থকষ্টের মধ্যে যাকেই পারছেন চিঠি লিখছেন টাকা চেয়ে। সেই চরম দুঃসময়ে বেগম সুফিয়া কামালের একটি চিঠি বদলে দিয়েছিলো নজরুলের জীবন। সুফিয়া কামাল চিঠি লিখেছিলেন স‌ওগাতের সম্পাদক নাসির‌উদ্দীনের কাছে। সুফিয়া কামাল লিখেছিলেন: "আমার স্বামী এখন পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত আছেন, নয়ত ওঁকে দিয়ে কাজীর খোঁজ নেওয়াতুম। আপনাকেই শুধু এ বিষয়ে অনুরোধ করতে পারি, আপনি ওকে দেখ্‌বেন। ওর মা হয়ে বোন হয়ে আপনাকে অনুরোধ করছি। হতভাগাটাকে পথ থেকে এনে স্নেহ দিয়ে ওকে বাঁধুন। এ দুরন্ত শাসনে সায়েস্তা হবেই না। যদি কোনো রকমে তাকে ধরে বেঁধে কোলকাতা আনতে পারেন তবেই রক্ষা।" 

এ চিঠি পেয়েই নাসির‌উদ্দীন নজরুলকে সপরিবারে কলকাতা নিয়ে আসেন। কলকাতায় এসে নজরুল লিখতে থাকলেন দুই হাতে। সুফিয়া কামালের একটি চিঠিতেই নজরুলের অর্থকষ্টের জীবন বদলে গেলো, নেমে এলো সচ্ছলতা। 

সৈয়দ মুজতবা আলী
১৯১৯ সাল— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গেলেন সিলেটে। শহরে একটি বক্তৃতা দিলেন 'আকাঙ্ক্ষা' বিষয়ে। সেই মজলিশে বসে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা শুনেছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। তার ২ বছর পর স্থানীয় সরকারী হাই স্কুলে একটি গোলযোগের সূত্র ধরে মুজতবা আলী স্কুল থেকে বের হয়ে এলেন। আর ফিরে যেতে চাইলেন না স্কুলে। তখন তিনি কী মনে করে একটি চিঠি লিখেন রবীন্দ্রনাথকে। চিঠিতে প্রশ্ন ছিল: "আকাঙ্ক্ষা উচ্চ করতে হলে কি করতে হবে?" 

সপ্তাহখানেক পর চিঠির উত্তর আসলো। চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: "আকাঙ্ক্ষা উচ্চ হতে হবে এই কথার মোটামুটি অর্থ স্বার্থ যেন মানুষের কাম্য না হয়। দেশের মঙ্গল ও জনসেবার জন্য স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগ কামনাই মানুষকে কল্যাণের পথে নিয়ে যায়। তোমার কি করা উচিত তা এত দূর থেকে বলে দেওয়া যায় না। তোমার অন্তরের শুভেচ্ছাই তোমাকে কল্যাণের পথে নিয়ে যাবে।" 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই চিঠি পেয়ে শান্তিনিকেতনে পড়তে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এবং শান্তিনিকেতনের প্রথম মুসলমান ছাত্র হিসেবে উজ্জ্বল স্বাক্ষর‌ও রেখেছেন। ভাবতেই অবাক লাগে, রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি এক স্কুল-ফেরত চঞ্চল বালকের জীবন পুরোপুরি বদলে দিয়ে পরিণত করেছিলো এক বহুভাষাবিদ পণ্ডিত ব্যক্তিত্বে। 

আবুল কালাম শামসুদ্দীন 
১৯২২ সাল— অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসেবে ময়মনসিংহের ত্রিশালে পল্লীসমিতির কাজ করছেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন। তখনই ইন্তেকাল করেন তাঁর পিতা। সাংসারিক অবস্থা ক্রমশ ভঙ্গুর হতে লাগলো। এমন সময় কলকাতা থেকে আসা একটি চিঠি পেলেন তিনি। আত্মজীবনীতে সেই চিঠি নিয়ে লিখেছেন: "এমন সময়ে আমার সৌভাগ্যবশত: কলকাতা থেকে আমার নামে এক চিঠি এসে হাজির। চিঠি লিখেছিলেন মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী। তিনি তখন 'দৈনিক মোহাম্মদী'র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। যে-চিঠির কথা উল্লেখ করেছি, তাতে তিনি আমাকে 'দৈনিক মোহাম্মদী'র সম্পাদকীয় বিভাগে যোগদানের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বেতন বর্তমানে সামান্য‌ই দেওয়া হবে—মাত্র চল্লিশ টাকা। তবে একমাস পরে বেতন কিছু বাড়তে পারে। আমি এ-প্রস্তাবে রাজী হলে, তা তাঁকে অবিলম্বে জানাতে অনুরোধ জানানো হয়েছিলো। রাজী থাকলে দেরী না করে কাজে যোগদান করতেও বলা হয়েছিলো।" 

মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর এই চিঠি বদলে দিয়েছিলো আবুল কালাম শামসুদ্দীনের জীবন। চিঠির প্রস্তাব মোতাবেক কলকাতায় গিয়েছিলেন এবং যোগদান করেন দৈনিক মোহাম্মদী পত্রিকায়। এ কথা সর্বজনবিদিত যে, পরবর্তী জীবনে সাংবাদিকতায় আবুল কালাম শামসুদ্দীন এমন অবদান রেখেছেন যে, বাংলার মুসলমানদের সাংবাদিকতার ইতিহাসে তিনি পরিণত হয়েছেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্রে। 

জসীম উদ্‌দীন 
জসীম উদ্‌দীন তখন কপর্দকশূন্য অবস্থায় কলকাতায়। কিছু গ্রাম্য গান সংগ্রহ করে সেগুলো কাজে লাগানোর সুযোগ খুঁজতে পা রেখেছেন কলকাতায়। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌'র সাথে গেলেন দীনেশচন্দ্র সেনের বাড়িতে। শহীদুল্লাহ্ সাহেবকে দিয়ে দীনেশচন্দ্র একটি চিঠি লেখালেন: 
"প্রিয় ডাঃ সেন, আপনাকে আমি একজন তরুণ যুবকের সঙ্গে পরিচিত করাইব। ইনি পাড়াগাঁ হ‌ইতে মুর্শিদা, বাউল, বারমাসী, মারফতি, জারি, ধূঁয়া প্রভৃতি নানা প্রকারের গ্রাম্য গান সংগ্রহ করিয়াছেন। আমি জানি, আপনি ছাড়া এমন কোনো ব্যক্তি নাই যাঁহার দ্বারা ইনি উৎসাহিত হ‌ইতে পারেন। আপনি যদি তাহাকে কাজে লাগাইতে পারেন বড়‌ই খুশি হ‌ইব।" 

এই চিঠি লেখার পর জসীম উদ্‌দীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাম্যগাথা সংগ্রাহক হিসেবে নিয়োগ পেলেন। মাসে ৭০ টাকা বেতনের সেই চাকরি জসীম উদ্‌দীনের জীবনের গতিপথ নির্দেশ করেছিলো। যে নির্দেশ মোতাবেক জসীম উদ্‌দীনের পরবর্তী কবি জীবন উপহার পেয়েছি আমরা। এই রকম একটি ঘটনা আল মাহমুদেরও আছে। যে চিঠি মাহমুদকে কবিতার দিকে এক জীবন বিলিয়ে দিতে প্রেরণা দিয়েছে। 

গোলাম সামদানী কোরায়শী
গোলাম সামদানী কোরায়শী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করে চাকরির আশায় তখন বসে আছেন গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে। অবসর কাটাতে অনুবাদ শুরু করেছেন 'আনোয়ারে সুহায়লী' নামক ফারসি বই। এমন সময় পেলেন চিঠি। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ডেকে পাঠিয়েছেন তাকে। পরদিন‌ই তিনি চলে আসলেন ঢাকায়। তার মুখেই শোনা যাক পরবর্তী ঘটনা: "বিকালে রফিককে সাথে নিয়ে শহীদুল্লাহ্ সাহেবের চকবাজারের বাসায় গিয়ে উপস্থিত হলাম। তখন আসরের নামাজ পড়ে শহীদুল্লাহ্ সাহেব বৈঠকখানাতেই বসেছিলেন। ভেতরের দিক থেকে একটি ফাইল নিয়ে এসে পাতা উল্টিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, 'আপনাকে স্মরণ করেছি একটা শব্দের জন্য, আবেন্দা, শব্দটা কোন ভাষার হতে পারে?' আমি প্রায় বিনা দ্বিধায় বলে ফেললাম, 'ফারসি, অর্থ আনয়নকারী।' একটু পরেই তিনি 'লুগাতে কেশোয়ারী' থেকে শব্দটি বের করে আমাদের কাছে ফিরে এলেন। শুধু শব্দ নয়, আমার দেয়া অর্থ‌ও মিলে গেছে। তিনি এখন সেই অভিধানের সম্পাদক হিসেবে বাংলা একাডেমীতে কাজ করছেন। তিনি বললেন, 'কাল একবার একাডেমীতে আমার সাথে দেখা করো।" 

পরদিন তিনি দেখা করলেন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সঙ্গে। এবং বাংলা একাডেমি থেকে নিয়োগপত্র পেলেন শহীদুল্লাহ্'র সহকারী হিসেবে। পরবর্তীকালে একাডেমিতে অনুবাদ বিভাগেও কাজ করেছেন। মূল ফারসি থেকে অনুবাদ করেছেন ইবনে খালদুনের আল মোকাদ্দিমা এবং তারিখ-ই ফিরোজশাহীর মতো কালজয়ী ঐতিহাসিক গ্রন্থ। 

উল্লেখিত ঘটনা ছাড়াও আরও আছে এমন। তবে উপস্থাপিত সাহিত্যিকদের জীবন যে একেকটা চিঠির মাধ্যমে পুরোপুরি বদলে গেছে তা প্রমাণিত। তবে আমাদের এও মনে রাখতে হবে সেইস গুণীদের, যারা চিঠি দিয়ে বদলে দিয়েছিলেন প্রতিভাধর অনুজদের। মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে এক চিঠি লিখে জীবন বদলে দিয়েছিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আর গোলাম সামদানী কোরায়শীকে লিখে বদলে দেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্। গুণীজনরা এভাবে সময়ের পরম্পরায় আগলে রাখতেন প্রতিভাবানদের। এখন সেই চিত্র বা স্মৃতি কি আছে কারো! 

ব্যবহৃত গ্রন্থ: 
১. শহীদুল্লাহ্ রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড : বাংলা একাডেমি, ১৯৯৫ 
২. স‌ওগাত-যুগে নজরুল ইসলাম : মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, নজরুল ইন্সটিটিউট, ১৯৮৮ 
৩. মুজতবা-কথা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ : সৈয়দ মুর্তাজা আলী, ঢাকা, ১৯৭৬ 
৪. অতীত দিনের স্মৃতি : আবুল কালাম শামসুদ্দীন, ন‌ওরোজ কিতাবিস্তান, ১৯৬৮  
৫. যাঁদের দেখেছি : জসীম উদ্‌দীন, পলাশ প্রকাশনী, ২০১৮ 
৬. সিন্ধুর এক বিন্দু : গোলাম সামদানী কোরায়শী, সূচীপত্র প্রকাশনী, ২০০০ 

 

Comments

The Daily Star  | English

At least 30 hurt as clashes engulf part of Old Dhaka

Suhrawardy college, hospital vandalised as protests over student’s death turn violent

2h ago