রিভিউ

মইনুল আলমের চোখে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জীবন

প্রান্তিক জনজীবন নিয়ে নিরবচ্ছিন্ন কাজ করে যাচ্ছেন মইনুল আলম। তার কাজ আলোকচিত্রীদের মধ্যেও প্রশংসিত। কাজের ধারাবাহিকতায় ম্রো-নৃগোষ্ঠীর চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষের উৎসব 'চাংক্রান পই'য়ের সাদাকালো আলোকচিত্র নিয়ে প্রকাশিত হয় 'চাংক্রান পই'। তার আগে সমুদ্রতীরের দরিদ্র জেলেদের দৈনন্দিন জীবনসংগ্রামের ছবি নিয়ে প্রকাশিত আলোকচিত্রের বই—'ছবিতে বাংলাদেশের জেলে জীবন ও জীবিকা'। চলতি বছর প্রকাশিত হলো ম্রোদের নিয়ে আলোকচিত্রের বই—'মাংসি'। বোঝা যায়, সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জীবনই মইনুল আলমকে আকৃষ্ট করেছে গভীরভাবে।

২২৩ পৃষ্ঠার বইয়ের সব ছবি ৩৫ মিমি ফিল্মে তোলা। ম্রোদের জীবনযাপন ও বান্দরবানের নিসর্গ বইটিতে ফুটে উঠেছে চমৎকারভাবে। ছবিগুলোয় রঙ বিন্যাসে যেমন চিত্তাকর্ষক ও ধারণ-কৌশল তেমনি চমকপ্রদ। 'চাংক্রান পই'-উপলক্ষে প্রতিবছর মেলা বসে বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার মাতামুহুরী নদীর তীরে সাবেক বিলছড়ি মৌজায়। এই উৎসবকেন্দ্রিক মেলার ছবি প্রথম তোলেন ২০১৬ সালে।

পরের বছর সেই ছবিগুলো বাছাই করে তিনি সাবেক বিলছড়িতেই 'চিত্রভাষায় চাংক্রান পই' শিরোনামে একক চিত্রপ্রদর্শনের আয়োজন করেন। ছবির মানুষগুলোই নিজেদের বিচিত্র ভঙ্গিমা ও সাজপোশাকের ছবি দেখে, নিজেদের ফিরে পেয়ে, অনাবিল আনন্দ ও বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা: বান্দরবান (২০১৪) বইয়ে 'চাংক্রান পই'য়ের সংক্ষিপ্ত বিবরণ থাকলেও সাবেক বিলছড়িতে অনুষ্ঠিত ম্রোদের প্রাচীন মেলাটির তথ্য পাওয়া যায় না।

২০০-র বেশি রঙিন আলোকচিত্রে শোভিত 'মাংসি'তে ম্রোদের নিত্যদিনের জীবনাচার, খাদ্যাভ্যাস, পোশাকপরিচ্ছদ ও সাজগোজ, দূরের পথে দল বেঁধে পায়ে হেঁটে বা নৌকায় হাটে যাওয়া, মাতামহুরীর তীরে সামান্য ভাত-মাছ রান্না করে খাওয়া, ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতি, উৎসব—নানা শ্রেণি ও বিষয়ের ছবি ধারাবাহিকভাবে উঠে এসেছে বইটিতে। শান্তস্বভাবের ম্রো-জনগোষ্ঠীর অনাড়ম্বর জীবন মইনুল আলমের মনে স্থায়ী রেখাপাত করেছে বলে ধরে নেওয়া যায়। পরপর প্রকাশিত তার ২টি ম্রো-কেন্দ্রিক আলোকচিত্রের বই সে কথাই প্রমাণ করে।

মইনুল আলমের ছবি তোলা শুরু করেন গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। 'মাংসি'র ভূমিকায় জানা যায়, বরেণ্য আলোকচিত্রী আনোয়ার হোসেন (১৯৪৮-২০১৮) ফ্রান্সে যাওয়ার আগে তার নিকন এফ৩এক্স ক্যামেরাটি মইনুল আলমের কাছে বিক্রি করেন। সেই পুরনো ৩৫ মিমি ফিল্ম ক্যামেরা নিয়েই মইনুল আলমের আলোকচিত্রাভিযানের শুরু। যদিও তিনি ছবি তোলার প্রথম প্রণোদনা পেয়েছেন কৈশোরেই, তার বাবা স্বনামধন্য চিকিৎসক ও অভিনেতা এবিএম নুরল আলমের (১৯২৫-২০০৩) কাছে।

চট্টগ্রামের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র 'হীরামন' এ নুরল আলম অভিনয় করেছিলেন। নিয়মিত মঞ্চনাটকে অভিনয় ও নাট্যনির্দেশনার পাশাপাশি তার ছিল ছবি তোলার শখ। ষাট-সত্তরের দশকের চট্টগ্রাম শহর, রাঙ্গামাটি ও কক্সবাজারের পথঘাট, চট্টগ্রামে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আগমন ও ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনে মুক্তিকামী জনতা ও বেশ কয়েকটি জনসভার ছবি তুলেছেন সাদাকালো ফিল্মে, তার নিজস্ব ফিল্ম ক্যামেরায়। পূর্বস্বর-প্রকাশিত তার স্মৃতিকথার বই 'অতীত যখন মুখর সঙ্গীতে' এসব তথ্যঋদ্ধ বিবরণ লেখা রয়েছে।

'মাংসি'র ছবিগুলোয় বিশেষভাবে চোখে পড়বে সরল শিশুদের মুখ। গাঁয়ের ধুলোমাখা পথে লুঙ্গি-শার্ট পরা ৩ শিশু স্কুলে যাচ্ছে—পিতলের ঘণ্টাও ঝুলছে একজনের হাতে। বাবার হাত ধরে কোথাও দাঁড়িয়ে আছে এক অবুঝ শিশু। শিশুটির ব্যাকুল চোখ মুহূর্তেই মন কেড়ে নেয় আলো-ছায়া ও বস্তু বিন্যাসের নৈপুণ্যের কারণে। চিত্রশিল্পী মইনুল আলম যেন ছবি এঁকেছেন ক্যামেরার ক্যানভাসে—শুধু মাধ্যমের বদল ঘটেছে, অন্তর্দৃষ্টির নয়।

ম্রো-ভাষায় 'মাংসি' মানে সবুজ রং। উৎসবের আগে ম্রো ছেলেমেয়েরা কাপড়ে লাল রঙ (রাংসি) ও সবুজ রঙ (মাংসি) লাগায়। পুরনো দা পানিতে ভিজিয়ে তার ওপর কচি বাঁশের আগুনের ছ্যাঁক দিলে কালচে তরল তৈরি হয়। গরম অবস্থায় সেই তরল আঙুলে তুলে নিয়ে দাঁতে লাগান ম্রোরা। বিশেষ উপায়ে তৈরি এই প্রাকৃতিক রঙের নাম 'চুলি'।

রঙ লাগানোর পর এক সপ্তাহ টক-জাতীয় কিছু খাওয়া যাবে না। এতে দাঁত ভালো থাকে বলে মনে করেন ম্রোরা। ছেলেরা লম্বা চুল রাখেন, চুড়ো করে খোঁপা বাঁধেন, খোঁপায় চিরুনিও (সিরুট) গুঁজে রাখেন, যেমন রাখেন মেয়েরা।

মেয়েরা খোঁপা বাঁধেন মাথার পিছনের দিকে আর ছেলেরা মাথার সামনের দিকে বা বামদিকে খানিকটা হেলিয়ে দিয়ে। তবে খোঁপায় ফুল গুজে রাখেন অবিবাহিত তরুণেরাই। ম্রো পুরুষদের চেনা যায় মাথার সাদা বা ধূসর পাগড়ি (লাপং) দেখে। নারীরা কানের লতির ফুটোয় রূপার দুলের (রাম সেং) সঙ্গে ফুল ও ভেষজ লতাগুল্ম গুজে রাখেন।

আজকাল অবশ্য ছেলেদের লম্বা চুল বা খোঁপা দেখা যায় না। তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন পাশ্চাত্যের বাহারি সাজ ও পোশাকে। হাটের রাস্তায় দাঁড়িয়ে একমনে 'প্লুং' বা বাঁশি বাজাচ্ছে—এমন কোনো আত্মমগ্ন কিশোরের দেখাও আর সহজে পাওয়া যায় না।

'মাংসি'র শুরুতেই আছে বান্দরবানের দীর্ঘ সর্পিল পথরেখা। হাতছানি-দেওয়া ধূলিধূসর এই পথরেখাও আর পাওয়া যাবে না। এখন বেশিরভাগ পথঘাট পিচঢালা অথবা ইটবিছানো। ছন ও বাঁশের বেড়ার ঘরের ছন সরিয়ে জায়গা করে নিয়েছে টিনের চাল। কোথাও বা উঠে গেছে ইটের দালান। ম্রো ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করছেন স্কুল, কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারা নিজেরাই এখন নিজেদের ছবি তুলছেন দামি স্মার্টফোনে।

এসবই ইতিবাচক পরিবর্তন, সন্দেহ নেই। এর নেপথ্যে আছে নিশ্চয়ই আর্থিক সচ্ছলতা, দোরগোড়ায় আসা প্রযুক্তির নানা পণ্যে। অবশ্য ধর্মান্তরও আরেকটি কারণ। মারমাদের মতো ম্রোরা বৌদ্ধধর্মানুসারী হলেও তারা মূলত ছিলেন প্রকৃতিপূজারী ও সর্বপ্রাণবাদী; এখন ম্রোদের অনেকেই ক্রামাধর্ম ও খ্রিষ্টানধর্মে দীক্ষিত, কেউ-কেউ সনাতন রীতিতেই বিশ্বাসী।

জনশ্রুতি আছে ১৯৮৫-৮৬ সালে ম্রো-জনগোষ্ঠীর সাধক মেনলে ম্রো নিজ নৃগোষ্ঠীর বর্ণমালা ও ক্রামাধর্ম আবিষ্কার করেন। এরপর থেকে ক্রামাধর্মাবলম্বী ম্রোদের অনেকে গোহত্যা-উৎসব (চিয়াসদ পই) ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ মেনলে ম্রোর মতে, যে ধর্মগ্রন্থ খেয়ে ফেলার অপরাধে এই নির্মম গোবধ উৎসবের সূচনা তা এখন অনাবশ্যক। ম্রোরা পেয়ে গেছেন তাদের ক্রামাধর্ম। এরকম আরও বহু আচার-বিশ্বাসের রদবদল ঘটেছে। এসবের কিছু বিবরণ পাওয়া যাবে ইয়াংঙান ম্রো-র লেখা 'ক্রামাধর্মের উৎপত্তি' ও 'ম্রো সমাজ' বইয়ে।

তাহলে কেন আর দেখতে হবে পুরনো দিনের ফিল্মে-তোলা ছবি, বিশেষত এই ডিজিটাল ক্যামেরার যুগে? দেখতে হবে ইতিহাসচেতনা ও সৌন্দর্যবোধের টানে। বান্দরবানের এক প্রাচীন জুমনির্ভর জনগোষ্ঠীর সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনবাস্তবতার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগ্রহ মেটাতে পারে হারিয়ে-যাওয়া দিনের এই রঙিন চিত্রমালা। এখানেই হয়তো 'মাংসি'র চিরন্তন আবেদন...

Comments

The Daily Star  | English

Teknaf customs in limbo as 19 mt of rice, authorised by AA, reaches port

The consignment of rice weighing 19 metric tonnes arrived at Teknaf land port on Tuesday evening with the documents sealed and signed by the Arakan Army

4h ago