পোড়া রোগীর চিকিৎসা: ডিম মাখানো যাবে না, যা করা দরকার

দেশে ২০২৪ সালে দিনে গড়ে ৭৩টি করে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। ফায়ার সার্ভিসের এই হিসাব অনুযায়ী, গত বছর আগুনে অন্তত ১৪০ জন নিহত ও ৩৪১ জন আহত হয়েছেন। এর বাইরেও বহু মানুষ চুলা ও গ্যাসসংক্রান্তসহ বিভিন্ন ছোটবড় দুর্ঘটনায় দগ্ধ হন।
মানুষ বিভিন্নভাবে পুড়ে আহত হতে পারেন। সাধারণত আগুনের শিখা, গরম পানি, গরম তেল এবং উত্তপ্ত ধাতব পদার্থের সংস্পর্শ, যেমন—মোটরসাইকেলের সাইলেন্সারে লেগে মানুষ বেশি দগ্ধ হন। এর বাইরে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে, বজ্রপাতে, অ্যাসিড ও ক্ষারের সংস্পর্শে এসেও মানুষ দগ্ধ হয়।

পোড়া স্থানের প্রাথমিক চিকিৎসা
যেকোনো ধরনের পোড়ার ক্ষেত্রে হাসপাতালে পৌঁছানোর আগে কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে পারলে খুবই ভালো হয়। এতে রোগীকে পরবর্তী চিকিৎসা দিতেও সুবিধা হয় এবং রোগী দ্রুত সুস্থ হয়।
প্রাথমিক কাজ ও চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে—দ্বগ্ধ ব্যক্তিকে আগুনের উৎস থেকে উদ্ধার করে পোড়া স্থানে কমপক্ষে ১০ মিনিট স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানি ঢালতে হবে। দগ্ধ হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে এটা করতে পারলে ভালো।
যা করা যাবে না
কুসংস্কার কিংবা প্রচলিত ভুল ধারণা থেকে অনেক সময় এমন কিছু কাজ করা হয়, যা দগ্ধ রোগীদের জন্য উল্টো ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেগুলো করা থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
দগ্ধ স্থানে বরফ বা বেশি ঠান্ডা পানি ব্যবহার করা যাবে না। টুথপেস্ট, ডিমের সাদা অংশ, চুন, দূষিত কোনো তরল বা কাদামাটি লাগানো যাবে না।
পোড়া রোগীর ওষুধ
দগ্ধ ব্যক্তিকে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। এর বাইরে কিছু ওষুধ আছে যেগুলো প্রেসক্রিপশন ছাড়াও প্রাথমিকভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। শুধুমাত্র ব্যথার ওষুধ হিসেবে প্যারাসিটামল দেওয়া যেতে পারে। সেই সঙ্গে ওরস্যালাইন খাওয়াতে হবে। সিলভার সালফাডায়াজিন ১% ক্রিম পোড়া ক্ষতস্থানে লাগিয়ে পরিষ্কার গজ কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে রাখতে হবে।
চিকিৎসা
সব ধরনের পোড়া রোগীর চিকিৎসা এক রকম হয় নয়। পূর্ণ বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে দগ্ধের পরিমাণ ১৫ শতাংশ বা তার বেশি হলে হাসপাতালে ভর্তি করেই চিকিৎসা দিতে হবে।
অল্প বয়স্ক বা ১২ বছরের কম বয়সীদের ক্ষেত্রে দগ্ধ স্থান ১০ শতাংশ বা তার বেশি হলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।
শ্বাসনালী দগ্ধ হলে রোগীকে ১০০ শতাংশ অক্সিজেন দিতে হয় এবং কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যবস্থা করতে হয়। এ ক্ষেত্রে রোগীর নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র অর্থাৎ আইসিইউতে রেখে চিকিৎসার দরকার হয়।
হাসপাতালে চিকিৎসকরা রোগীর অবস্থা অনুযায়ী চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।
দগ্ধ রোগীর শারীরিক জটিলতা
দগ্ধ রোগীদের শরীরে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। শরীরে রক্তরস কমে যাওয়ার কারণে রোগী শকে চলে যেতে পারে। রক্তে লবণের মাত্রার তারতম্য হতে পারে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় 'ইলেক্ট্রোলাইট ইমব্যালেন্স'। এই পরিস্থিতিতে খুব দ্রুত রোগীর অবস্থার অবনতি ঘটতে পারে।
আমাদের ত্বক বাইরের রোগজীবাণু শরীরে ঢুকতে দেয় না। দগ্ধ রোগীর ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তারা সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকেন।
আগুনে শ্বাসনালী ক্ষতিগ্রস্ত হলে কন্ঠস্বরের পরিবর্তন হতে পারে। এর বাইরে, পোড়াস্থানে দীর্ঘমেয়াদী দাগ হতে পারে। হাত, পা ও গিরার কাছে দগ্ধ হলে গিরা বেঁকে যেতে পারে।
স্কিন গ্রাফটিং
দগ্ধ রোগীদের ত্বক প্রতিস্থাপন বা স্কিন গ্রাফটিং দরকার হতে পারে। এক্ষেত্রে একই ব্যক্তির শরীরের ভিন্ন স্থান থেকে ত্বক নিয়ে ক্ষতস্থানে প্রতিস্থাপন করা হয়। এ ক্ষেত্রে সাধারণত অন্য মানুষের ত্বক নেওয়া হয় না। বর্তমানে বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তি, বায়োলজিক্যাল ড্রেসিং সামগ্রী সুলভ থাকায় মাছের ত্বক ব্যবহার করা হয় না।
বাংলাদেশে দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসা
দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসায় বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। দেশেই সব ধরনের পোড়া রোগীর চিকিৎসা হয়।
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট ছাড়াও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ দেশের বড় ১৪টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বার্ন ইউনিট আছে। এসব হাসপাতালে বার্নের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন। তারা নিয়মিতভাবে বার্ন ও প্লাষ্টিক সার্জারির রোগী দেখছেন এবং তাদের প্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার করছেন।
হাইপারবেরিক অক্সিজেন থেরাপিসহ অনেক উন্নত চিকিৎসা সুবিধা আছে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে।
হাসপাতাল থেকে ফেরার পর
দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ফলোআপে আনতে হবে। তা না হলে দীর্ঘমেয়াদে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
তবে পোড়া রোগীর চিকিৎসায় জনসচেতনতা ও প্রতিরোধই সর্বোত্তম উপায়।
ডা. নুরুল আলম: শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি বিশেষজ্ঞ, সার্জন এবং বিভাগীয় প্রধান
Comments