কানে শোঁ শোঁ শব্দ হয় কেন, চিকিৎসা কী

টিনিটাস
ছবি: সংগৃহীত

চারদিকে সুনসান নীরবতা অথচ আপনার কানের ভেতর অবিরাম শব্দের আনাগোনা। ভাবুন তো একবার কেমন হবে সেই অনুভূতি? আর যদি তা বয়ে চলতে হয় সারাজীবন? কানের মারাত্মক এই সমস্যার নাম টিনিটাস, যা আপনার জীবন দুর্বিষহ করার জন্য যথেষ্ট।

টিনিটাস সম্পর্কে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেড-নেক সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. হাসানুল হক নিপুন।

কানে কানে শোঁ শোঁ শব্দ হয় কেন

ডা. হাসানুল হক বলেন, অনেকের কানের ভেতর শোঁ শোঁ, ভোঁ ভোঁ, বাঁশি বাজানো, অনেক সময় ক্লিক ক্লিক বা গর্জনের মত শব্দ সবসময় হতে থাকে। এটি মারাত্মক একটি সমস্যা, যাদের একবার হয় সহজে ভালো হতে চায় না। সারাজীবন এই সমস্যা বয়ে বেড়াতে হয়। একা, নিস্তব্ধ, নিরিবিলি স্থানে থাকলে কানের ভেতরে শব্দ বেশি প্রকট হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানে কানের এই সমস্যাকে বলা হয় টিনিটাস। টিনিটাস ২ ধরনের।

সাবজেক্টিভ টিনিটাস: এক্ষেত্রে রোগী নিজের কানের ভেতরে শব্দ নিজে শুনতে পান। বাইরে থেকে আশপাশের কেউ তা শুনতে পান না।

অবজেক্টিভ টিনিটাস: বাইরে থেকে কেউ যদি কান পাতেন তাহলে রোগীর সঙ্গে সেই ব্যক্তিও শব্দ শুনতে পাবেন।

বিভিন্ন কারণে কানে টিনিটাস হতে পারে। কানের তিনটি অংশ বহিঃকর্ণ, মধ্যকর্ণ এবং অন্তঃকর্ণ। এই তিনটি অংশের বিভিন্ন সমস্যা বা রোগের কারণে টিনিটাস হতে পারে।

বহিঃকর্ণজনিত সমস্যা

১. বহিঃকর্ণে যদি অতিরিক্ত কানের ময়লা থাকে।

২. হঠাৎ বোমা বিস্ফোরণ বা উচ্চ শব্দজনিত কোনোকিছুর সংস্পর্শে থাকার ফলে কানের সমস্যা হওয়ার পর টিনিটাস হতে পারে।

৩. দীর্ঘদিন যাদের উচ্চ শব্দের মধ্যে কাজ করতে হয় তাদেরও এই সমস্যা হতে পারে।

৪. যাদের বয়স বেশি এবং শ্রবণশক্তি কম তাদের টিনিটাস হতে পারে।

৫. মাথা বা ঘাড়ে আঘাতজনিত কোনো সমস্যার কারণে হতে পারে।

মধ্যকর্ণজনিত সমস্যা

১. অটোস্কলেরোসিস নামক একটি রোগ আছে যার ফলে কানের তিনটি হাড় ম্যালিয়াস, ইনকাস ও স্টেপিস একটা আরেকটার সঙ্গে লেগে যায়, শক্ত হয়ে যায়। আর মধ্যকর্ণের অস্থি তিনটি নড়াচড়া না করলে টিনিটাস হতে পারে।

২. সংক্রমণ থেকে কানের ভেতর পানি জমলে, কান পাকা রোগ হলে, কানের পর্দায় ছিদ্র থাকলে টিনিটাস হতে পারে।

৩. কানে কোনো দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণ থাকলে, আবার অ্যাকিউট অটাইটিস মিডিয়া অর্থাৎ হঠাৎ করে কানে কোনো সংক্রমণের কারণে হতে পারে।

অন্তঃকর্ণজনিত সমস্যা

১. কানে ছোট ছোট তিনটি টিউব আছে যেখানে এক ধরনের ফ্লুইড আছে। সেই ফ্লুইডের প্রেশার যদি বেড়ে যায় তাহলে মিনিয়ার্স ডিজিজ নামক রোগ হয়। আর এই মিনিয়ার্স ডিজিজের কারণে টিনিটাস হতে পারে।

২. চোয়ালের হাড়ে টেম্পোরোম্যান্ডিবুলার জয়েন্টে যদি কোনো ইনফেকশন থাকে বা আঘাত পান কেউ তাহলে হতে পারে।

৩. মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন কম হলে হতে পারে।

৪. ভেস্টিবুলোকোক্লিয়ার নার্ভে যদি কোনো ডিজিজ থাকে, এই নার্ভের আশপাশে যদি কোনো টিউমার হয়।

এ ছাড়া অন্যান্য কিছু রোগের কারণেও টিনিটাস হওয়ার ঝুঁকি থাকে। যেমন- যাদের ডায়াবেটিস আছে, উচ্চ রক্তচাপ, কার্ডিওভাস্কুলার বিভিন্ন ডিজিজ, সিভিয়ার অ্যানিমিয়া, হরমোনের সমস্যা, অটোইমিউন ডিজিজ, রিউমাটয়েট আর্থ্রাইটিসে যারা আক্রান্ত, যারা অতিমাত্রায় অ্যালকোহল ও ধূমপান করেন তাদের টিনিটাস হওয়ার প্রবণতা থাকে। পুরুষদের মধ্যে টিনিটাসের ঝুঁকি বেশি।

টিনিটাসের চিকিৎসা

টিনিটাস এমন একটি রোগ যার সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব নয়। টিনিটাসের চিকিৎসা তিনভাবে দেওয়ার কথা বলেন ডা. হাসানুল হক। টিনিটাস কী কারণে হচ্ছে প্রথমে সেটি শনাক্ত করতে হবে। যদি দেখা যায় কানের কোনো ইনফেকশন আছে, কানে ময়লা আছে সেকারণে টিনিটাস হচ্ছে তাহলে ওয়াক্স রিমুভ করে দিলে সুস্থ হয়ে যাবেন রোগী।

তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে টিনিটাসের সঠিক কারণ বুঝতে পারা যায় না। সেক্ষেত্রে রোগীকে টিনিটাস সম্পর্কে কাউন্সিলিং করতে হয়। কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

এ ছাড়া ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা দেওয়া হয়। মস্তিষ্কে ব্লাড সার্কুলেশন কমের কারণে টিনিটাস হয়, সেজন্য ব্লাড ফ্রো বাড়ানোর জন্য ওষুধ দেওয়া যেতে পারে।

থেরাপি এবং ওষুধে কাজ না হলে রোগীদের শ্রবণসহায়ক যন্ত্র ব্যবহার করতে বলা হয়। যেসব রোগী টিনিটাসের সঙ্গে কানে কম শোনেন তাদের জন্য শ্রবণসহায়ক যন্ত্রের সঙ্গে টিনিটাস মাস্কার ব্যবহার করতে বলা হয়। এই ডিভাইসটি ক্লিক ক্লিক ধরনের শব্দ করবে, যা কানের ভেতরের শব্দকে প্রশমিত করতে সাহায্য করবে।

এ ছাড়া কিছু সাউন্ড থেরাপি দেওয়া হয়। যেমন- রোগী যেন কখনো নিরিবিলি স্থানে না থাকেন, যে ঘরে ঘুমাবেন সেখানে টিক টিক আওয়াজ করে এমন ঘড়ি রাখা, টেবিল ঘড়ি মাথার কাছে রেখে ঘুমানো, ধ্যান করা, মিউজিক বা ফ্যান ছেড়ে ঘুমানো। এক ধরনের বিশেষ বালিশ পাওয়া যায় যেটা থেকে শব্দ বের হয়। সেটি ব্যবহার করলেও কানের ভেতরের শব্দ থেকে আরাম পাওয়া যাবে।

মানসিক জটিলতা ও প্রতিরোধ

ডা. হাসানুল হক বলেন, শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি টিনিটাস বিভিন্ন মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করে। যেমন- কানের ভেতর অবিরাম শব্দের কারণে আক্রান্ত ব্যক্তির ভালো ঘুম হয় না, সবসময় অবসাদগ্রস্ত থাকেন, মাথা ব্যথা, হতাশা, উদ্বেগ, বিষণ্নতা, মানসিক চাপ বেড়ে যায়। কাজে মনোযোগ দিতে পারেন না, স্মৃতিশক্তি কমে যায়। পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে অশান্তি সৃষ্টি হয়। কানে অতিমাত্রায় শব্দ যাদের হয় তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা দেয়।

টিনিটাস প্রতিরোধের উপায় হিসেবে স্বাস্থ্য সচেতন থাকতে হবে। শব্দ দূষণ বেশি সেসব জায়গা এড়িয়ে চলতে হবে, হেডফোনে খুব জোরে গান শোনা যাবে না, উচ্চ শব্দ হয় এমন জায়গায় কাজের সময় এয়ার প্লাগ, বিভিন্ন সাউন্ড প্রটেক্টর ডিভাইস ব্যবহার করতে হবে। ক্যাফেইন গ্রহণ, অ্যালকোহল ও ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে। কানের রোগসহ টিনিটাসের ঝুঁকি হিসেবে কাজ করে যেসব রোগ, সেসব যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

Comments

The Daily Star  | English

65pc of suicide victims among students are teens: survey

Teenagers (aged 13-19) made up 65.7% of 310 students who died by suicide in 2024, according to a survey by Aachol Foundation.

57m ago