যে কারণে আলাস্কা আমার প্রিয় গন্তব্য

আলাস্কা

আপনি কি দূরে, বহু দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে চান? এতটাই দূরে যে সে জায়গা আমাদের চেনাজানা জগত থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন? যেখানে শুধু আছে বনানীর সৌন্দর্য আর গহীণ অরণ্য। এমন কোথাও গেলে তো সময়ও থমকে যায়। শুধু চোখের সামনের দৃশ্যগুলো থেকে যায়, চোখের সীমানায়। আমাদের জন্য এমন একটি জায়গা হচ্ছে আলাস্কা।

আলাস্কা ভ্রমণ

শারমিন আর আমি গত ১৭ বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি। এই সময়ে আমরা পা রেখেছি সব কটি মহাদেশের ১১৮টি দেশের সীমান্তে। খুঁজে পেয়েছি বিশ্বব্যাপী বৈচিত্র্য আর আশ্চর্য মেশানো বহু সৌন্দর্যের ভাণ্ডার। আমরা প্রায়ই একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হই। এত এত জায়গার মধ্যে আমাদের সবচেয়ে প্রিয় কোনটি? এর উত্তরটা কিন্তু অত সহজ নয়। কেননা পৃথিবীর আনাচে-কানাচে লুকিয়ে আছে ভিন্ন ভিন্ন জাদুর পরশ। তাই একটিমাত্র গন্তব্য খুঁজে নেওয়াটা আমাদের জন্য দুঃসাধ্যই মনে হয়েছে। কিন্তু আলাস্কার কথা মনে এলে সব ভ্রান্তি দূরে সরে যায়। দুজনেই মাথা পেতে স্বীকার করি, প্রিয় গন্তব্যের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করছে আলাস্কা।

আলাস্কা ভ্রমণ

উত্তর মেরুর কাছাকাছি এই স্বর্গভূমিতে আমাদের প্রথম যাত্রাটা খুবই উপভোগ্য ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সমভূমি থেকে আলাস্কা এতটাই বিচ্ছিন্ন যে মনে হয় অন্য কোনো গ্রহে চলে এসেছি। এর বিশালতার কোনো তুলনা হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের মোট সমভূমির এক-পঞ্চমাংশের সমান এর বিস্তৃতি। এখানে আছে ৩ হাজারের বেশি নদী, ৩০ লক্ষ লেক আর হাজারের বেশি হিমবাহ। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এখানকার বন-জঙ্গল আসলেই অন্য মাত্রার। একেবারে আদিম আর গহীন। পাহাড়, হিমবাহ আর অরণ্যের মেলবন্ধনে আলাস্কার রূপের শেষ নেই।

আলাস্কার বিচ্ছিন্নতা একে আরো বিশেষ করে তোলে। এই রাজ্যের আকাশে সূর্য মাসের পর মাস ধরে গোলাপি-কমলা রঙের ক্যানভাস এঁকে যায়। এখানকার বাতাসেও যেন অন্যরকম আমেজ, প্রকৃতির খুব কাছে থাকার কথা বারবার মনে করিয়ে দেয়। আধুনিক জীবনের থেকে দূরের কোনো স্মৃতিতে প্রকৃতির জাদু মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় আর আলাস্কার প্রতি মুগ্ধতা বেড়েই চলে।

প্রথমবার যখন আলাস্কায় যাই, তখন বড় বড় সব রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। এতে করে এই রাজ্যের বিশালতা আরো বেশি চোখে পড়ছিল। আকাশের দিকে তাকালেই আমাদের মুগ্ধতাও আকাশ ছুঁচ্ছিল। একটি ছোটখাটো এয়ারক্রাফটে করে উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে উঁচু পর্বত দেনালির চূড়ার আশেপাশে ঘুরপাক খেতে দারুণ লেগেছিল। নিচের দৃশ্যাবলীর মধ্যে ছিল বরফে ঢাকা পাহাড়-পর্বত, বিশাল সব হিমবাহ আর জমে থাকা নদী। ৪ হাজার ফুট উঁচু থেকে আমরা যখন হিমবাহে পা রাখলাম, তখন মনে হলো আমাদের আশেপাশের দৃশ্য বাস্তবের চেয়ে একেবারেই আলাদা, একেবারে পরিশুদ্ধ কোনো স্বপ্নের মতো। সে মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল, এ জীবনে এর চেয়ে বেশি সুন্দর দৃশ্য আমি কখনো দেখিনি। আমার জন্য সময় তো সেখানেই থেমে গিয়েছিল।

আলাস্কা ভ্রমণ

 

এমন দৃশ্যের জন্য সবকিছুই ফেলে আসা যায়। মনের গহীনে আজীবন থেকে যাবার মতো দৃশ্যের কারুকাজ।

আলাস্কায় যখন দ্বিতীয়বার গেলাম, সেই যাত্রাটা একেবারেই অপরিকল্পিত ছিল। সেই সময়ে, ৮ হাজার মাইল দূরে, বাংলাদেশে আমার মা চিরতরে চলে গিয়েছিলেন। বহুদিন ধরেই দুরারোগ্য অসুখে ভুগছিলেন। আমি জানতাম যে সময় চলে এসেছে। কিন্তু তবুও এই অভিজ্ঞতার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পারিনি কোনোদিন। কিছুদিন পর জানতে পারলাম, আমি তাকে হারিয়ে ফেলেছি। এরপর বাংলাদেশেও কোভিড-১৯ মহামারির জন্য আন্তর্জাতিক সব দুয়ার বন্ধ করে দেয়া হয়। তাই মায়ের কাছে ফেরা আর হলো না। তখন আমি আলাস্কার দিকে ছুটে যাই। মায়ের স্মৃতি আর নিজেকে ঘিরে তার সর্বাঙ্গীন উপস্থিতিটা অনুভব করতে একা থাকাটা দরকার ছিল। তাই আমি এমন কোথাও যেতে চাচ্ছিলাম, যেখানে আমি একাকিত্বে ডুব দিতে পারব।

আলাস্কা ভ্রমণ

আলাস্কার গহীনে যাত্রা শুরু করার পর আমার মনে হচ্ছিল, মায়ের সঙ্গে সংযোগটা আরো গাঢ়ভাবে অনুভব করতে পারছি। আশপাশের শান্ত পরিবেশ, আকাশছোঁয়া পর্বতসারি, বরফে ঢাকা নদী- সবই যেন আমাকে তার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। আমার মা, যার মনে দয়ামায়ার কোনো শেষ ছিল না। যে সবসময় জীবনে আমাকে এগিয়ে যাওয়ার রাস্তা দেখিয়েছেন, যে আমাকে শক্ত হতে শিখিয়েছেন। তার কাছেই তো আমার ভালোবাসা আর জীবনের অনুসন্ধানের প্রথম পাঠ নেওয়া। তিনিই তো আমাকে জীবনের যাত্রায় হাতেখড়ি দিয়েছিলেন। গন্তব্য নয়, পথেই আনন্দ- এ কথাও আমি মায়ের কাছ থেকেই জেনেছি। তাই আলাস্কার বিশালতায় গাড়ি যত এগোচ্ছিল, আমি যেন আমার মায়ের দেখানো পথে এগিয়ে যাচ্ছিলাম।

আলাস্কার দৃশ্যাবলী আর স্মৃতিগুলো যেন যাত্রার অংশ হয়ে গিয়েছিল। প্রতি মাইলে আমি আমার মাকেই ভেবে যাচ্ছিলাম। কেমন করে আমার প্রতি তার আজীবন ভালবাসা আর দিক-নির্দেশনায় আমি বহু অন্ধকার সময়েও আলো খুঁজে পাই, সে কথাই ভাবছিলাম।

আলাস্কায় আমি এমন এক শান্তি খুঁজে পেয়েছিলাম, যাতে বিচ্ছিন্নতার মধ্যেও আমি আমার আত্মার সঙ্গে সংযোগ অনুভব করতে পেরেছি। আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটো জিনিস- প্রকৃতির প্রতি আমার ভালোবাসা আর মায়ের স্মৃতিকে সঙ্গে নিয়ে আমি পথ চলছিলাম। মনে হয়েছিল, প্রকৃতি তার আদরে ঢাকা চাদরে আমাকে মুড়িয়ে নিয়েছে।

আলাস্কা
 

আলাস্কা আমার জন্য কেবল একটি জায়গা নয়; বরং প্রকৃতির এমন একটি অংশ যা আমাকে সারিয়ে তোলে, এমনভাবে আমাকে পরিপূর্ণ করে- যা অন্য কোনো জায়গায় সম্ভব নয়।

আলাস্কা অজানাকে জানার সাহস জোগায়, ব্যক্তির মনকে মুক্ত করে তোলে। কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভুলে যাওয়া যায় পৃথিবীর হাজারো প্রত্যাশা। নিজের খুঁতগুলোকে নিয়ে গর্বভরে বাঁচতে শেখায়। নিজের থেকেও বিশাল কিছুর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয় আলাস্কা।

আমি আমার পথচলা থামাব না। কারণ আমার কাছে জীবন মানে গন্তব্য নয়, পথের আনন্দ। এর মধ্যে যাদের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়, তারা পথেরই অংশ। কেউ আমাদেরকে গতিশীল করে তোলে, কেউবা আনন্দ দেয়, কেউবা শ্লথগতিতে হেঁটে বেড়াতে শেখায়।

লোকে বলে, আলাস্কা নাকি পৃথিবীর শেষ সীমানা। আমার কাছে তো এই সীমানাই আমাকে আমার আত্মার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। আলাস্কা আমার প্রিয় গন্তব্য, আমার পুণ্যভূমি।

অনুবাদ করেছেন অনিন্দিতা চৌধুরী

 

Comments

The Daily Star  | English
yunus tarique meeting begins in london

Yunus-Tarique meeting ongoing

Amir Khosru, Humayun Kabir accompany the BNP acting chairperson to The Dorchester

1h ago