সম্রাট আকবরের সমাধিসৌধ: কী দেখবেন, কীভাবে যাবেন
মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যতম শাসক জালালউদ্দিন মুহাম্মদ আকবর, যাকে আকবর দ্য গ্রেট বলা হয়। ইতিহাসে যার নাম উচ্চারিত হয় সর্বশ্রেষ্ঠ মুঘল শাসক হিসেবে।
মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম সম্রাট বাবরের নাতি আকবর। ১৫৫৬ সালে দ্বিতীয় সম্রাট বাবা নাসিরুদ্দিন হুমায়ুনের মৃত্যুর পর মাত্র ১৩ বছর বয়সে মুঘল মসনদে বসেন আকবর। প্রচণ্ড সাহস, দূরদর্শিতা আর বুদ্ধিমত্তায় ভারতীয় উপমহাদেশকে ঘিরে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন তিনি। শাসনামলে একের পর এক সামরিক বিজয়, সামাজিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষকতা, উদার ধর্মনীতির মাধ্যমে সাম্রাজ্যকে করেন সুসংহত।
১৫৫৬ সাল থেকে ১৬০৫ সাল অবধি ৪৯ বছরের শাসনামলে গুজরাট, কাশ্মীর এবং দাক্ষিণাত্যসহ উত্তর ও মধ্য ভারতের অধিকাংশ এলাকা জয় করেন। বাংলা, বিহারও জয় করেছিলেন আকবর। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, স্থাপত্য এমনকি বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সম্রাট আকবর। স্থাপত্যকলার অপূর্ব নিদর্শন পাওয়া যায় তার শাসনামলে, দীন ই ইলাহী নামে নতুন বিশ্বাসের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সাহসী, দয়ালু আবার ইস্পাতের মতোই কঠিন মনোবলের অধিকারী ছিলেন এই শাসক।
সম্রাট আকবরের সমাধি কমপ্লেক্স
১৬০৫ সালে উত্তর প্রদেশের আগ্রার ফতেহপুর সিক্রিতে মারা যান সম্রাট নাসিরুদ্দিন মুহম্মদ হুমায়ুন ও হামিদা বানু বেগমের প্রিয় পুত্র আকবর। উত্তর প্রদেশের আগ্রার সিকান্দ্রায় একটি সমাধিসৌধে শায়িত তিনি।
জীবদ্দশায় নিজের সমাধিসৌধের কাজ শুরু করেন আকবর, মৃত্যুর পর তার পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীর এর কাজ সম্পন্ন করেন। চারবাগ বিশিষ্ট বাগানের মাঝখানে লাল বেলেপাথর ও সাদা মার্বেলে মোড়ানো মূল সমাধিসৌধটি স্থাপত্যশৈলীর এক অপূর্ব নিদর্শন।
আকবরের সমাধিসৌধের প্রবেশদ্বার
১১৯ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত সিকান্দ্রায় আকবর সমাধি কমপ্লেক্স। আকবরের সমাধিস্থলের চারদিকে একই আদলে চারটি ফটক রয়েছে, যদিও দক্ষিণের ফটকটিই সমাধি কমপ্লেক্সের প্রবেশদ্বার। লাল বেলেপাথর ও সাদা মার্বেলের কাঠামো সবধর্মের সমন্বয়ে বিভিন্ন মোটিভে সজ্জিত।
ক্যালিগ্রাফিক, ফুলেল, জ্যামিতিক নকশায় অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক এটি। ছত্রিসমেত মার্বেলের চারটি মিনার আছে, যার অনুকরণ তাজমহলেও দেখা যায়। মাঝখানে একটি বড় খিলান রয়েছে সমাধিস্থলে যাওয়ার।
আকবরের সমাধিসৌধ
মূল সমাধি ভবনটি লাল বেলেপাথর ও সাদা মার্বেলের তৈরি একটি চার তলা কাঠামো। পিরামিডের ধাঁচে ধাপে ধাপে উপরের দিকে উঠে যাওয়া ভবনটির প্রতিটি স্তর ভিন্ন স্থাপত্যশৈলী ও মোটিভে নির্মিত। আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে সমাধির কেন্দ্রীয় গম্বুজটি। নকশা ও কারুকার্যে সব ধর্মের প্রতি আকবরের ধর্মীয় সহনশীলতা ও শ্রদ্ধারই প্রতিনিধিত্ব করছে সমাধিসৌধটি।
সমাধিকক্ষের প্রবেশদ্বার ও সেনোটাফ
সোনালি, নীল ও সবুজ রঙের সংমিশ্রণে আঁকা ও বহুমূল্য পাথরে সজ্জিত সম্রাট আকবরের সমাধি কক্ষের প্রবেশদ্বার ও গম্বুজের কারুকার্য নজর কাড়ার মতো। প্রবেশদ্বার পেরিয়ে অন্ধকার সুরঙ্গ দিয়ে ভেতরে একটি প্রায় অন্ধকার হল ঘরের ঠিক মাঝখানে সম্রাট আকবরের সেনোটাফ। সাদা মার্বেলে তৈরি সেনোটাফটি জটিল নকশা ও শিলালিপিতে খোদাইকৃত। সমাধির ঠিক উপরে একটি ঝাড়বাতি, যা একমাত্র আলোর উৎস। ভেতরে কথা বলা ও ছবি তোলা নিষেধ।
মুঘল ঐতিহ্য অনুযায়ী সমাধিসৌধের বেসমেন্টে সাত ফুট নিচে আসল সমাধিটি রয়েছে।
চার বাগ
বাগানকে ঘিরেই মুঘল স্থাপত্য দেখা যায়। আকবরের সমাধি কমপ্লেক্সও সুপরিচিত মুঘল বাগানের নকশায় তৈরি, যেখানে রয়েছে বাগান, ফোয়ারা ও জলপথ।
সম্রাট আকবর ছাড়াও তার দুই কন্যাসহ আরও কিছু মুঘল সদস্যের কবর রয়েছে সমাধি কমপ্লেক্সে। মুঘলদের পারিবারিক সমাধিক্ষেত্র হিসেবেই এটি তৈরি করা হয়েছিল। এক তলার প্রতিটি কক্ষের ছাদ গম্বুজাকৃতির, যার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আওয়াজ করলে প্রতিধ্বনি হয়, যা অত্যন্ত আশ্চর্যের পর্যটকদের কাছে।
কথিত আছে, সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে আকবরের সমাধিতে হামলা চালায় জাঠ বিদ্রোহে অংশ নেওয়া সেনারা। সমাধিস্তম্ভ থেকে আকবরের হাড়গোড় বের করে আগুনে পুড়িয়ে ফেলে এবং সমাধি লুট করে। যদিও স্থানীয় পর্যটক এবং দর্শনার্থীরা মনে করেন, এখানেই শায়িত সম্রাট আকবর।
কখন যাবেন
যদিও অধিকাংশ দর্শনার্থীর কাছে আগ্রার মূল আকর্ষণ তাজমহল, অনেকেই হয়তো জানেন আগ্রাতেই শায়িত আকবর দ্য গ্রেট। তাজমহল, ফতেপুর সিক্রি, আগ্রা ফোর্টের পাশাপাশি ঘুরে আসতে পারেন সিকান্দ্রায় আকবর সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স।
ভ্রমণের জন্য বছরের যেকোনো সময় যেতে পারেন, তবে অক্টোবর থেকে মার্চ মাস ভালো সময়। বিশেষ করে শীতকালের আবহাওয়া স্বাচ্ছন্দ্যদায়ক পর্যটকদের জন্য। দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের জন্য রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন প্রবেশমূল্য। শুক্রবার বাদে প্রতিদিন ভোর ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে সমাধি কমপ্লেক্স।
কীভাবে যাবেন
যাওয়ার জন্য ভারতে ভ্রমণের ভিসা থাকা বাধ্যতামূলক। রেলপথে কলকাতার শিয়ালদহ বা হাওড়া স্টেশন থেকে আগ্রা যাওয়ার সরাসরি ট্রেন আছে। এ ছাড়াও ট্রেনে কলকাতা থেকে দিল্লি হয়ে আগ্রা যাওয়ার ট্রেন আছে।
উড়োজাহাজে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি নয়াদিল্লি গিয়ে সেখান থেকেও ট্রেন কিংবা বাসে আগ্রা যাওয়া যেতে পারে।
আগ্রা থেকে প্রাইভেট ক্যাব অথবা সিএনজিচালিত অটোরিকশা বুক করে একদিনেই অনায়াসে ঘুরে আসতে পারেন সিকান্দ্রায় আকবরের সমাধি কমপ্লেক্স।
Comments