সোনাদিয়া দ্বীপে কীভাবে যাবেন, কী দেখবেন
বাংলাদেশের উপকূল থেকে বিশাল জলরাশির ওপর বঙ্গোপসাগরের বিস্তৃত বুককে আশ্রয় করে আছে বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলো। চর নামের প্লাবনভূমিগুলো অঙ্গে ধারণ করে আছে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের পলিমাটিকে। এমনি শত শত দ্বীপের মাঝে অন্যতম একটি দ্বীপ সোনাদিয়া।
সমুদ্র-বিলাসীদের এই প্রিয় গন্তব্যে পাড়ি জমাতে চলুন এই দ্বীপাঞ্চলে ভ্রমণ নিয়ে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
সোনাদিয়ার ভৌগলিক অবস্থান
বাংলাদেশের জনপ্রিয় পর্যটন স্থান কক্সবাজার থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত মহেশখালী। এই উপজেলার অন্তর্গত কুতুবজোম ইউনিয়নের ছোট্ট একটি দ্বীপ সোনাদিয়া। প্রায় ৯ বর্গকিলোমিটারের এই দ্বীপটি একটি খালের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন হয়েছে মহেশখালী দ্বীপ থেকে।
ভূতত্ত্ববিদ ও ভূগোলবিদদের মতে, বাঁকখালী নদীর স্রোতধারা ও মহেশখালী প্রণালীর সঙ্গে সাগরের ঢেউয়ের সংঘর্ষে এই দুই এলাকার ঠিক মাঝে বালি জমে জমে জন্ম নিয়েছে সোনাদিয়া দ্বীপ।
সোনাদিয়া দ্বীপের নামকরণের ইতিহাস
১০০ থেকে ১২৫ বছর আগে সাগরের মাঝে জেগে ওঠা এই চরে মানুষের বসতি গড়ে উঠে। এরই মাঝে এ দ্বীপের সঙ্গে জড়িয়ে যায় রোমাঞ্চকর সব ঘটনা।
কেউ কেউ বলেন, এক সময় এক বিদেশি জাহাজ মহেশখালীর উপকূলের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় পর্তুগিজ জলদস্যুদের কবলে পড়ে। মালবাহী এই বাণিজ্যিক জাহাজে ছিল প্রচুর পরিমাণ সোনা। নাবিকদের সঙ্গে জলদস্যুদের সংঘর্ষে পুরো জাহাজটি সাগরের নিচে তলিয়ে যায়। পরে এই দুর্ঘটনাস্থলে বালি ও পলি জমে আস্ত এক দ্বীপের সৃষ্টি হয়। সোনাবাহী জাহাজডুবির ঘটনার কারণে স্থানীয় জেলেদের মাঝে দ্বীপটি স্বর্ণদ্বীপ বা সোনাদিয়া দ্বীপ নামে পরিচিতি পায়।
এই জায়গাটি নিয়ে লোকমুখে আরও মজার মজার গল্প শোনা যায়। প্রচলিত আছে, প্রায় পৌনে ৩০০ বছর আগে লুতু বহদ্দার নামের এক জেলের জালে এক অদ্ভুত ও রহস্যময় পাথর ধরা পড়ে। পাথরটি তিনি সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে আসেন এবং তা ঘরে ঢোকার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে।
একদিন এক নাপিত এই সিঁড়িতে বসে কাঁচিতে ধার দেওয়ার সময় অসাবধানতায় পাথরটি ভেঙে ফেলেন। আর সঙ্গেসঙ্গেই তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে একটি স্বর্ণমুদ্রা। র বহদ্দার ও নাপিত সেই স্বর্ণমুদ্রা বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেন। লুতু বহদ্দার যে স্থানে জাল ফেলেছিলেন সেটি ছিল মূলত একটি চরের সৈকত। আর সেই চরটিই আজকের সোনাদিয়া দ্বীপ।
আবার কেউ কেউ মনে করেন, এক সময় এখানে মুক্তার চাষ হতো। সেই মুক্তা কেনা-বেচা হতো সোনার দামে। আর এই কারণেই দ্বীপের নামকরণ করা হয় সোনাদিয়া।
সোনাদিয়া দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য
ছোট-বড় খাল সমৃদ্ধ এই দ্বীপের আরও একটি নাম প্যারাদ্বীপ। তিন দিকে সমুদ্র ঘেরা এই চরাঞ্চলের বিশেষত্ব হচ্ছে ম্যানগ্রোভ বন এবং দুর্লভ জীববৈচিত্র্য।
রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে সৈকতে লাল কাকড়ার বিচরণ এক অদ্ভূত দৃশ্যের অবতারণা করে। শীতকালে বিপন্ন সামুদ্রিক কাছিমগুলো সাগর লতায় ঢাকা বালিয়াড়িতে আসে ডিম পাড়ার জন্য। বেলাভূমিতে পানির একদম কিনারা ঘেষে এদের ভিড় যেন সৈকতের প্রাকৃতিক অলঙ্করণ।
সোনাদিয়ার আরও একটি বিশেষত্ব হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব সৈকতের শুঁটকিপল্লী। সারা বছর ধরে এখানে উৎপাদিত শুঁটকি পাঠানো হয় দেশের বিভিন্ন বাজারে।
সোনাদিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের সেরা উপায় হচ্ছে এখানে ক্যাম্পিং করা। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সঙ্গে ভাগ্যগুণে যদি পূর্ণিমা রাত পাওয়া যায়, তাহলে এই ক্যাম্পিং হতে পারে জীবনের সেরা অভিজ্ঞতা।
শীতকালে সোনাদিয়ার সৈকতে মেলা বসে দেশি-বিদেশি জলচর পাখির। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- খোঁয়াজকৈতর, বদরকৈতর, সরুঠোঁটি গঙ্গাকৈতর, গুলিন্দা, টিটি জিরিয়া, মধুবাজ, কানি ও যাঠুয়া বক, নানা ধরনের চা পাখি, বালু বাটান, বাবুই বাটান, ডোরালেজ জৌরালি, কালোমাথা কাস্তেচরা এবং বিভিন্ন ধরনের গাঙচিল। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিরল প্রজাতির হচ্ছে চামচঠোঁটি বা কোদালঠোঁটি চা পাখি।
সোনাদিয়া ভ্রমণের সেরা সময়
নভেম্বর থেকে মার্চ অর্থাৎ শীতের শুরু থেকে বসন্তকাল পর্যন্ত সোনাদিয়া ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে ভালো সময়। এই সময়টাতে দ্বীপের পরিবেশ ও আবহাওয়া ভ্রমণের জন্য বেশ অনুকূল থাকে। এ ছাড়া অতিথি পাখি দেখার একমাত্র উপায় হচ্ছে শীতকালে বেড়াতে আসা। তাছাড়া বোনাস হিসেবে শীত-বসন্তজুড়ে এখানকার স্থানীয় উৎসবগুলো ভ্রমণে অতিরিক্ত আনন্দের সংযোজন ঘটাতে পারে।
ঢাকা থেকে সোনাদিয়া দ্বীপ যাওয়ার উপায়
সোনাদিয়া ঘুরতে যেতে হলে ঢাকা থেকে কক্সবাজার বা চকরিয়া পর্যন্ত যেতে হয়। তবে যেভাবেই যাওয়া হোক না কেন, মুল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় এ দ্বীপে পৌঁছার জন্য পানিপথ অতিক্রম করতে হয়। ঢাকার যে কোনো বাসস্ট্যান্ড থেকে কক্সবাজারগামী বাস ভাড়া পড়তে পারে মাথাপিছু ৯০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা।
ট্রেন ভ্রমণের ক্ষেত্রে সেরা মাধ্যম হলো কক্সবাজার এক্সপ্রেস। মঙ্গলবার বাদ দিয়ে সারা সপ্তাহ চট্টগ্রামে যাত্রা বিরতি দিয়ে কক্সবাজার পৌঁছে এই ট্রেন। সিটের ধরনভেদে টিকিট খরচ হতে পারে জনপ্রতি ৬৯৫ থেকে ১ হাজার ৩২৫ টাকা। তবে এটি বেশ সময় সাপেক্ষ ভ্রমণ। প্রায় ৯ ঘণ্টা লাগে রেলপথে কক্সবাজার যেতে।
সবচেয়ে কম সময়ে কক্সবাজার যাত্রার সেরা উপায় হচ্ছে আকাশপথ। এ উপায়ে মাত্র ১ ঘণ্টার মধ্যেই কক্সবাজার পৌছে যাওয়া যায়। তবে এক্ষেত্রে বিমান ভাড়া গুনতে হয় মাথাপিছু ৪ হাজার ৫৯৯ থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত।
কক্সবাজারে নামার পর ৬ নম্বর জেটিতে (কস্তুরী ঘাট) গিয়ে মহেশখালী দ্বীপের স্পিডবোট ধরতে হবে। এই বোটগুলো জনপ্রতি ৮০ টাকা ভাড়ায় আধঘণ্টার মধ্যেই মহেশখালী নামিয়ে দেয়। এবার মহেশখালী ঘাট থেকে রিকশা করে যেতে হবে গোরকঘাটা বাজারে। ভাড়া পড়বে ২৫ থেকে ৩০ টাকার মতো।
যতটা সম্ভব কম পানিপথ পার হতে চাইলে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক ধরে যাওয়ার সময় চকরিয়ায় নেমে যেতে হবে। সেখান থেকে জীপ বা সিএনজিচালিত অটোরিকশা করে বদরখালি হয়ে গোরকঘাটা বাজারে যাওয়া যায়।
গোরকঘাটা বাজার পর্যন্ত আসার পর অটোরিকশা বদলে যেতে হবে ঘটিভাঙায়। ভাড়া লাগবে জনপ্রতি ১৮০ থেকে ২০০ টাকা। এটি স্থলভাগের শেষাংশ, তাই এখান থেকে সোনাদ্বিয়া দ্বীপে যাওয়ার একমাত্র উপায় নৌকা।
ঘটিভাঙ্গা থেকে ইঞ্জিনচালিত বা খেয়া নৌকাগুলো সোনাদিয়া চ্যানেল পাড়ি দিয়ে সোনাদিয়া পৌঁছে দেয়। পশ্চিম সোনাদিয়া থেকে প্রতিদিন মাত্র একবার একটি ট্রলার আসে ঘটিভাঙ্গা পর্যন্ত। তারপর যাত্রী তুলে নিয়ে খুব কম সময়েই মধ্যেই আবার ফিরতি যাত্রা করে। এই যাত্রায় জনপ্রতি ৩০ টাকা ভাড়া লাগতে পারে। এই ট্রলারের আসা-যাওয়ার সময়টি মূলত জোয়ার ভাটার সময়ের ওপর নির্ভরশীল। সাধারণত এই সময়টি সকাল ১০টা বা এর আশপাশে হয়ে থাকে।
ঘটিভাঙ্গা থেকে সোনাদিয়ার পূর্ব পাড়া পর্যন্ত পায়ে হেঁটে যাওয়া যায়। কিন্তু এই যাত্রাটি বেশ কষ্টসাধ্য। তাছাড়া পূর্ব পাড়ায় বিশেষত দেখার কিছু নেই। সেখানে পর্যটকদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধারও ঘাটতি আছে। তাই সরাসরি পশ্চিম পাড়া চলে যাওয়াটাই ভালো।
আবার কক্সবাজার থেকে সরাসরি পশ্চিম পাড়া যাওয়া যায় ট্রলার বা স্পিডবোট রিজার্ভ নিয়ে। এক্ষেত্রে ভাড়া গুনতে হতে পারে প্রায় ৫ হাজার টাকার মতো।
থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা
পর্যটকদের জন্য এখনও এখানে তেমন কোনো হোটেল বা রিসোর্ট গড়ে উঠেনি। তাই দ্বীপে থাকা-খাওয়ার জন্য নির্ভর করতে হয় স্থানীয়দের ঘরবাড়ি বা ক্যাম্পিংয়ের ওপর।
আগে থেকে বলে নিলে স্থানীয়রাই তাদের বাড়িতে টাকার বিনিময়ে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। বন বিভাগ কর্তৃক্ষের অনুমতি নিয়ে তাদের অফিসেও থাকা যেতে পারে।
তবে দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে প্রাণ ভরে উপভোগ করার আদর্শ উপায় হচ্ছে ক্যাম্পিং করা।
আশপাশের দর্শনীয় স্থান
সোনাদিয়া যাওয়ার পথে মহেশখালী দ্বীপে রয়েছে দারুণ কিছু পর্যটন স্থান। সেখানে মৈনাক পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে আদিনাথ মন্দির, যেখান থেকে পাখির চোখে বঙ্গোপসাগর, ম্যানগ্রোভ বন, ও পানের বরজ দেখা যায়।
মহেশখালী জেটির কাছেই গোরকঘাটায় রয়েছে রাখাইনপাড়ার বৌদ্ধবিহার। এখানকার শুটিং ব্রিজটি ওপারের ঝাউবাগান ও চরপাড়া সৈকতের সঙ্গে এক নান্দনিক যোগসূত্র তৈরি করেছে। ব্রিজটি পাড়ি দেওয়ার সময় দুই পাশে চোখে পড়ে সুন্দরী বন, লবণের মাঠ, গোলপাতা ও পানের বরজ।
আর দ্বীপের ১ নম্বর জেটি ঘাটে পাওয়া যাবে এখানকার বিখ্যাত মিষ্টি পান।
কিছু সতর্কতা
- ক্যাম্পিংয়ের জন্য সোনাদিয়া দ্বীপের পশ্চিম পাড়া সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা এড়ানোর জন্য দ্বীপের পূর্ব পাড়ায় না যাওয়াই ভালো।
- ক্যাম্পিংয়ের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দ্বীপে পাওয়া যাবে না। তাই তাঁবু, মশারি, প্লাস্টিকের চাদর, ঘুমের ব্যাগ, কম্বল বা চাদর, খাবার, পানি, লাইট, প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং ক্যামেরা আগে থেকেই সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে।
- মশা ও পোকামাকড় নিরোধক এবং আগুন নির্বাপক সঙ্গে রাখা ভালো।
- ক্যাম্পিংয়ের জায়গা পরিষ্কার রাখা জরুরি।
- সাঁতার কাটতে যাওয়ার সময় সাগরের অবস্থা ভালোভাবে পর্যালোচনা করে নেওয়া আবশ্যক।
- এমন কোনো কাজ করা যাবে না, যাতে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হয়।
- দ্বীপবাসীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ বজায় রাখতে হবে।
সুপরিকল্পিত উপায়ে সোনাদিয়া দ্বীপ ভ্রমণ একটি অবিস্মরণীয় স্মৃতি হয়ে থাকতে পারে। দ্বীপবাসীদের বাড়িতে থাকার সময় তাদের জীবন-যাপনের যে অভিজ্ঞতা পাওয়া যাবে, তা বিলাসবহুল রিসোর্ট থেকেও পরম পাওয়া। শীত ও বসন্তের মাঝামাঝি সময়ে গেলে একই সঙ্গে দেখা যাবে শীতের পাখি ও স্থানীয়দের উৎসবগুলো।
একাধিক যানবাহনে চড়ে অবশেষে ঘটিভাঙ্গা থেকে নৌকায় ওঠার সময় এক অদ্ভূত অনুভূতি কাজ করবে। দৃষ্টি সীমানায় সোনাদিয়া দ্বীপের রেখাটা দৃশ্যমান হতেই মনে হবে, এতটা পথ পেরিয়ে আসার ধকলটা হয়ত এবার সার্থক হতে চলেছে।
Comments