বিভিন্ন উৎসবে ড্রোন শোয়ের জনপ্রিয়তা বাড়ছে কেন

২০২৪ সালের নববর্ষের রাতে নিউইয়র্কে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন আন্ডারউড দম্পতি। তাদের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার শেষে ছিল একটি চমক। এক-দেড়শ ড্রোন রাতের আকাশে উড়িয়ে বিভিন্ন রঙের আলোকচ্ছটায় বর-কনের ছবি ফুটে ওঠে।
মিস্টার আন্ডারউড বেসবলের ভক্ত হওয়ায় ড্রোন দিয়ে একজন বেসবল খেলোয়াড়ের বল মারার দৃশ্যও চিত্রণ করা হয়। তাছাড়া, একটি হীরার আংটি একটি আঙুলে পরানো হচ্ছে, এমন দৃশ্যও দেখানো হয় ড্রোনে।
বিবিসিতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিজেদের বিয়ের রাতের ড্রোন প্রদর্শনীর দৃশ্য এভাবে বর্ণনা করছিলেন আন্ডারউডের স্ত্রী।
তবে এরকম প্রদর্শনী এখন আর নতুন নয়। বিয়েসহ বিভিন্ন উৎসবে হরহামেশাই দেখা যায় ড্রোনের কীর্তি।
প্রযুক্তির উন্নতির ধারায় সবশেষ সংযোজনগুলোর মধ্যে অন্যতম এই ড্রোন প্রদর্শনী। এক সময় যা ছিল বিরল, এখন তা জন্মদিন, বিয়ে থেকে শুরু করে বড় বড় ক্রীড়া অনুষ্ঠানে পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। এমনকি কিছু থিম পার্কে নিয়মিতভাবে প্রতিদিন ড্রোন প্রদর্শনী হয়।
ইউরোপ-আমেরিকা জয় করে ভারতীয় উপমহাদেশেও তা ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এই তো সেদিন, পহেলা বৈশাখের সন্ধ্যায় ঢাকাতেও দেখা মিলল অভিনব এক ড্রোন প্রদর্শনীর। সেদিন জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার আকাশে জুলাই অভ্যুত্থানের থিমে ফুটিয়ে তোলা হয় নানা দৃশ্য। সেই সঙ্গে ছিল আরও কত কী!
২০২৪ সালে যুক্তরাজ্যের গ্লাস্টনবারি মিউজিক ফেস্টিভ্যালে প্রথম ড্রোন প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এরপর গত অক্টোবরে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ড্রোন প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় চীনে। এতে অংশ নেয় মোট ১০ হাজার ২০০টি ড্রোন, যা আগের মাসেই গড়া একটি রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিল।
'দ্য ড্রোন গার্ল' নামে পরিচিত ড্রোন পাইলট ও সাংবাদিক স্যালি ফ্রেঞ্চ বলেন, 'ড্রোন প্রদর্শনী অসাধারণ শিল্পকর্ম। বর্তমানে বেসবল খেলা, করপোরেট সম্মেলন এমনকি সমুদ্রবন্দরে নতুন ক্রুজ লঞ্চ উদ্বোধনের মতো অনুষ্ঠানেও ড্রোন প্রদর্শনী হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে এটি আরও উন্নত হয়ে উঠেছে।'
তিনি বলেন, 'কিছু প্রদর্শনীতে হাজার হাজার ড্রোন থাকে যা দিয়ে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে চিত্র বা অ্যানিমেশন তৈরি করা সম্ভব। আমি একবার একটি স্টার ওয়ার্স থিমের ড্রোন শো দেখেছিলাম, যেখানে পুরো একটি যুদ্ধ দেখানো হয়েছিল।'
স্যালির মতে, ড্রোন প্রদর্শনীর ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা হতে পারে খরচ। যুক্তরাজ্যে প্রতিটি ড্রোনের জন্য প্রায় ৩০০ ডলার (প্রায় ২২০ পাউন্ড), বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৩৬ হাজার টাকার বেশি খরচ হয় বলে জানান তিনি।
লাটভিয়াভিত্তিক বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান এসপিএইচ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ৫০০টি ড্রোনের একটি প্রদর্শনীর খরচ দাঁড়ায় ১ লাখ ৫০ হাজার ডলারের বেশি, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় দুই কোটি টাকা।
বিশ্বের অন্যতম বড় ড্রোন প্রদর্শনী কোম্পানি স্কাইম্যাজিকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সৃজনশীল পরিচালক প্যাট্রিক ও'মাহনি জানান, তারা এমন বড় বড় শো আয়োজন করেছেন, যেগুলোর খরচ ১০ লাখ ডলারের বেশি।
২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার কোচেল্লা মিউজিক ফেস্টিভ্যালসহ বিভিন্ন দেশে প্রদর্শনী করেছে স্কাইম্যাজিক। যুক্তরাজ্যে রাজা তৃতীয় চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠান উপলক্ষে অনুষ্ঠিত কনসার্টেও ড্রোন প্রদর্শনী করেছিল এই কোম্পানি।
আতশবাজি প্রদর্শনীসহ এ ধরনের অন্যান্য অনুষ্ঠান পরিকল্পনার অভিজ্ঞতাও রয়েছে প্যাট্রিকের। তিনি বলেন, ড্রোন প্রযুক্তি বাইরের জনসমাগমে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীতে বিপ্লব নিয়ে এসেছে।
প্যাট্রিক জানান, তার কোম্পানির নিজস্ব ডিজাইনের ৬ হাজার ড্রোনের বহর রয়েছে। ড্রোনগুলো প্রতি সেকেন্ডে সর্বোচ্চ ১০ মিটার পর্যন্ত গতি অর্জন করতে পারে। এসব ড্রোনে রয়েছে এলইডি লাইট ও ২৫ মিনিট পর্যন্ত উড়তে সক্ষম ব্যাটারি।
সহজে বহনের জন্য ড্রোনগুলো ফ্লাইট কেসে সংরক্ষণ করা হয় এবং অনুষ্ঠানস্থলে একটি বিশাল তাঁবুতে খোলা হয়, এরপর নির্ধারিত উড্ডয়ন স্থানে আধা মিটার ব্যবধানে গ্রিড আকারে সাজিয়ে রাখা হয়। ড্রোন শো চলাকালে একজন পাইলট মাটিতে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে হাজার হাজার ড্রোন নিয়ন্ত্রণ করেন।
প্যাট্রিক আরও জানান, ড্রোনগুলো জিও-ফেন্সড, অর্থাৎ গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমের (জিপিএস) তথ্যের ভিত্তিতে একটি নির্ধারিত উড্ডয়ন এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তবে বাতাস বেশি থাকলে এগুলো পথচ্যুত হয়ে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে ড্রোনগুলো সাধারণত স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্ধারিত অবতরণ স্থানে ফিরে আসে।
আতশবাজির সঙ্গে পার্থক্য
স্যালি ফ্রেঞ্চ বলেন, আতশবাজির যেটা 'বুম ফ্যাক্টর' (আগুনের ঝলকের মতো জ্বলে ওঠা), সাধারণত ড্রোনের তা থাকে না।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার-গবেষণা প্রতিষ্ঠান গার্টনারের বিশ্লেষক বিল রে জানান, কিছু ড্রোন এখন পিরোটেকনিকস (আতশবাজির মতো) ছুঁড়তে সক্ষম। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ড্রোনের তৈরি কোনো চিত্রের নিচের অংশ থেকে ঝরনার মতো আগুনের ঝলক নেমে আসা দেখানো সম্ভব।
বিল বলেন, ড্রোন শোতে সংগীতের সঙ্গে প্রতিটি ড্রোনের ক্রিয়া অত্যন্ত নিখুঁতভাবে মিলিয়ে দেওয়া সহজ। এই বিষয়টি ড্রোনকে আরও জনপ্রিয় করে তুলছে।
তবে খরচ এখনও অনেকের জন্য বাধা হয়ে রয়েছে বলে মনে করেন এই প্রযুক্তিবিদও। তার মতে, খরচ বেশি হওয়ার একটি বড় কারণ শোয়ের আগে ড্রোন সাজানো এবং পরে আবার সংগ্রহের প্রক্রিয়াটি এখনও ধীর ও হাতে ধরে তা করতে হয়।
ড্রোন শো অ্যানিমেশনস নামক একটি পর্তুগিজ প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পেদ্রো রোজারিও বলেন, তার কাজের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো এমন শো পরিকল্পনা করা যা বিভিন্ন দেশের ড্রোন উড্ডয়ন-সংক্রান্ত নিয়ম মেনে চলে।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, একেক দেশে ড্রোন ওড়ানোর নিয়ম একেক রকম। যেমন: ইংল্যান্ডে ড্রোন উড়ানোর নিয়ম মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের তুলনায় কঠোর।
পেদ্রো জানান, ড্রোন শোগুলো কখনো কখনো পিরোটেকনিকস বা প্রচলিত আতশবাজি বা এমনকি লেজার শোয়ের সঙ্গে মিলিয়েও করা যায়, যা সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে বড় সুযোগ এনে দিয়েছে।
তিনি বলেন, 'ড্রোন দিয়ে সত্যিই এমন কিছু তৈরি করা যায় যার আবেগীয় মূল্য আছে, চাইলে একেকটি গল্পও বর্ণনা করা যেতে পারে।'
এ কথাই বলছিলেন আন্ডারউডের স্ত্রী। তার মতে, 'আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে অনেকেই প্রশংসা করেছেন। তবে বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে বারবার যে প্রসঙ্গটি অনেকে তুলে এনেছেন, সেটা হলো ড্রোন শো। সেটি তাদের কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল।'
Comments