‘ভারত কীভাবে টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই ট্যাগ দাবি করতে পারে?’

টাঙ্গাইল শাড়ি
ছবি: স্টার

টাঙ্গাইল শাড়ির সঙ্গে বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার নাম জড়িয়ে আছে। এই শাড়ি বহু বছর ধরে আমাদের সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু তারপরও সম্প্রতি টাঙ্গাইল শাড়িকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই) হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, যা নিয়ে বাংলাদেশে প্রচুর বিতর্ক ও সমালোচনা হচ্ছে।

ভারতের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধান্তে উৎফুল্ল পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী সামাজিকমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) এক পোস্টে এ শাড়ির কারিগরদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, টাঙ্গাইল শাড়ি নদীয়া ও পূর্ব বর্ধমানের পণ্য।

এ ঘটনায় বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ থেকে সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞ, সবাই বিস্ময় ও হতাশা প্রকাশ করেছেন।

বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের উপ-মহাব্যবস্থাপক (এসসিআর) রতন চন্দ্র সাহা ডেইলি স্টারকে বলেন, তারা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। শিগগির এ বিষয়ে বৈঠক করবেন।

প্রতিথযশা শিল্পী এবং বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের সভাপতি চন্দ্র শেখর সাহা বলেন, 'টাঙ্গাইল জেলা বাংলাদেশের মধ্যে অবস্থিত এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই টাঙ্গাইলের শাড়ির ওপর আমাদের শক্ত দাবি রয়েছে। এটি অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে ভারত (এই শাড়ির) জিআই ট্যাগ পেয়েছে, তবে এখনও সব শেষ হয়ে যায়নি। আমরা এখনও জিআই ট্যাগ পেতে পারি।'

তিনি আরও বলেন, 'জিআই ট্যাগ কোনো দেশকে দেওয়া হয়, নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা সংস্থাকে নয়। তাই টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই ট্যাগ অর্জনের প্রক্রিয়া শুরু করা আমাদের সরকারের দায়িত্ব।'

হাতে বোনার অনন্য কৌশল, নকশা ও মোটিফের জন্য পরিচিত টাঙ্গাইল শাড়ি ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলায় উৎপাদিত হয়ে আসছে। এ জেলার কারিগররা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে শাড়ির বুনন পদ্ধতি উন্নত করেছেন, ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি সংরক্ষণ করেছেন এবং টাঙ্গাইল শাড়ির সাংস্কৃতিক পরিচয়ে অবদান রেখেছেন।

ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এই স্বীকৃতির সমালোচনা করে কয়েক দশক ধরে টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরি করে আসা কারিগর রঘুনাথ বসাক বলেন, 'প্রথমদিকে টাঙ্গাইলের শাড়িকে তাঁতের শাড়ি হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তবে আমার পূর্বপুরুষরা এই শাড়ি তৈরির জন্য উপযুক্ত জলবায়ুর সন্ধানে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। অবশেষে তারা টাঙ্গাইলে উপযুক্ত আবহাওয়ার সন্ধান পান এবং এভাবেই এই তাঁতের শাড়িগুলো টাঙ্গাইল শাড়ি নামে পরিচিতি লাভ করে।'

'ভারত কীভাবে টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই ট্যাগ দাবি করতে পারে?', প্রশ্ন তোলেন তিনি।

রঘুনাথ বসাক বলেন, 'পশ্চিমবঙ্গে তাঁতের শাড়ি মূলত নদিয়া এবং পূর্ব বর্ধমান জেলায় উৎপাদিত হয়। তাই তাদের উচিত এগুলোকে নদীয়া বা পূর্ব বর্ধমানের শাড়ি হিসেবে গণ্য করা, টাঙ্গাইল শাড়ি হিসেবে নয়।'

বাংলাদেশে টাঙ্গাইল শাড়ি বুননের অবিচ্ছেদ্য অংশ বসাক সম্প্রদায় দেশভাগের সময় ভারতে চলে যায়। রঘুনাথ বসাকের মতে, এর ফলে এ শাড়ির ঐতিহ্য বাংলাদেশ থেকে ভারতেও বিকশিত হয়।

প্রথম আলোর হাল ফ্যাশন বিভাগের কনটেন্ট কনসালটেন্ট এস কে সাইফুর রহমান বলেন, 'ভারতের টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই ট্যাগ পাওয়ার বিষয়ে গত মাসে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছে। ভারতের উদ্যোগের ব্যাপারে বোর্ডের চেয়ারম্যান ও জিআই আবেদনের দায়িত্বে থাকা কমিটির সদস্যরা জানতেন না। তারা স্বীকার করেছেন, সময়ের অভাবে আবেদন বিলম্বিত হওয়ায় দুই মাস ধরে ফাইলটি পড়ে ছিল।'

টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী মুনিরা এমদাদ ভারতের জিআই স্বীকৃতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, 'ভারত ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিবন্ধিত করেছে। এই খবর শুনে আমি একই সাথে গভীরভাবে দুঃখিত ও বিস্মিত হয়েছি। টাঙ্গাইলে শত শত বছর ধরে তাঁত বোনা চলছে। ভৌগোলিকভাবে টাঙ্গাইলের নামে নামকরণকৃত একটি পণ্য কীভাবে ভিন্ন দেশে স্বীকৃতি পেল, তা বিস্ময়কর ও বিভ্রান্তিকর!'

দ্য ডেইলি স্টার ইমেইল ও ফেসবুক পেজের মাধ্যমে ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করেছে। তবে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তাদের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

টাঙ্গাইল শাড়ির ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) ট্যাগ নিয়ে চলমান বিতর্ক জিআই ট্যাগের গুরুত্বকে তুলে ধরেছে। শুধু অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় নয়, সাংস্কৃতিক পরিচয় সংরক্ষণেও জিআই ট্যাগ অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের জন্য, টাঙ্গাইল শাড়ির জন্য জিআই ট্যাগ অর্জন করা কেবল দেশি তাঁতিদের কারুশিল্পকেই স্বীকৃতি দেবে না, আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকেও রক্ষা করবে। টাঙ্গাইল শাড়ির মতো পণ্যের অনন্য গল্প ও ঐতিহ্য রক্ষায় সরকারের যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার সময় এসেছে।

অনুবাদ করেছেন আহমেদ হিমেল

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

3h ago