ডিজিটাল ডিভাইসের কারণে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলছেন না তো...

হাতে স্মার্টফোন পেলে আমরা একেকজন যেন তথ্যের রাজা বনে যাই। কোনো কিছু জানতে হলে প্রথমেই খোঁজ করি গুগলে। অথচ ঘাড়ের ওপর যে মাথা আছে, এটা মনে থাকে না অনেকের। আজকাল আমরা ফোনের ওপর এত বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি যে, পরেরদিন সকালে উঠে কোন কাজটি আগে করব সেটা জানার জন্যও ফোনের নোটের ওপর ভরসা করতে হচ্ছে।
ছবি: ফ্রিপিক

হাতে স্মার্টফোন পেলে আমরা একেকজন যেন তথ্যের রাজা বনে যাই। কোনো কিছু জানতে হলে প্রথমেই খোঁজ করি গুগলে। অথচ ঘাড়ের ওপর যে মাথা আছে, এটা মনে থাকে না অনেকের। আজকাল আমরা ফোনের ওপর এত বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি যে, পরেরদিন সকালে উঠে কোন কাজটি আগে করব সেটা জানার জন্যও ফোনের নোটের ওপর ভরসা করতে হচ্ছে। 
 
কার জন্মদিন কবে, কোনদিন কোথায় মিটিং সবকিছুই সেট করে রাখছি ফোনের ক্যালেন্ডারে। মাথার কাজ দিয়ে দিচ্ছি মোবাইল ফোনকে, ফলে আমাদের মাথার ভেতরকার স্মৃতি ক্ষমতা কমে যাচ্ছে দিন দিন। 

স্মার্টফোন ব্যবহারে দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া, বিষণ্ণতায় ভোগা, কর্মক্ষমতা কমে যাওয়ার কথা আমরা কমবেশি সবাই জানি। কিন্তু স্মার্টফোনের কারণে যে আমাদের স্মৃতিশক্তিও হারিয়ে যাচ্ছে তা জানা নেই অনেকেরই। এই ভুলে যাওয়া রোগের নাম হলো ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া। 

আজ থেকে প্রায় ১৬ বছর আগে আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে এক গবেষণায় প্রযুক্তির অত্যধিক ব্যবহারের ফলে যে মানুষের স্মৃতিশক্তি হুমকির মুখে তা প্রথম জানা যায়। তারপর হার্ভার্ড, কলম্বিয়া এবং উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরাও তরুণদের ওপর প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। গবেষণার ফলাফলও চমকপ্রদ, যার নাম 'গুগল ইফেক্ট'। 

গবেষণায় দেখা যায়, সার্চ ইঞ্জিনে যেসব তথ্য সহজে পাওয়া যায় তা মানুষ সহজে ভুলেও যায়। এটিকে এক ধরনের ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া বলা হয়। অ্যামনেশিয়া মানে স্মৃতি হারানো। আর ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া হলো ডিজিটাল ডিভাইসের ওপর অতি নির্ভরশীলতার কারণে ওই স্মৃতিগুলো নিজের মনে রাখতে না পারা।  

২০১৫ সালের দিকে ক্যাসপারস্কি কোম্পানি ৬ হাজার মানুষের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখে যে, যখন তথ্য সহজে পাওয়া যায়, তখন মানুষের ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। গবেষণায় আরও দেখা যায়, মানুষ স্মার্টফোনে থাকা আত্নীয়-স্বজন, এমনকি বাবা-মায়ের ফোন নম্বরও মনে রাখতে পারছে না। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, বয়স ৪০ পেরোলে ধীরে ধীরে স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়াটা স্বাভাবিক। তবে তার আগেই যদি এমনটা হতে থাকে তাহলে ব্যাপারটা চিন্তার। হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী মানুষের স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এটি মাইনর কগনিটিভ ইম্প্যায়ারমেন্টের লক্ষণ। তার মানে মানুষ অল্প অল্প করে স্মৃতিশক্তি হারানো শুরু করেছে। এ কারণে প্রায় প্রত্যেককে নানা অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে। 

এটা কেন হয়? স্মার্টফোন আর সার্চ ইঞ্জিন অনেকটা এক্সটারনাল স্টোরেজের মতো। যতবার আপনি স্মার্টফোন বা গুগল থেকে কোনো তথ্য নিচ্ছেন, ততবারই আপনার ব্রেইন ধরে নিচ্ছে ওই তথ্যটা আর ব্রেইনের নিজস্ব স্টোরেজে রাখার প্রয়োজন নেই। তখন মস্তিষ্ক নিজের স্মৃতিতে জায়গা না করে এক্সটারনাল স্টোরেজ ব্যবহারকে সুবিধাজনক মনে করে। ক্যাসপারস্কি ল্যাবের গবেষণাতেই দেখা যায়, প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ অনলাইন থেকে তথ্য পাওয়ার পর খুব অল্প সময়েই তা ভুলে যায়।  

ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্সের কগনিটিভ নিউরোসায়েন্সের অধ্যাপক ক্রিস বার্ড বলেছেন, 'আমরা প্রতি মুহূর্তে বাহ্যিক ডিভাইসে স্মৃতির স্থানান্তর করছি। আগে যখন স্মার্টফোন ছিল না তখন নোট লিখে রাখার চল ছিল। কিন্তু এখন স্মার্টফোনের কারণে মেমোরি প্রসেসের ক্ষেত্রেও ডিভাইস ব্যবহার করছি। ফলে ফোন আর মস্তিষ্ক একত্রিত হয়ে একটি জটিল মিথস্ক্রিয়া সৃষ্টি করছে।'

২০০৭ সালের মাঝামাঝি থেকে স্মার্টফোনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হলেও এখন তা বাড়ছে। প্রশ্ন হলো- এভাবে আমরা আমাদের স্মৃতি যদি বাহ্যিক কোনো ডিভাইসে স্থানান্তর করতে থাকি তাহলে কী ঘটবে? ভবিষ্যতে কি ফোনই ঠিক করে দেবে আমাদের মস্তিষ্ক বা স্মৃতি কীভাবে কাজ করবে?

এ প্রসঙ্গে মনট্রিয়লের ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অলিভার হার্ড বলেন, 'আমাদের ব্রেইনের মেমরি সেলগুলো শরীরের অন্যান্য পেশীর মতোই। তার মানে আমরা যখন কোনো পেশির ব্যায়াম করি, তখন সেটি ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়, আর যদি নিয়মিত ব্যায়াম না করি, তাহলে সেই পেশীটি দুর্বল হয়ে পড়ে। ঠিক তেমনি আমরা যদি মনে রাখার চেষ্টা বন্ধ করে দিই, তাহলে আমাদের স্মৃতি আরও দুর্বল হবে। এতে ডিভাইসের প্রতি নির্ভরশীলতা আরও বাড়বে।' 

আমরা স্মার্টফোনের কল্যাণে যেসব সুবিধা পাচ্ছি, তার খেসারত হিসেবে আমাদের স্মৃতিশক্তির ক্ষমতা কমিয়ে ফেলতে হচ্ছে। ফলে আমাদের ডিমেনশিয়া বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি এমন এক মানসিক রোগ যাতে আক্রান্ত ব্যক্তির বুদ্ধি, স্মৃতি ও ব্যক্তিত্ব লোপ পায় এবং রোগ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। সাধারণত বয়স্ক ব্যক্তিরা এ রোগে আক্রান্ত হয় এবং হঠাৎ করেই অনেক কিছুই মনে করতে পারেন না। ফলে তার আচরণে কিছুটা অস্বাভাবিকতা লক্ষিত হয়। ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে, বর্তমানে বয়স্কদের পাশাপাশি তরুণরাও ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষ নিজের মনকে যত কম ব্যবহার করে, ততই এপিসোডিক মেমোরি, কগনিটিভ ফ্লেক্সিবিলিটির মতো জটিল কাজগুলো করার জন্য মস্তিষ্কের প্রয়োজনীয় সিস্টেমের ব্যবহার কম হয়। সহজ ভাষায় কোনো স্থানের মানচিত্র মনে রাখতে মস্তিষ্ককে যে পরিমাণ জটিল কাজ করতে হয়, স্মার্টফোনের কারণে তার সিকিভাগও করতে হয় না। মানচিত্র পড়া ও বোঝা একটি কঠিন কাজ, তাই আমরা সহজেই এগুলোকে স্মার্টফোনের ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা নির্ভার থাকি। 

কঠিন কাজ করলে মস্তিষ্ক সক্রিয় থাকে এবং কগনিটিভ প্রক্রিয়া চালু থাকে। এতে ব্রেইনের গ্রে ম্যাটারের ঘনত্ব বাড়ে। গ্রে ম্যাটার হলো আমাদের ব্রেইনের সেই জায়গা, যেখান থেকে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কঠিন কাজ স্মার্টফোনের ওপর চাপিয়ে দিলে এই গ্রে ম্যাটারের ব্যায়ামটা আর হয় না। ফলে ধীরে ধীরে গ্রে ম্যাটারের ঘনত্ব কমে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। 

বিজ্ঞান লেখক ক্যাথেরিন প্রাইসের মতে, আমাদের ব্রেইন মাল্টিটাস্কিং পারে না। বলতে পারেন, গাড়ি চালানোর সময় রেডিওতে গান তো ঠিকই শোনা যায়। শুনতে পারবেন। হ্যাঁ, কারণ গান শোনার ক্ষেত্রে কোনো জ্ঞান কাজে লাগাতে হয় না। কিন্তু আপনি যদি গাড়ি চালানোর সময় ফোনে মনোযোগ দেন, তখন আপনার মস্তিষ্ক স্বয়ংক্রিয়ভাবে অন্যদিকে চলে যায়। একইভাবে কোনো কাজে মনোযোগ না দিলে, সে কাজের স্মৃতি আপনার মস্তিষ্কে জমা না হওয়া স্বাভাবিক। 

যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণা থেকে জানা গেছে, যেসব শিশু প্রযুক্তি বেশি ব্যবহার করে তাদের মস্তিষ্কের কর্টেক্স, মানে ব্রেইনের যে অংশ আমাদের স্মৃতি জমা রাখার কাজ করে, সেটিকে পাতলা করে দেয়। বয়স বাড়লে এই অংশ পাতলা হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি স্বাভাবিক। কিন্তু ছোটবেলায় এমন হতে থাকলে পারকিনসন, আলঝেইমার, মাইগ্রেন ইত্যাদি রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় কী? স্মার্টফোন ছাড়া আধুনিক যুগে চলা প্রায় অসম্ভবই বলা চলে। এজন্য ফোন থেকে একটু দূরে থাকার চেষ্টা করুন। দিনের একটা অংশ আপনার পরিবারকে দিন। তাদের সঙ্গে গল্প করুন। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিন। লম্বা ছুটিতে ঘুরে আসুন। ঘুমানোর অন্তত আধা ঘণ্টা আগে ফোন ব্যবহার বন্ধ করুন। একটু পরপর ফোন হাতে নেওয়ার অভ্যাস থাকলে বিছানায় ফোন নিয়ে যাওয়া থেকে বিরত থাকুন। 

Comments

The Daily Star  | English

The invisible ones

Of the over 7 crore people employed in Bangladesh, 85 percent (nearly 6 crore) are vulnerable as they work in the informal sector, which lacks basic social and legal protection, and employment benefits.

10h ago