পানি ফুটিয়ে পান করুন, কিন্তু ফোটাবেন কতক্ষণ

স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

পানি যারা ফুটিয়ে পান করেন, তাদের অনেকেরই জানা নেই ঠিক কতক্ষণ ফোটালে সেটা পানের উপযোগী হয়। এ কারণে অনেকে দীর্ঘক্ষণ ধরে পানি জ্বালাতে থাকেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানি ফোটানোর জন্য ১০, ২০ মিনিট কিংবা আরও বেশিক্ষণ ধরে জ্বাল দেওয়ার প্রয়োজন নেই। পানি গরম হয়ে বলক আসার পর মাত্র ১ থেকে ৩ মিনিট ফোটালেই সেটা পানের উপযোগী হয়ে ওঠে।

এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) নির্দেশনা হলো, পানিতে বলক এসে ফুটতে শুরু হওয়ার পর মাত্র ১ মিনিট জ্বালালেই পানিতে থাকা ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও প্রোটোজোয়া নিষ্ক্রিয় হয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ মমিনুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাধারণত প্রটোজোয়া ও ব্যাকটেরিয়া সমগোত্রীয় মাইক্রোবায়োলজিক্যাল অনুজীবের উপস্থিতি ধ্বংসে ১ থেকে ৩ মিনিট ধরে রোলিং বয়েলিং (বলক আসার পর ফোটানো) করলে সেটা পানের উপযোগী হয়।'

মমিনুর রহমান আরও বলেন, 'মূলত তাপমাত্রা ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে পৌঁছালে পানিতে থাকা ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও প্রটোজোয়াগুলো মারা যায়। এরপর ৭০ থেকে ১০০ ডিগ্রিতে পৌঁছাতে আরও ৮-১০ মিনিট জ্বালাতে হয়। ১০০ ডিগ্রিতে পৌঁছানোর পর পানি ফুটতে শুরু করে। এই অবস্থায় ১ থেকে ৩ মিনিট রাখার পর জ্বাল দেওয়া বন্ধ করে দিলে ঠান্ডা হয়ে ৭০ ডিগ্রিতে আসতে আরও ১০-১৫ মিনিট সময় লাগে। ফলে সেটি প্রায় ১৫-২০ মিনিটের মতো সময় ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ফোটার সুযোগ পায়। আর পানিতে থাকা মাইক্রো অর্গানিজমস ধ্বংসের জন্য এটা যথেষ্ট সময়।'

তবে, পানিতে থাকা লেড, ক্রোমিয়াম ও সিলিকনসহ অন্যান্য ভারী ধাতব (হেভি মেটাল) বস্তু দূর করার জন্য ৫ ঘণ্টা ধরে ফুটিয়ে পানি নিঃশেষ করে ফেললেও সেটা দূর হবে না। হেভি মেটালের বয়েলিং পয়েন্ট ১০০ ডিগ্রির বেশি। তবে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ১-৩ মিনিট রোলিং বয়েল করা হলে পানিতে থাকা অনুজীব নষ্ট হয়ে যায়।

মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, 'ট্যাপের পানি দিয়ে যদি ভাত রান্না করে খাওয়া যায়, তাহলে এই তাপমাত্রায় পানি জীবাণুমুক্ত হয়ে যাওয়ার কথা। তবে ফিল্টারেশন ছাড়া হেভি মেটাল ফুটিয়ে দূর হবে না।'

এই বুয়েট অধ্যাপকের মতে, সঠিক উপায়ে পানি ফোটানোর জন্য নিচের পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করতে হবে-

  • চুলা জ্বালিয়ে প্রথমে পানিতে তাপ দেওয়া শুরু করতে হবে।
  • বলক আসার পর পূর্ণমাত্রায় ফুটতে শুরু করলে মাত্র ১ থেকে ৩ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে।
  • এরপর চুলা নিভিয়ে পানির পাত্র নামিয়ে ফেলতে হবে।
  • পানির তাপমাত্রা স্বাভাবিক হওয়ার পর তা পান করার উপযোগী হবে।

খাবার পানি কতক্ষণ ধরে ফোটানো উচিত জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) এনভাইরনমেন্টাল হেলথ ল্যাবরেটরির প্রধান ড. জাহিদ হায়াৎ মাহমুদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইনের কথা যদি বলি, সেখানে ১ মিনিট ধরে রোলিং বয়েলিংয়ের কথা বলা হয়েছে।'

তার ভাষ্য, 'পানি গরম হলে প্রসারিত হয়, তাই গরম করার সময় পাত্র পূর্ণ না করে কিছুটা কম পানি নিতে হবে। এরপর ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। এরপর ১০০ ডিগ্রিতে ফুটতে শুরু করলে অন্তত ১০ মিনিট ফোটাতে হবে। অনেকে ঢাকনা খুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোটাতে থাকে। তখন পানি বাষ্প হয়ে উড়ে যায়। ভেতরে মিনারেলসগুলো কনসেনট্রেট হয়ে যায়। এতে পানির স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। এ জন্য ঢাকনা দিয়ে ভালো করে ঢেকে দিতে হবে।'

জাহিদ হায়াৎ মাহমুদ বলেন, 'আমাদের পানিতে প্রচুর রোগ-জীবাণু থাকতে পারে। কিন্তু সবকিছু ওই টেম্পারেচারে মারা যাবে। এরপর পানিটা ঠান্ডা করে আমরা খেতে পারি। পানি বেশিক্ষণ ধরে ফোটালে পানিতে থাকা খনিজ উপাদানগুলো নষ্ট হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে রোলিং বয়েলিং করে যদি ১-৩ মিনিট ফোটানো যায়, সেটা সবচেয়ে ভালো। তাহলে খনিজ উপাদনগুলো ঠিক থাকবে। তবে নিরাপদ অবস্থানে থাকার জন্য আমরা ১০ মিনিটের কথা বলছি।'

ওয়াসার পানি কতক্ষণ ফোটালে পানের উপযোগী হয়- জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লায়েড কেমিস্ট্রি অ্যান্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক সায়েদ মো. শামসুদ্দি ডেইলি স্টারকে বলেন, '১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় (বলক ওটার পর) অন্তত ৩ মিনিট ধরে ফোটালে সেটা পানের উপযোগী হয়। ৩ মিনিটের কম হলে জীবাণু কিছু থেকে যায়। তবে এর চেয়ে বেশি সময় ফোটালে সমস্যা না থাকলেও এনার্জি লস হয়।'

তিনি আরও বলেন, 'বর্তমানে জ্বালানির দাম অনেক বেড়েছে, তা ছাড়া অনেকক্ষণ ধরে ফুটিয়ে গ্যাসের অপচয় করার কোনো মানে নেই। এটা একটা অপচয়মূলক কাজ। তা ছাড়া পানিতে অনেক ধরনের খনিজ পদার্থ থাকে, বেশিক্ষণ জ্বালানোর পর সেগুলো কনসেনট্রেট হয়ে গেলে দীর্ঘদিন এ ধরনের পানি পান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।'

বর্তমানে ঢাকা শহরের উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোতে অত্যাধুনিক পিউরিফায়ারের মাধ্যমে পানি বিশুদ্ধ করা হলেও নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা গ্যাসের চুলায় বড় হাড়ি বা কলসে করে পানি ফুটিয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে পানি ফোটানোর সঠিক নিয়ম জানা না থাকায় অনেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্বালানোর পর সেটা পানের উপযোগী বলে মনে করেন। এতে প্রচুর পরিমাণে গ্যাসের অপচয় হয়।

দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা ওয়াসার পানির নিম্নমানের কারণে ৯৩ শতাংশ গ্রাহক বিভিন্ন পদ্ধতিতে পানি পানের উপযোগী করেন। এর মধ্যে ৯১ শতাংশ গ্রাহকই পানি ফুটিয়ে বা সেদ্ধ করে পান করেন। গৃহস্থালি পর্যায়ে পানি ফুটিয়ে পানের উপযোগী করতে প্রতিবছর আনুমানিক ৩৩২ কোটি টাকার গ্যাসের অপচয় হয়।

 

Comments

The Daily Star  | English

US retailers lean on suppliers to absorb tariffs

Rather than absorbing the cost or immediately passing it on to consumers, many US apparel retailers and brands have turned to their suppliers in Bangladesh, demanding they share the pain

5h ago