রবীন্দ্র সাহিত্যে নারীর সাজ

পূজার সাজে নারী। ছবি: বিশ্ব রঙ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যে নারীরা বরাবরই আধুনিক, রুচিশীল ও সৌন্দর্যবোধে পরিপূর্ণ আদর্শ চরিত্র। ঊনিশ শতকে 'নারী অধিকার' শব্দটির সঙ্গে যখন কেউ পরিচিত নয়, তখন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ নারীকে উপস্থাপন করেছেন স্বাধীনচেতা, ব্যক্তিত্ববান ও সাহসী হিসেবে।

কখনো রক্তকরবীর সাহসী নন্দিনী, কখনো আত্মসম্মানবোধে পরিপূর্ণ শেষের কবিতার লাবণ্য, কখনো বা নষ্টনীড়ের স্বাধীনচেতা গৃহবধূ চারুলতা- রবিঠাকুরের কলমে নারী কেবল আর অবলা থাকেনি বরং হয়ে উঠেছে দিগ্বিজয়ী, বিজয়ী লক্ষ্মী। তাছাড়া তার সৃষ্ট বেশিরভাগ নারীই ছিলেন শিক্ষিতা এবং সামাজিক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। এ কারণে তাদের চলনবলন, পোশাক পরিচ্ছদ ও অলংকারের মাঝেও ছিল অপেক্ষাকৃত আধুনিকতা।

বাঙ্গালী নারীর ফ্যাশন সচেতনতা ও জাগরণে শুধু রবীন্দ্র সাহিত্য নয়, জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের নারীদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এক্ষেত্রে ঠাকুরবাড়ির জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, স্বর্ণকুমারী দেবী, কাদম্বরী দেবী, ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী ও সরলা দেবী চৌধুরানীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ছবি: সাজ্জাদ ইবনে সাঈদ

আজকের দিনে নারীরা যেভাবে শাড়ি পরে, সেটা জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের বধূ জ্ঞানদানন্দিনীর কাছ থেকে পাওয়া। তিনিই প্রথম শাড়ীর সঙ্গে পেটিকোট ও ব্লাউজ ব্যবহার করেন এবং নতুনভাবে কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরার স্টাইল তৈরি করেন। বাম কাঁধে আঁচল ফেলার বিষয়টি তিনিই প্রথম শুরু করেন। এমনকি তিনি নারীদের এই স্টাইলে শাড়ি পরার প্রশিক্ষণ দিতে 'বামাবোধিনি পত্রিকাতে' বিজ্ঞাপনও করেছেন।

স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকা স্বর্ণকুমারীর কন্যা সরলা দেবী, দেশের লোকের মনে স্বদেশিয়ানা আনার জন্য বাঙালি মেয়েদের মধ্যে টিপ পরা, আলতা পরার চল শুরু করেন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির এই পরিবেশের প্রভাবেই হয়ত কবিগুরুর নারী চরিত্রগুলো সেই সময় থেকে অনেক বেশে সাহসী, আধুনিক ও রুচিশীল।

আসছে পূজায় নিজেকে রবীন্দ্র সাহিত্যের নারীদের মত করে সাজাতে পারেন সহজেই।

পূজার সাজ এখন শুধু লাল পেড়ে সাদা শাড়ির মাঝেই সীমাবদ্ধ নেই। আধুনিক, ঐতিহ্যবাহী কিংবা ক্লাসিকাল যেকোনো সাজই পূজায় মানানসই তবে ফ্যাশনে রবীন্দ্র সাহিত্যের নারীদের বিশেষ আবেদন রয়েছে যা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

নষ্টনীড়-এর অন্দরমহলে বন্দিনী চারুলতাকে পুরো গল্প জুড়েই চওড়া আমরা পাড়ের শাড়ি, লেইস দেওয়া ব্লাউজ, খোঁপায় কাঁটা বা ফুল পরিহিত দেখতে পাই। সেখানে নেই কোনো বাহুল্য বরং রুচিশীলতা ও আভিজাত্যের বিষয়টিই স্থান পেয়েছে বেশি। আবার, ঘরে বাইরে উপন্যাসের স্বদেশী করা বিমলার পায়ে বাজতো রূপার নূপুর। যা তার স্বাধীনতাকে আরও বেশি জানান দিয়েছে। সত্যজিৎ রায় যখন এই ২টি উপন্যাস থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তখন নারী চরিত্রগুলো যেন কল্পনা থেকে পর্দায় নেমে আসে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই লিখেছেন, 'অর্ধেক মানবী তুমি, অর্ধেক কল্পনা'।

পূজার সাজ। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'নৌকাডুবি' উপন্যাস যখন ঋতুপর্ণা ঘোষ সিনেমায় রূপ দেন, সেখানে উপন্যাসের নারী 'হেমনলিনী'-র সাজসজ্জা, পোশাকপরিচ্ছদ মুগ্ধ করে সকল দর্শককেই। এই চরিত্রে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গে জনপ্রিয় অভিনেত্রী রাইমা সেন। ফুল হাতা ব্লাউজের সঙ্গে পাট করা শাড়ি, আচলে ব্রোচ, টানা করে দেওয়া কাজল আর কপালের কিছুটা ওপরে টিপ- এ যেন স্নিগ্ধতার আরেক রূপ। আবার 'চার অধ্যায়' উপন্যাস যখন সেলুলয়েডের পর্দায় আনা হয় 'এলার চার অধ্যায়' নামে, অভিনেত্রী পাওলি দামের হালকা রঙের কুঁচি করে পড়া শাড়ি, ডিজাইনবিহীন ফুল হাতা ব্লাউজ, চোখে কাজলের টান আর খোপায় বাঁধা চুল যেন রবিঠাকুরের সাহসী এলা-কে সামনে নিয়ে আসে।

কাদম্বরী দেবী, সম্পর্কে রবিঠাকুরের বৌঠান অর্থাৎ ভাবী ছিলেন তার সাহিত্যরচনার অন্যতম অনুপ্রেরণা। কাদম্বরীর রুচিবোধ, সাহিত্যজ্ঞান ও শিল্পবোধ ছিল অন্য সবার থেকে আলাদা। সেই সৌন্দর্যবোধের দেখা মেলে ২০১৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'কাদম্বরী' চলচ্চিত্রে। কখনো সুতির শাড়ি, কখনো তসর বা সিল্কের হালকা রঙের শাড়িতে দেখা গেছে অভিনেত্রী কঙ্কনা সেন শর্মাকে। কখনো খোলা চুলে সাধারণ সুতির শাড়ি, কখনো খোপায় সাদা ফুলের গাজরা, হালকা সোনার কিছু গয়না, চোখের ভারী কাজলে অপরূপ লাবণ্যময়ী কাদম্বরী দেবীকে আমরা পর্দায় দেখতে পাই।

পূজার সাজ। ছবি: সংগৃহীত

এই পূজায় নিজেকে রাবীন্দ্রিক সাজে সাজাতে চাইলে শাড়ির পাশাপাশি ব্লাউজেও নিয়ে আসুন বৈচিত্র্য। ভালো মানের মটকা, সিল্ক, মসলিন কাপড়ের ব্লাউজের সঙ্গে কুরুশকাঁটার লেইস বা পাইপিং থাকলে দেখতে অনেক বেশি সুন্দর লাগবে। ব্লাউজের গলা পছন্দমতো ডিজাইনের পিঠখোলা, পিঠবন্ধ অথবা কলার দেওয়াও হতে পারে। হাতার ক্ষেত্রে লম্বা, থ্রি-কোয়ার্টার হাতাই বেশি মানানসই। এই সাজসজ্জায় দেশীয় তাঁত টাঙ্গাইলের শাড়ি, সিল্কের শাড়ি, তসরের শাড়ি এমনকি জামদানীও বেশ মানাবে। চুল বাধার ক্ষেত্রে খোলা চুলের চেয়ে বেণি অথবা খোঁপা বেশি প্রাধান্য পাবে। খোঁপা কিংবা বেণির ভাঁজে ভাঁজে গুঁজে দিত পারেন রুপার কাঁটা অথবা গাজরা। তৎকালীন বনেদি পরিবারের নারীরা বিচিত্র কারুকাজের বিভিন্ন সোনা-রুপার গয়না, হাতে চুড়ি, বালা, শাঁখা, গলায় কয়েক লহরের চেইন, কানে দুল, নাকে নথ আর পায়ে মল পরে নিজেকে সাজাতো রাজকীয় সাজে তবে সেই সাজে জাঁকজমক থেকে রুচিশীলতার প্রাধান্য বেশি ছিল। আপনিও পাতলা কারুকাজের সোনা-রূপা অথবা গোল্ডপ্লেটের গয়না পড়তে পারেন। চোখে টানা করে কাজল, হালকা রঙের লিপস্টিক আর কপালের কিছুটা ওপরে ছোট টিপ পড়ে আপনিও হতে পারেন রবিঠাকুরের সৃষ্ট চরিত্র।

Comments

The Daily Star  | English

JnU students, teachers call off protest after assurances

All the activities of the university will resume from tomorrow

3h ago