সেই ‘সাজানো গল্পেই’ ইরানকে ‘ইরাক’ বানাতে চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র?

বাংকার বাস্টার বোমাবাহী যুক্তরাষ্ট্রের বি- ২ বোমারু বিমান। ছবি: রয়টার্স

সেই একই ছক, একই সাজানো গল্প আর চিত্রনাট্যে ইরানকে যুক্তরাষ্ট্র 'ইরাক' বানাতে চাচ্ছে কিনা, সেই প্রশ্ন জোরালো হয়েছে।

বাইশ বছর আগে ইরাক আক্রমণের আগে দেশটির হাতে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার ধারণা এবং সেই অস্ত্র মানব অস্তিত্বের জন্য হুমকি হতে পারে—এমন বয়ান তৈরি করা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা মিত্রদের পক্ষ থেকে। এবারও একেবারেই বিনা উসকানিতে ইরান আক্রমণের পর 'একই অজুহাতে' ইসরায়েলের 'দোসর' হয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি এ সংঘাতে জড়িয়েছে।

আজ রোববার ভোরে যুক্তরাষ্ট্র বি-২ স্টেলথ বোমারু বিমান দিয়ে হামলা চালিয়েছে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায়।

অথচ ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির (এনপিটি) সদস্যরাষ্ট্র। তাদের এই কর্মসূচি সব সময় নজরদারির মধ্যেই থাকে। তবু সম্ভাব্য পারমাণবিক সক্ষমতার অভিযোগেই ইরানের ওপর বিধ্বংসী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

বিপরীতে এনপিটিতে সই না করা ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রে শক্তিধর দেশ। তারা কখনোই আইএইএকে তাদের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো পরিদর্শনের অনুমতি দেয়নি।

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও বলছেন, ইসরায়েলকে বারবার জানানো হয়েছে যে ইরানের পরমাণু বোমা বানানোর ইচ্ছা নেই।

একই কথা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ড প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জানালে তুলসী 'ভুল' জানেন বলে মন্তব্য করেন।

এ দিকে, গতকাল ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েল দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, মোসাদ বলছে—ইরান ১৫ দিনের মধ্যে পরমাণু বোমা বানাতে সক্ষম আর মার্কিন সংস্থাগুলো বলছে—অন্তত এক বছর লাগবে।

এমন 'ধোঁয়াশাপূর্ণ' পটভূমিতে গত ২০ জুন দ্য গার্ডিয়ান এক প্রতিবেদনের শিরোনামে প্রশ্ন রাখা হয়—যুক্তরাষ্ট্র ইরাক যুদ্ধে 'ভয়াবহ ভুল' করেছিল। একই কাজ কি ইরানের ক্ষেত্রেও করতে যাচ্ছে?

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়—প্রায় ২০ বছর আগে যখন মার্কিন কর্মকর্তারা ইরাক আক্রমণ করা উচিত হবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা করছিলেন তখন তাদের মনে একটাই প্রশ্ন ছিল—সাদ্দাম হোসেনের হাতে কি গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে? যদি থাকে তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত সেগুলো ধ্বংস করা এবং সামরিক হামলার মাধ্যমে বাথ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা।

তারপর যা ঘটেছিল তা বিশ্ববাসীর জানা।

ইরাক বা সাদ্দাম হোসেনের হাতে কোনো গণবিধ্বংসী অস্ত্র ছিল না। প্রাচীন সভ্যতার দেশ ইরাক ও হাজার বছরের সমৃদ্ধ শহর বাগদাদ ধ্বংস করে ইরাকিদের চরম দুর্দশার ভেতর ফেলে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্ররা বুঝতে পারেন—তাদের 'ভুল' হয়ে গেছে।

২০০৩ সালে শুরু হওয়া ইরাক যুদ্ধ বা দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে চলে ২০১১ সাল পর্যন্ত। বলা বাহুল্য, এর রেশ চলছে এখনো।

সেসময় ইরাকে হামলা হয়েছিল রিপাবলিকান দলের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের নির্দেশে। আবারও কি সেই 'ভুল পথে' হাঁটছে মার্কিন প্রশাসন? এবারও হোয়াইট হাউসে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট।

ইরান নিশ্চয় 'ইরাক' নয়?

ইসরায়েল-ইরান চলমান সংঘাতের দশম দিনে অন্তত এ কথা বলা যায় যে, আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ও সামরিক দিকগুলো বিবেচনায় নিলে ইরানকে নিশ্চয় 'ইরাক' বলা যাবে না।

সবাই জানেন যে ১৯৮১ সালের ৭ জুন ইসরায়েলের আটটি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান প্রায় এক হাজার ১০০ কিলোমিটার উড়ে গিয়ে আচমকা ইরাকের রাজধানী বাগদাদের কাছে ওসিরাকে হামলা চালায়। ফরাসিদের তৈরি ওসিরাকের রিঅ্যাকটরটি ধ্বংস করে।

সেখানে পরমাণু বোমার জন্য প্লুটোনিয়াম উৎপাদন করা হতে পারে এমন ধারণার ভিত্তিতে ইরাকের পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংস করে দেওয়া হয়। এরপর দেশটি আর সে পথে এগোয়নি। এ ঘটনায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ইসরায়েলের নিন্দা করেছিল।

ইরানের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। দেশটি পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিতে সই করে ১৯৬৮ সালে। এরপর ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তা অনুমোদন করে ইরান নিজেকে পরমাণু বোমামুক্ত দেশ হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর থেকে তেহরান বারবার বলে আসছে, তাদের পরমাণু কর্মসূচি পুরোপুরি বেসামরিক। এটি গবেষণা ও শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহারের জন্য।

চুক্তি অনুসারে জাতিসংঘের পরমাণু সংস্থা আইএইএ নিয়মিত ইরানের পরমাণু কেন্দ্রগুলো পরিদর্শন করে আসছে।

পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিতে সই না করা ও পরমাণু বোমার অধিকারী হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে অন্য কোনো দেশকে পরমাণু রিঅ্যাকটর বসাতে দিতে নারাজ।

ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে সীমিত রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বের পরাশক্তিধর দেশগুলো ২০১৫ সালে চুক্তি করে। ইরান চুক্তি মেনে চললেও প্রথম দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ট্রাম্প সেই চুক্তি থেকে বের হয়ে আসেন। ফলে চুক্তিটি অকার্যকর হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, তেহরানের ওপর সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের পথে হাঁটতে শুরু করে ওয়াশিংটন।

দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে ট্রাম্প পরমাণু নিয়ে ইরানের সঙ্গে নতুন করে চুক্তির জন্য আলোচনার নির্দেশ দেন। সেই আলোচনা পঞ্চম দফা পর্যন্ত গড়ায়। ষষ্ঠ দফা শুরুর ঠিক আগে ইসরায়েল আচমকা ইরানের ওপর হামলা শুরু করে। উদ্দেশ্য—ইরানের পরমাণু প্রকল্প ধ্বংস করা। যদিও এর সঙ্গে তেহরানে সরকার পরিবর্তনের ডাক দিচ্ছে তেল আবিব।

এই যুদ্ধ 'দীর্ঘস্থায়ী' হবে?

ইরাকে মার্কিন সামরিক অভিযান ২০০৩ সালে শুরু হয়ে চলেছিল ২০১১ সাল পর্যন্ত। তারপরও তা শেষ হয়নি। এখনো ইরাকে মার্কিন বাহিনীর ঘাঁটি আছে। সেই ঘাঁটি লক্ষ্য করে ইরান-সমর্থিত যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী সশস্ত্র সংগঠনগুলোর হামলা মাঝেমধ্যেই সংবাদ শিরোনাম হয়। সেই হিসাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকে এখনো স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরতে পারেনি।

ঠিক তেমনি ইরানেও কি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের পরিকল্পনা করছে ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্র?

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে—ইরানিদের একটি অংশ বর্তমান শাসকবিরোধী হলেও তারা আগ্রাসন বা বিদেশি হামলার বিপক্ষে। আর চলমান প্রেক্ষাপটে সেখানে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব আরও জোরালো হচ্ছে।

দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়—ইরানিরা তাদের দেশে ইসরায়েলের এই আক্রমণ ভুলবে না। যুক্তরাষ্ট্র এই সংঘাতে যোগ দিলে ইরান মার্কিনিদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে পারে। এর ফলে যুদ্ধ আরও বিস্তৃত রূপ নিতে পারে। এই সংঘাত চলতে পারে আরও অনেক বছর।

যদি তাই হয়, তাহলে প্রশ্ন জাগে—যুক্তরাষ্ট্র কি একই অজুহাতে ইরানকে ধ্বংস করে 'ইরাক' বানানোর পথে হাঁটবে?

Comments

The Daily Star  | English
US attack on Iran nuclear sites

Iran denounces US attack as ‘outrageous’

Iran says 'no signs of contamination' after US attacks on key nuclear sites

10h ago