ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধের প্রথম সাফল্য যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য নতুন বাণিজ্য চুক্তি

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে এক 'যুগান্তকারী' বাণিজ্য চুক্তির ঘোষণা দিয়েছেন। গত ২ এপ্রিল থেকে মিত্র ও প্রতিপক্ষ—উভয়ের আমদানি পণ্যে কঠোর শুল্ক আরোপের পর এটাই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো দেশের প্রথম আনুষ্ঠানিক চুক্তি।
আজ শুক্রবার এই তথ্য জানিয়েছে এএফপি।
হোয়াইট হাউসে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত পিটার ম্যান্ডেলসনকে পাশে নিয়ে এই চুক্তির ঘোষণা দেন ট্রাম্প।
বিশ্লেষকদের মতে, এটা মার্কিন প্রেসিডেন্টের এক ধরণের 'বিজয়' ও শুল্কযুদ্ধের প্রথম উল্লেখযোগ্য সাফল্য।
এর আগে তিনি দাবি করেছিলেন, শুল্ক আরোপের পর বিশ্বের অসংখ্য দেশ বাণিজ্য চুক্তির জন্য তার দরজায় ধর্না দিচ্ছে।
কিন্তু বাস্তবে, শুল্ক আরোপের এক মাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এটাই প্রথম, বড় আনুষ্ঠানিক চুক্তি।
এর আগে, বুধবার নিজস্ব সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশালে কোনো দেশের নাম উল্লেখ না করে ট্রাম্প বলেন, একটি 'বিশাল ও খুবই সম্মানিত দেশের" সঙ্গে 'বড় বাণিজ্য চুক্তির' ঘোষণা দেবেন তিনি।
এএফপির প্রতিবেদনে চুক্তির উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো জানানো হয়েছে।
'বাজারে প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি'
চুক্তি অনুযায়ী, এপ্রিলে অধিকাংশ বাণিজ্যিক অংশীদারের ওপর আরোপিত ১০ শতাংশ 'বেসলাইন' শুল্ক বেশিরভাগ পণ্যের ক্ষেত্রেই বহাল থাকছে। তবে যেসব নির্দিষ্ট খাতে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল—সেসব ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেওয়া হচ্ছে।
চুক্তিতে 'আমেরিকান রপ্তানির জন্য কয়েক বিলিয়ন ডলারের বাড়তি বাজার প্রবেশাধিকার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে' বলে নিশ্চিত করেন ট্রাম্প। হোয়াইট হাউজের ওভাল অফিসে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান তিনি। সে সময় তার পাশেই ছিলেন ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত।

হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, নতুন এই শুল্ক ব্যবস্থা থেকে ট্রেজারি বিভাগ বাড়তি ৬ বিলিয়ন ডলার রাজস্ব আয় করবে।
চুক্তিটি আগামী জুলাইয়ের আলোচনার সময়সীমা সামনে রেখে গভীরভাবে পর্যালোচনা করা হবে, কারণ চুক্তি না হলে কয়েকটি দেশকে আরও বেশি হারে শুল্কের মুখোমুখি হতে হবে।
আটলান্টিক কাউন্সিলের আন্তর্জাতিক অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান জোশ লিপস্কি বলেন, 'এটা ছিল প্রশাসনের জন্য সবচেয়ে সহজলভ্য সুযোগ।'
তিনি আরও বলেন, 'এটা স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে ভবিষ্যতের আলোচনা জটিল হতে যাচ্ছে, কারণ যুক্তরাজ্যের পরিস্থিতি অনেক দিক থেকে অনন্য এবং অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে এমন কিছু পুনরাবৃত্তি করা কঠিন হবে।'
ব্রিটিশ গাড়ি শিল্পে সাফল্য
চুক্তির অন্যতম লাভবান খাত হলো ব্রিটিশ অটোমোটিভ শিল্প।
প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের কার্যালয়ের বরাতে জানা গেছে, প্রায় আড়াই লাখ কর্মসংস্থানের এই খাতটি পূর্বে ২৭ দশমিক পাঁচ শতাংশ শুল্কের মুখে ছিল।
চুক্তি অনুযায়ী, ব্রিটেন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম এক লাখ গাড়ি রপ্তানিতে শুল্ক ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। এর বেশি গাড়িতে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক বহাল থাকবে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মতে, গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে যুক্তরাজ্য ঠিক এই সংখ্যক গাড়িই রপ্তানি করেছিল।
স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম
যুক্তরাষ্ট্র স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর আরোপিত ২৫ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহারে সম্মত হয়েছে বলে জানিয়েছে ব্রিটিশ সরকার।
মার্কিন বাণিজ্য বিভাগ বলেছে, নতুন চুক্তি 'উভয় দেশের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থ রক্ষা করবে এবং স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম নিয়ে নতুন অংশীদারিত্ব তৈরি করবে।' তবে তারা শুল্ক শতভাগ প্রত্যাহার নিশ্চিত করেনি।
এই বিষয়ে হোয়াইট হাউস এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে মন্তব্য করেনি।
কৃষি খাত
ট্রাম্প জানিয়েছেন, নতুন চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের কৃষক, পশুপালক ও উৎপাদকদের জন্য পাঁচ বিলিয়ন ডলারের নতুন 'সুযোগ' তৈরি করবে, যার মধ্যে ৭০০ মিলিয়ন ডলারের ইথানল রপ্তানি এবং ২৫০ মিলিয়ন ডলারের গরুর মাংসসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য, বিশেষ করে ক্লোরিনে ধোয়া মুরগি ও হরমোনযুক্ত গরুর মাংস নিয়ে ব্রিটিশ কৃষক ও ভোক্তাদের আপত্তি বহুদিনের।

চুক্তিতে দুই দেশই গরুর মাংস রপ্তানি ও আমদানিতে পারস্পরিক বাজার প্রবেশাধিকার দিয়েছে। যুক্তরাজ্যের কৃষকদের জন্য ১৩ হাজার মেট্রিক টন গরুর মাংসে শুল্কমুক্ত কোটা নির্ধারণ করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিমন্ত্রী ব্রুক রোলিনস বলেছেন, এই চুক্তির ফলে 'আমাদের গরুর মাংস রপ্তানি অনেকগুণ বৃদ্ধি পাবে।'
ডাউনিং স্ট্রিট জানিয়েছে, যুক্তরাজ্যের খাদ্যমান সংক্রান্ত বিধিনিষেধ কোনোভাবেই শিথিল করা হবে না।
কী বাদ পড়েছে?
ট্রাম্প ওষুধ খাতে শুল্ক আরোপের হুমকি দিলেও এই চুক্তিতে তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। তবে হোয়াইট হাউস একটি 'নিরাপদ ওষুধ সরবরাহ চেইন' গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
আটলান্টিক কাউন্সিলের লিপস্কি বলেন, 'এই চুক্তি আমাদেরকে বুঝিয়েছে—আলোচনার টেবিলে যা থাকে, সেটাই কার্যকর হয়, হুমকি নয়।'
ডিজিটাল পরিষেবাখাতও চুক্তির বাইরে রয়ে গেছে। যুক্তরাজ্যের ডিজিটাল সার্ভিসেস ট্যাক্স নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। এই কর গুগল, মেটাসহ মার্কিন প্রযুক্তি খাতের বড় বড় প্রতিষ্ঠানের ওপর আরোপিত হয়েছে।

ডাউনিং স্ট্রিট জানিয়েছে, উভয় দেশ ডিজিটাল বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে ভবিষ্যতে কাজ করবে, যাতে করে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিকারক ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্রের ঝামেলা কমানো যায়।
ক্যাপিটাল ইকোনমিকস-এর প্রধান উত্তর আমেরিকা অর্থনীতিবিদ পল অ্যাশওয়ার্থ বলেছেন, 'ট্রাম্প ও স্টারমার তাড়াহুড়ো করে যে "সম্পূর্ণ ও বিস্তৃত" চুক্তির কথা বলেছেন, তা আদতে তেমন কিছু নয়।'
তিনি আরও বলেন, 'ট্রাম্প নিজেই প্রেস কনফারেন্সে স্বীকার করেছেন, 'চূড়ান্ত বিষয়গুলো' আগামী কয়েক সপ্তাহে 'লিখে নেওয়া' হবে।'
Comments