‘ইউক্রেনে আমেরিকানদের উপস্থিতি দেশটি থেকে অশুভ শক্তিদের দূরে রাখবে’

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি, ইউক্রেন থেকে অশুভ শক্তিরা দূরে থাকবে। এটা তিনি নিশ্চিত করবেন। তবে তার অর্থ এই না যে তিনি সেখানে সেনা মোতায়েন করতে চলেছেন। খনিজ চুক্তির আওতায় আমেরিকানরা ইউক্রেনে যেয়ে খনিজ উত্তোলনের কাজ করবেন এবং তাদের উপস্থিতিই দেশটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
ট্রাম্পের বরাত দিয়ে এই তথ্য জানিয়েছে এএফপি।
প্রায় দুই মাস দেরির পর অবশেষে খনিজ সম্পদ নিয়ে বহুল প্রতীক্ষিত চুক্তিতে সই করেছে ওয়াশিংটন ও কিয়েভ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন এই চুক্তিকে কিয়েভের প্রতি নতুন ধরণের অঙ্গীকার বলে অভিহিত করেছে। দুই মাস আগে হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প-জেলেনস্কির তুমুল বাদানুবাদে চুক্তিটি ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল।

ট্রাম্পের দাবি, ওয়াশিংটন-কিয়েভের খনিজ সম্পদ চুক্তি সই ইউক্রেনের জন্য মঙ্গলজনক পদক্ষেপ এবং এর মাধ্যমেই দেশটি নিরাপদ থাকবে।
ইউক্রেন জানিয়েছে, দীর্ঘ দরকষাকষির পর গতকাল বুধবার যে চুক্তি সই হয়েছে, তাতে দেশটির স্বার্থ সুরক্ষিত হয়েছে। বিরল খনিজ সম্পদের ওপর পূর্ণাঙ্গ সার্বভৌমত্বও থাকছে কিয়েভের।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে 'রেয়ার আর্থ' নামে পরিচিত এসব খনিজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি নিয়ে এতোটা আগ্রহী।
মার্কিন উপস্থিতি ইউক্রেনকে নিরাপদ রাখবে: ট্রাম্প
ট্রাম্প শুরুতে ৫০০ বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের খনিজ চেয়েছিলেন কিয়েভের কাছে। তবে এই পরিমাণটি মোট সামরিক সহায়তার চার গুণেরও বেশি।
এর আগে ইউক্রেনকে সরাসরি নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেওয়ার চিন্তাধারা বা দেশটির ন্যাটো জোটে যোগ দেওয়ার বিষয়গুলোকে উড়িয়ে দেন ট্রাম্প।
তবে গতকাল তিনি জানান, ইউক্রেনের মাটিতে আমেরিকানদের উপস্থিতি তাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে ট্রাম্প বলেন, 'আমি মনে করি সেখানে আমেরিকানদের উপস্থিতি দেশটি থেকে অশুভ শক্তিদের দূরে রাখবে। অন্তত, যেসব জায়গায় আমরা খনন কাজ চালাব, সেখান থেকে তারা দূরে থাকবে।'

পরবর্তীতে নিউজনেশন আয়োজিত টাউন হল বক্তব্যে ট্রাম্প বলেন, তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ভ্যাটিকানের বৈঠকে এই চুক্তি সই নিয়ে আলাপ করেছিলেন। সে সময় তিনি জেলেনস্কিকে বলেন, এই চুক্তি ইউক্রেনের জন্য 'খুব ভালো হবে' কারণ, 'রাশিয়া অনেক বড় এবং অনেক বেশি শক্তিশালী'।
খনিজ চুক্তির ফলে রুশ নেতা ভ্লাদিমির পুতিন (ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানো থেকে) 'নিবৃত্ত' হবেন কী না, এই প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, 'এমনটা হতেও পারে।'
এর আগে ২৮ ফেব্রুয়ারিতে খনিজ চুক্তি নিয়ে হোয়াইট হাউসে বৈঠক করেছিলেন ট্রাম্প ও জেলেনস্কি। তবে সেই বৈঠকে তুমুল বাদানুবাদে জড়ান দুই শীর্ষ নেতা ও মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স। এক পর্যায়ে জেলেনস্কিকে হোয়াইট হাউস ছেড়ে যেতে বলা হয়।
তবে পরবর্তীতে ট্রাম্পের সমর্থন পেতে কূটনীতিক বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন ইউক্রেনের নেতা।
চুক্তির প্রেক্ষাপট

সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলে লাখো ডলারের অস্ত্র দিয়ে ইউক্রেনকে রাশিয়ার আগ্রাসন ঠেকিয়ে রাখতে সহায়তা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ক্ষমতা গ্রহণ করে ওই সহায়তার বিপরীতে ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ উত্তোলন ও ব্যবহারের অধিকার চেয়ে বসেন ট্রাম্প।
শুরুতে দ্বিধা প্রকাশ করলেও অবশেষে ইউক্রেন খনিজ চুক্তিতে সম্মতি দেয়, যার মাধ্যমে দেশটিতে দীর্ঘ মেয়াদে মার্কিন বিনিয়োগ অব্যাহত থাকা নিশ্চিত হয়েছে।
স্কট বেসেন্টের ঘোষণা

ওয়াশিংটনে এই চুক্তি সইয়ের ঘোষণা দিয়ে মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট জানান, 'এতে ইউক্রেনে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি ও উন্নয়ন নিশ্চিতে উভয় পক্ষের অঙ্গীকার প্রকাশ পেয়েছে।'
বেসেন্ট বলেন, 'এই চুক্তি রাশিয়াকে স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ট্রাম্প প্রশাসন দীর্ঘ মেয়াদে একটি মুক্ত, সার্বভৌম ও উন্নয়নশীল ইউক্রেনের ধারণাকে মাথায় রেখে শান্তি প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।'
'আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, যেসব ব্যক্তি বা দেশ রাশিয়ার সামরিক কার্যক্রমে অর্থ দিয়ে বা অন্য কোনো ভাবে সহায়তা করেছে, তাদেরকে ইউক্রেনের পুনর্গঠন থেকে কোনো ধরণের ফায়দা লুটতে দেওয়া হবে না', যোগ করেন তিনি।
বিশ্লেষকরা উল্লেখ করেন, এই বক্তব্যে বেসেন্ট 'রাশিয়ার পূর্ণ মাত্রার আগ্রাসন' শব্দাংশটি ব্যবহার করেছেন। সাধারণত ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধকে 'সংঘাত' বলে অভিহিত করেন এবং এই যুদ্ধ শুরুর জন্য কিয়েভকেও মস্কোর পাশাপাশি দায়ী করে থাকেন।
ইউক্রেনের বক্তব্য

ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রী ডেনিস শ্মাইগাল জানান, এই চুক্তি 'উত্তম, সমতাপূর্ণ ও উপকারী'।
শ্মাইগাল জানান, দুই দেশ মিলে একটি পুনর্গঠন বিনিয়োগ তহবিল তৈরি করবে। সেখানে উভয় পক্ষের সমান ভোটাধিকার থাকবে এবং ইউক্রেনের হাতে 'সংশ্লিষ্ট ভূখণ্ড, অবকাঠামো ও প্রাকৃতিক সম্পদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ' থাকবে।
এই চুক্তিতে কিয়েভের বড় একটি উদ্বেগ দূর হয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি নিশ্চিত করেন, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ওয়াশিংটন যে বিপুল পরিমাণ সামরিক সহায়তা দিয়েছে, তা 'দেনা' হিসেবে বিবেচিত হবে না এবং এর জন্য কিয়েভকে কোনো অর্থ পরিশোধও করতে হবে না।
'ওই তহবিলের মুনাফা শুধুমাত্র ইউক্রেনেই পুনর্বিনিয়োগ করা হবে', যোগ করেন তিনি।
ইউক্রেনের অর্থনীতি বিষয়ক মন্ত্রী ইউলিয়া সিরিদেনকো জানান, এই চুক্তি খনিজ সম্পদ, তেল ও গ্যাস প্রকল্প এবং এর সঙ্গে 'সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো বা প্রক্রিয়াজাতকরণ' প্রকল্পের অর্থায়ন করবে।
ডেমোক্র্যাটদের সমালোচনা

মার্কিন কংগ্রেস সদস্য ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা গ্রেগরি মিকস অভিযোগ করেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইউক্রেনকে ব্ল্যাকমেইল করে এই চুক্তি চূড়ান্ত করেছেন। হাউস ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির শীর্ষ ডেমোক্র্যাট নেতা আরও জানান, ট্রাম্পের এখন উচিত হবে জেলেনস্কি ও ইউক্রেন নিয়ে পড়ে না থেকে পুতিনের ওপর চাপ সৃষ্টি করা।
বিশ্বের বিরল ও প্রথাগত খনিজের পাঁচ শতাংশের মালিক ইউক্রেন। তবে দেশটির বেশিরভাগ খনিজ সম্পদ উত্তোলনের কোনো উদ্যোগ এখনো শুরু হয়নি। চলমান যুদ্ধের ফল হিসেবে খনিজ সমৃদ্ধ বেশ খানিকটা ভূখণ্ড রাশিয়ার দখলে চলে গেছে।
বিশ্বের গ্রাফাইট মজুদের ২০ শতাংশ ইউক্রেনে। এটি ইলেকট্রিক ব্যাটারির অপরিহার্য উপকরণ।
পাশাপাশি ম্যাঙ্গানিজ, টাইটানিয়াম ও লিথিয়ামের মতো গুরুত্বপূর্ণ ধাতুর মালিক দেশটি।
Comments