মৃত্যুর আগে কি কোনো জীবনই নেই ফিলিস্তিনিদের

রাতভর ইসরায়েলি বিমান হামলায় গাজায় নিহত ফিলিস্তিনিদের কবর দেওয়ার জন্য স্ট্রেচারে করে বহন করা হচ্ছে। ছবি: এএফপি

প্রায় আট দশক ধরে বিনাশের সব আয়োজন জারি রাখা অবরুদ্ধ 'বধ্যভূমি' ফিলিস্তিনের ছিটমহল গাজায় মৃত্যুই হলো একমাত্র নিশ্চিত অনুষঙ্গ। এই মৃত্যু হতে হলে তো জীবন থাকা বাঞ্ছনীয়। অথচ নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের আদৌ সেই জীবন আছে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন এই মৃত্যু উপত্যকার শীর্ষ কবিদের একজন মুরিদ বারগুতি।

গুলি-বোমা-ক্ষুধা-নির্যাতন আর বিনা চিকিৎসায় অগুনতি মৃত্যু দেখতে অভ্যস্ত মুরিদ বারগুতি লিখেছিলেন—'নিরাশার কালে শুধু মনে রাখি—/মৃত্যুর পরও এক জীবন আছে;/ফলে কোনোই সমস্যা নেই আমার।/কিন্তু প্রশ্ন রাখি:/হে খোদা,/মৃত্যুর আগে কি কোনোই জীবন নেই?'

মুরিদ বারগুতির মতো তারই বন্ধু কিংবদন্তিতুল্য ফিলিস্তিনি কবি মাহমুদ দারবিশ লিখে যান, 'আমার শোক মিছিলে সর্বদাই আমি আগাম হাজির: কে তবে মরে গেল… কে?'

গাজা উপত্যকার কেন্দ্রে নুসেইরাত শিবিরে ইসরায়েলি হামলায় আহত এক ব্যক্তিকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ছবি: এএফপি

এমন সুলভ মৃত্যুর পরিসরেও গত সোমবার মধ্যরাতের পর যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে ঘুমন্ত গাজাবাসীর ওপর নতুন করে যে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে দখলদার ইসরায়েল, এতে বিস্ময়-ক্ষোভে বিমূঢ় গোটা বিশ্ব।

যুদ্ধবিরতির 'স্বস্তি' সঙ্গে নিয়ে ঘর নামের বিধ্বস্ত স্তূপে ফিরে আসা গাজার অনেক বাসিন্দা ওই রাতে ছিলেন গভীর ঘুমে। কেউ কেউ সেহরির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সেই সময় ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান থেকে ফেলা 'যুক্তরাষ্ট্রের নামাঙ্কিত' একের পর এক বোমায় হতাহত হতে থাকেন নারী-শিশুসহ সব বয়সী ফিলিস্তিনি। রাতের অন্ধকারে রক্তাক্ত মানুষের আর্তচিৎকার আর আতঙ্কিতদের দিগ্‌বিদিক ছোটাছুটিতে আবারও 'দোজখ' নেমে আসে এ উপত্যকায়। নির্বিচার হামলায় হাতে হাতে সন্তানের ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহ নিয়ে হাসপাতালের দিকে ছুটতে শুরু করেন অভিভাবকরা।

পরে হোয়াইট হাউস জানায়, গাজায় এ হামলার আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা করেছিল ইসরায়েল।

অ্যাম্বুলেন্সে ইসরায়েলি হামলায় আহত ফিলিস্তিনি শিশু ও প্রাপ্তবয়স্করা। ছবি: এএফপি

ওই রাতে গাজার দক্ষিণে খান ইউনিস ও রাফা, উত্তরে গাজা সিটি এবং মধ্যাঞ্চলের দেইর আল-বালাহসহ প্রায় সব জায়গায় যুদ্ধবিমান ও ড্রোন থেকে চালানো বোমা হামলায় ৪০৪ ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার কথা জানায় গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়; এর মধ্যে ছিল ১৮৩ শিশু ও ৯৪ নারী।

এমন ধ্বংসযজ্ঞ চলাকালে গাজার এক মসজিদ থেকে ক্রন্দনরত মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ফজরের আজানের ভিডিও সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বিপন্ন-বিষাদের ওই ভোর পেরিয়ে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্তাক্ত-মৃত-আহত শিশুদের লাশের ছবি ও ভিডিওতে ছেয়ে যেতে থাকে নিউজফিড। এর কোনো এক ভিডিওতে মেয়েকে হারানো বিলাপরত মাকে বলতে শোনা যায়, 'আমার মেয়ে ক্ষুধার্ত ছিল। সেহরির জন্য ঘরে খাবার ছিল না। ও ক্ষুধার্ত অবস্থাতেই মারা গেছে।'

গাজার আরেক বাসিন্দা মোমেন কোরেইকেহ গণমাধ্যমকে জানান—এ হামলায় নবজাতক, নারী-শিশুসহ পরিবারের ২৬ জন সদস্যকে হারিয়েছেন তিনি।

এদিকে গতকাল বুধবারও গাজার কয়েকটি জায়গায় চালানো হামলায় নিহত ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা বেড়ে ৪৩৬ জনে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র খালিল আল-দাকরান আল জাজিরার আরবি বিভাগকে জানান, এসব হামলায় অন্তত ৯০০ ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন। প্রাথমিক চিকিৎসার অভাব, জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধের সংকটের কারণে অনেক আহত ব্যক্তি মারা গেছেন।

যুদ্ধবিরতির মধ্যে গাজায় এমন হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘসহ কয়েকটি দেশ ও সংস্থা। নিজ দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীনদের চোখ রাঙানি এড়িয়ে ইসরায়েলবিরোধী প্রতিরোধের অনন্য নজির গড়ে যাচ্ছেন অনেক শুভবোধসম্পন্ন ইহুদি। খণ্ড-খণ্ডভাবে বিশ্বের নানা প্রান্তে চলছে প্রতিবাদ। তাতে শামিল হচ্ছেন এই গণহত্যায় প্রত্যক্ষ সমর্থন দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন। এগুলোর মধ্যেই আজ বৃহস্পতিবার থেকে গাজায় স্থল অভিযান বাড়ানোর কথা জানিয়েছে ইসরায়েল।

নুসেইরাত শিবিরে ইসরায়েলি হামলায় আহত একটি মেয়েকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছেন এক ফিলিস্তিনি ব্যক্তি। ছবি: এএফপি

হঠাৎ হামলা কেন?

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় ইসরায়েলে প্রায় এক হাজার ২০০ জন নিহত হন। জিম্মি করা হয় ২৫১ জনকে।

এর প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধবিরতি শুরুর আগ পর্যন্ত গত ১৫ মাসে ইসরায়েলের ব্যাপক আক্রমণে সাড়ে ৪৮ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি প্রাণ হারান।

ইসরায়েলি জিম্মিদের মধ্যে যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্বে ৩৮ জনকে মুক্তি দেয় হামাস। বিনিময়ে ইসরায়েলি কারাগার থেকে প্রায় দুই হাজার বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়।

গত ১৯ জানুয়ারি গাজায় প্রথম ধাপে ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এর মেয়াদ শেষ হয় ২ মার্চ। যুদ্ধবিরতির মূল চুক্তিতে বলা ছিল, প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতি চলাকালে দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা হবে। যদি এর মধ্যেও দ্বিতীয় ধাপের যুদ্ধবিরতির শর্ত নিয়ে সমঝোতা না হয়, তাহলে প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতি চলবে।

ইসরায়েলি হামলার পর এক শিশুকে কোলে নিয়ে গাজা উপত্যকার পূর্বাঞ্চল থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন এক নারী। ছবি: এএফপি

এ ছাড়া, প্রথম ধাপ শেষ হওয়ার পর ২ মার্চ যুদ্ধবিরতির মেয়াদ সাময়িকভাবে বাড়ানোর বিষয়ে অনুমোদন দেয় নেতানিয়াহুর সরকার। পবিত্র রমজান ও ইহুদিদের পাসওভার উৎসব এই মেয়াদের আওতায় পড়ে। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী ২০ এপ্রিল পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়ে।

গত মঙ্গলবার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জানান, তারা 'পূর্ণ শক্তিতে' যুদ্ধ শুরু করেছেন। যে কোনো যুদ্ধবিরতি আলোচনাকে এখন আগুনে ছুড়ে ফেলা হবে।

আল-আহলি আরব হাসপাতালের বাইরে ইসরায়েলি হামলায় নিহতদের মরদেহ ঘোড়ায় টানা গাড়িতে করে বহন করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ছবি: এএফপি

দেড় মাসের বিরতির পর এখনই কেন ইসরায়েল এমন প্রাণঘাতী হামলা শুরু করল এর একটি ব্যাখ্যা হাজির করেছে ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান। মঙ্গলবার 'হোয়াই হ্যাজ ইসরায়েল রিজুউমড লার্জ-স্কেল এয়ার স্ট্রাইকস অন গাজা' শীর্ষক ওই এক্সপ্লেইনারে বলা হয়, ইসরায়েলের এখন যে সামরিক সক্ষমতা আছে তা দেড় মাস আগেও ছিল না। এই সময়টুকুতে তারা নিজেদের গুছিয়ে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সংগ্রহ করা গোলাবারুদ মজুত করেছে। হামাস নেতাদের নতুন সম্ভাব্য অবস্থানগুলো চিহ্নিত করেছে। এছাড়া এ সময়ের মধ্যে যুদ্ধবিমানসহ অন্যান্য সরঞ্জাম মেরামতের পাশাপাশি সৈন্যদেরও বিশ্রামের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।

সমালোচকদের ভাষ্য, নেতানিয়াহু কখনোই যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপে যেতে চাননি। তা হলে ইসরায়েলি বাহিনীকে গাজা থেকে সরে যেতে হতো। এতে হামাসের জন্য পুনরায় গাজার পুরো নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার সুযোগ তৈরি হতো।

'শহীদের আলো ছাড়া সবকিছুই কালো'

২০২৩ সালের ২০ অক্টোবর গাজায় বিমান হামলায় স্তব্ধ হয়ে যায় ফিলিস্তিনের কবি ও ঔপন্যাসিক আবু নাদার কণ্ঠ। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে এই নারী কবি লিখেছিলেন, 'রকেটের আলো ছাড়া গাজা অন্ধকার, বোমার শব্দ ছাড়া গাজা নীরব, প্রার্থনা ছাড়া আর সবকিছুই এখানে ভয়ংকর, শহীদের আলো ছাড়া সবকিছুই কালো।'

মাঝে দেড় মাসের যুদ্ধবিরতির পর গত মঙ্গলবার রাতে এক ভিডিও বিবৃতিতে নেতানিয়াহু নতুন করে ইসরায়েলি হামলা শুরুর প্রসঙ্গে সতর্ক করে বলেন, 'এটা কেবল শুরু।'

আর হামাসের সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর ভাষ্য, হামলার মধ্যেই তা চলবে।

আজ বৃহস্পতিবারও ইসরায়েলি বাহিনীর জোরালো হামলা ও স্থল অভিযানের মধ্যে এক বিবৃতিতে গাজা থেকে জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা ও হামাসকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য ফিলিস্তিনিদের প্রতি 'সর্বশেষ সতর্কতা' জারি করেছে ইসরায়েল।

রাতভর ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত এই ফিলিস্তিনি শিশুটির মরদেহ গাজা সিটির আল-আহলি আরব হাসপাতাল প্রাঙ্গনে একটি স্ট্রেচারে শুইয়ে রাখা হয়েছে। ছবি: এএফপি

গাজার বাসিন্দাদের উদ্দেশে দেওয়া সতর্কতামূলক ভিডিওতে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কার্তজ বলেছেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পরামর্শ মেনে নিন। জিম্মিদের ফিরিয়ে দিন। আর হামাসকে (ক্ষমতা থেকে) সরিয়ে দিন। যারা গাজা ছেড়ে স্বেচ্ছায় বিশ্বের অন্যত্র চলে যেতে চান, সেটাসহ আরও অনেক বিকল্প আপনাদের জন্য উন্মুক্ত হবে।'

এখন প্রশ্ন হলো—এমন আপস কি মানতে চাইবেন ফিলিস্তিনিরা?

এখানেও শরণ নেওয়া যেতে পারে মাহমুদ দারবিশের। ২০০৮ সালে মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগে ছাপা এক কবিতায় তিনি কল্পিত এক ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলির কথোপকথন হাজির করেছিলেন। কথোপকথনটি এ রকম—

'সে বললো: এসো আমরা এখন আপস-মীমাংসা করি

আমি বললাম: কিসের মীমাংসা এখন, এই কবরের গর্তে?

সে বললো: এই কবর ভাগ করবো আমার আর তোমার মধ্যে

আমি বললাম: কী কাজে লাগবে সেটা?

সময় আমাদের ছেড়ে গেছে

আমাদের ভাগ্য নিয়মের ব্যতিক্রম

এখানে শুয়ে আছে হন্তারক এবং নিহত দুজনই, একই গর্তে ঘুমোচ্ছে তারা।

এই দৃশ্যের সমাপ্তি টানবে অন্য কোনো কবি, তার জন্য অপেক্ষা করো।'

সুতরাং, অবরুদ্ধ এ জন্মভূমিতে ফিলিস্তিনিরা 'জীবন' খুঁজে না পেলেও গত ৮০ বছর ধরে মৃত্যু যাদের কাছে জীবনের অপর নাম, তাদের প্রতি ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এমন হুমকি কতটা কার্যকর হবে, তা সময়ের হাতেই তোলা থাক।

Comments

The Daily Star  | English
Apparel Buyers Delay Price Increases Post-Wage Hike Promise

Garment exports to US grow 17%

Bangladesh shipped apparels worth $5.74 billion in the July-March period to the USA

5h ago