ব্রিকস সম্মেলন: পুতিনের নেতৃত্বে আসবে পশ্চিম-বিরোধী ‘নতুন বিশ্বব্যবস্থা’র ডাক?

ভ্লাদিমির পুতিন
ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে গত দুই বছরে রাশিয়া ও দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে একের পর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কোণঠাসা করার চেষ্টা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শিবির। কিন্তু পশ্চিমের এই চাপ যে খুব একটা কাজে আসেনি, তার প্রমাণ আজ মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া ব্রিকস সম্মেলন।

২০ জনেরও বেশি রাষ্ট্রপ্রধানের অংশগ্রহণে এই সম্মেলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ডলার-কেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প নিয়ে আসতে পারে পশ্চিম-বিরোধী এই জোট। খবর বিবিসি ও সিএনএনের।

কাজানে আয়োজিত এই সম্মেলনকে রাশিয়ার মাটিতে ইতিহাসের অন্যতম 'বড় মাপের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক সম্মেলন' হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে ক্রেমলিন। এখানে আমন্ত্রিত রাষ্টপ্রধানদের মধ্যে রয়েছেন চীনের শি জিনপিং, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। অসুস্থতার জন্য ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বৈঠকে যোগ দেবেন।

নতুন বিশ্বব্যবস্থা

শুরুতে রাশিয়া, চীন, ভারত ও ব্রাজিলকে নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল ব্রিকস (তৎকালীন নাম ব্রিক)। ২০১০ সালে যোগ দেয় দক্ষিণ আফ্রিকা। চলতি বছরের শুরুতে এই জোটে যোগ দেয় নতুন চার দেশ—মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। মূলত উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত এই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জোটের জিডিপি (দেশজ উৎপাদন) সম্প্রতি পশ্চিমা জোট জি সেভেনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার দাবি করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট।

রুশ সংবাদ সংস্থা তাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত শুক্রবার ব্রিকস বিজনেস ফোরামের বৈঠকে পুতিন বলেন, '১৯৯২ সালে বৈশ্বিক অর্থনীতির ৪৫ দশমিক পাঁচ শতাংশ ছিল জি-৭'র দখলে, ব্রিকস রাষ্ট্রগুলোর দখলে ছিল মাত্র ১৬ দশমিক সাত শতাংশ। কিন্তু এখন? ২০২৩ সালে আমাদের জোটের (ব্রিকস) ভাগ এসে দাঁড়ায় ৩৭ দশমিক চার শতাংশে, আর তাদের ২৯ দশমিক তিন শতাংশে'। এই ব্যবধান সামনে আরও বাড়বে বলে ঘোষণা দেন পুতিন।

বিবিসির মতে, ব্রিকস দেশগুলোর মোট জনসংখ্যা প্রায় ৩৫০ কোটি, যা বৈশ্বিক জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানায়, এবারের সম্মেলনে ব্রিকসকে 'বৈশ্বিক সংখ্যাগরিষ্ঠের জোট' হিসেবে ঘোষণা করতে পারেন পুতিন। বলতে পারেন, নিজেদের মাঝে জোট করে ও বাকিদের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে রেখে পশ্চিমা দেশগুলোই এখন বাকি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।

কনসালটেন্সি ফার্ম ম্যাক্রো-অ্যাডভাইজরির প্রতিষ্ঠাতা ক্রিস ওয়েফার বিবিসিকে বলেন, 'রাশিয়াকে কোণঠাসা করতে (পশ্চিমা দেশগুলোর) প্রচেষ্ঠা যে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে, সেই বার্তা দিচ্ছে এই সম্মেলন। ক্রেমলিন দেখাচ্ছে, এসব নিষেধাজ্ঞা তাদের ভোগাচ্ছে না। নিজের মধ্যে বিভেদ থাকলেও ভূ-রাজনৈতিক পর্যায়ে এই দেশগুলো সবাই রাশিয়ার বন্ধু। তারা সবাই রাশিয়ার সঙ্গে জোট গড়তে চায়।'

রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের সম্মেলনে ৪০টিরও বেশি দেশ ব্রিকসে যোগ দেওয়ার জন্য ইচ্ছে প্রকাশ করেছে। সেখান থেকে চারটি দেশকে এ বছর নতুন সদস্যপদ দিয়েছে জোটটি। এবারের সম্মেলনেও নতুন কয়েকটি দেশের নাম যোগ হতে পারে।

সিএনএন জানায়, শুক্রবারের বৈঠকে পুতিন আরও বলেন, ব্রিকস জোট ও আগ্রহী দেশগুলো একসঙ্গে কাজ করলে তারা 'একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থা' গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।

২০১৭ সালের ব্রিকস সম্মেলন। ছবি: এএফপি

ডলারের বিকল্প মুদ্রা

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ব্রিকসের প্রধান লক্ষ্যগুলোর একটি ছিল, ডলারের বিকল্প একটি মুদ্রা ব্যবস্থা তৈরি করা। বর্তমানে যেকোনো আন্ত-রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ও ঋণের ক্ষেত্রে মুদ্রা হিসেবে মার্কিন ডলার ব্যবহার করা হয়। বিশ্বব্যাংক নিয়ন্ত্রিত বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার মূল মুদ্রাও মার্কিন ডলার।

এই কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের জন্য যেকোনো দেশকে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া অনেক সহজ হয়ে যায়। এসব নিষেধাজ্ঞায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে রাশিয়া, ইরান ও চীন।

বিশ্লেষক ক্রিস ওয়েফার বিবিসিকে বলেন, 'শুধুমাত্র ডলারের জন্য বৈশ্বিক বাণিজ্যের ওপর বিশাল প্রভাব বিস্তার করতে পারে মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ। কারণ ডলার দিয়েই হয় সব বাণিজ্য। ডলারের এই আধিপত্য ভাঙতে চায় রাশিয়া। ব্রিকস দেশগুলোকে নিয়ে একটি বিকল্প বাণিজ্যব্যবস্থা তৈরি করতে চায় তারা, যেখানে ডলার, ইউরো বা জি-৭ দেশগুলোর মুদ্রার প্রয়োজন পড়বে না। তখন আর (পশ্চিমা) নিষেধাজ্ঞা খুব একটা কাজে আসবে না।'

২০১৯ সালের ব্রিকস সম্মেলন। ছবি: রয়টার্স

ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতে ব্রিকসের অবস্থান

শুরুতে কেবল একটি অর্থনৈতিক জোট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও এখন ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতগুলো নিয়েও মত প্রকাশ করছে ব্রিকস। গত বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় হওয়া ব্রিকস সম্মেলনে সশরীরে যোগ দিতে পারেননি পুতিন। ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন।

এবারের আয়োজক রাষ্ট্র রাশিয়া। এই সম্মেলনে একটি বড় আলোচনার বিষয় হতে পারে ইউক্রেন যুদ্ধ। গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ফাঁকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ছয় দফার একটি শান্তি পরিকল্পনা ঘোষণা করে চীন ও ব্রাজিল। এই সম্মেলনের আবার আলোচনায় ফিরতে পারে এই ছয় দফা।

সিএনএন জানায়, এবারের সম্মেলনের একটি বড় অংশজুড়ে থাকবে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট। ফিলিস্তিনি নেতা মাহমুদ আব্বাস যোগ দিচ্ছেন এবারের সম্মেলনে।

রাশিয়া ও চীন দুই দেশই এই সংকটে ইসরায়েলের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেছে। দুই দেশই দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়ে আসছে। জোটের আরেক রাষ্ট্র ইরান বর্তমানে সরাসরি ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িত।

বেশ কিছু পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম দাবি করেছে, গত এক বছর ধরে রাশিয়া, চীন ও ইরান একে-অপরের সঙ্গে যুদ্ধাস্ত্র লেনদেন করছে।

আটলান্টিক কাউন্সিলের আবুধাবি-ভিত্তিক সিনিয়র ফেলো জোনাথন ফুলটন সিএনএনকে বলেন, মধ্যপ্রাচের সংঘাতকে ইঙ্গিত করেই তারা বলার চেষ্টা করবে বৈশ্বিক রাজনীতিতে এই জোটের প্রভাব কেন আরও বড় হওয়া উচিত।

Comments

The Daily Star  | English
Apparel Buyers Delay Price Increases Post-Wage Hike Promise

Garment exports to US grow 17%

Bangladesh shipped apparels worth $5.74 billion in the July-March period to the USA

5h ago