শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট, কে এই অনুড়া কুমারা দিশানায়েকে?

নির্বাচনে ভোট দেওয়ার পর থাম্বস আপ দেখাচ্ছেন দিশানায়েকে। ছবি: এএফপি
নির্বাচনে ভোট দেওয়ার পর থাম্বস আপ দেখাচ্ছেন দিশানায়েকে। ছবি: এএফপি

শ্রীলঙ্কার বামপন্থি রাজনীতিবিদ অনুড়া কুমারা দিশানায়েকে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। ২০২২ সালে গোতাবায়া রাজাপাকসের সরকার উৎখাতের পর প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়ে ইতোমধ্যে শপথও নিয়েছেন তিনি।

শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দ্বিতীয়বার ভোট গণনার পর ৫৫ বছর বয়সী দিশানায়েকে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিরোধী নেতা সাজিথ প্রেমাদাসাকে পরাজিত করেন। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে তৃতীয় অবস্থানে ছিলেন।

২০১৯ সালের নির্বাচনে মাত্র তিন শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন দিশানায়েকে। তিনি বামপন্থি জোট ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ারের (এনপিপি) প্রার্থী হিসেবে ওই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। সে হিসেবে তার এই ঘুরে দাঁড়ানোকে 'বিস্ময়কর' ও 'অভাবনীয়' বলে অভিহিত করেছেন বিশ্লেষকরা।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দুর্নীতিবিরোধী প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে তিনি সোচ্চার ছিলেন। পাশাপাশি, দেশের চরম অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্যে দরিদ্রদের সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে নীতিমালা তৈরির অঙ্গীকারও করেছেন।

তিনি এমন এক জাতির হাল ধরেছেন, যেটি এখনো ২০২২ সালের নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকট থেকে পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। পাশাপাশি, তার প্রতি জনগণের প্রত্যাশাও অনেক। তাদের বড় একটি অংশ 'পরিবর্তন' চায়।

এক মার্কসবাদী নেতার উত্থান

জয়ী হওয়ার পর নির্বাচন কমিশনের অফিস থেকে বের হয়ে আসছেন দিশানায়েকে। ছবি: এএফপি
জয়ী হওয়ার পর নির্বাচন কমিশনের অফিস থেকে বের হয়ে আসছেন দিশানায়েকে। ছবি: এএফপি

১৯৬৮ সালের ২৪ নভেম্বর শ্রীলঙ্কার মধ্যাঞ্চলের গালেওয়েলা শহরে দিশানায়েকের জন্ম। সেখানে নানা সংস্কৃতি-ধর্মের মানুষের সঙ্গে মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠেন তিনি। সরকারি স্কুলে পড়া শেষে স্নাতক নেন পদার্থবিদ্যায়।

১৯৮৭ সালের দিকে ভারত-শ্রীলঙ্কা চুক্তি হয়। সে সময় ছাত্র রাজনীতিতে প্রবেশ করেন তিনি।

১৯৮৭ থেকে ১৯৮৯—এই দুই বছর মার্কসবাদী রাজনৈতিক দল জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (জেভিপি) তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহে অংশ নেয়। পরে এই দলের নেতা হন দিশানায়েকে।

এই দুই বছর মূলত গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত তরুণরা মার্কসবাদী দলের পতাকায় এক হয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও বেসামরিক মানুষদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র ও জঙ্গি হামলা চালায়। সেই বিক্ষোভে প্রাণ হারান হাজারো মানুষ।

১৯৯৭ সালে জেভিপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হন দিশানায়েকে। ২০০৮ সালে দলের প্রধান হন তিনি। এরপর ওই দুই বছর আতঙ্ক সৃষ্টি ও সহিংসতার জন্য নিজ দলের ভূমিকায় ক্ষমা চেয়েছেন দিশানায়েকে।

২০১৪ সালে বিবিসিকে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'ওই সংঘাতের সময় এমন অনেক কিছুই হয়েছে, যা অনুচিত। আমরা খুবই অনুতপ্ত। আমাদের হাত ধরে যেসব কাজ হয়েছে, তা একদমই ঠিক হয়নি। আমরা সবসময় সেসব ঘটনার ভয়াবহতায় দুঃখিত ও হতবাক হই।'

শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টে এ মুহূর্তে জেভিপির তিনটি আসন আছে। তবে এনপিপি জোটের অংশ হিসেবে তিনি প্রেসিডেন্ট হয়েছেন।

ভিন্নধর্মী নেতা দিশানায়েকে

সংবাদপত্রের পাতায় দিশানায়েকের বিজয়ের খবর। ছবি: রয়টার্স
সংবাদপত্রের পাতায় দিশানায়েকের বিজয়ের খবর। ছবি: রয়টার্স

২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল রাজধানী কলম্বোর বেশ কয়েকটি গির্জা ও আন্তর্জাতিকমানের হোটেলে ধারাবাহিক বোমা হামলার মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটে। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র দিন ইস্টার সানডের ওই ভয়াবহ ঘটনায় অন্তত ২৯০ জন নিহত ও হাজারো মানুষ আহত হন।

পাঁচ বছর পরও ওই ঘটনার নেপথ্যে কে বা কারা ছিলেন, সরকারি তদন্তে তা উদ্ঘাটিত হয়নি।

কেউ কেউ দাবি করেন, গোতাবায়ার সরকার ওই তদন্ত প্রক্রিয়ায় বাধা দিয়েছে।

সম্প্রতি দিশানায়েকে বিবিসিকে বলেন, তিনি নির্বাচিত হলে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে তদন্ত করবেন। তিনি ইঙ্গিত দেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিজেদের দায় প্রকাশের ভয়ে বিষয়টির সুষ্ঠু তদন্ত করেনি।

তিনি আরও বলেন, 'শুধু এই তদন্তই নয়। রাজনীতিবিদরা দুর্নীতি থামানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজেরাই দুর্নীতিতে ডুবে গিয়েছিলেন। যারা ঋণমুক্ত শ্রীলঙ্কার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তারা ঋণের বোঝা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। যারা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন, তারা নিজেরাই আইনভঙ্গ করেছিলেন।'

'এসব কারণেই এ দেশের মানুষ ভিন্নধর্মী নেতৃত্ব চাইছে। আমরাই জাতির এই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারব,' যোগ করেন দিশানায়েকে।

পরিবর্তনে বিশ্বাসী দিশানায়েকে

নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর উল্লসিত দিশানায়েকের ভক্তরা। ছবি: এএফপি
নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর উল্লসিত দিশানায়েকের ভক্তরা। ছবি: এএফপি

দিশানায়েকের নির্বাচনী প্রচারণার মূল সুর ছিল পরিবর্তন। তিনি দেশের মানুষের অসন্তোষ দূর করতে চান। তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চান।

নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকটের জন্য মানুষ রাজাপাকসে ও তার সরকারকে দায় দেয়। তার উত্তরসূরী রনিল বিক্রমাসিংহে অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমান। শ্রীলঙ্কার মুদ্রাও আগের তুলনায় খানিকটা শক্তিশালী হয়। তারপরও দুর্দশা পুরোপুরি দূর হয়নি। কারো মতে, তা দূর হওয়ার ধারেকাছেও যায়নি।

বিশ্লেষকদের ভাষ্য, গোতাবায়া ও তার পূর্বসূরী সরকারগুলো দুর্নীতি, রাজনীতিক দায়মুক্তি ও অপশাসনের কারণে ভিন্নধর্মী রাজনীতি ও রাজনীতিবিদের ধারণার দিকে ঝুঁকে পড়েছে লঙ্কাবাসীরা। এতে সুগম হয় দিশানায়েকের বিজয়ের পথ।

তিনি দেশের রাজনীতিকে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বেড়াজাল থেকে মুক্ত করার অঙ্গীকার করেন।

তিনি একাধিকবার বলেছেন, ক্ষমতায় এলে পার্লামেন্টে ভেঙে দেবেন। সবকিছু নতুন করে শুরু করবেন। সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে তিনি আবারও জানান, ক্ষমতায় এলে দুই-তিন দিনের মধ্যেই এর উদ্যোগ নেবেন।

'যে পার্লামেন্টে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন নেই, সেই পার্লামেন্ট রাখার অর্থ নেই।'

দরিদ্রদের প্রতিনিধি

জয়ী হওয়ার পর নির্বাচন কমিশনের অফিস থেকে বের হয়ে আসছেন দিশানায়েকে। ছবি: এএফপি
জয়ী হওয়ার পর নির্বাচন কমিশনের অফিস থেকে বের হয়ে আসছেন দিশানায়েকে। ছবি: এএফপি

দিশানায়েকের প্রতিশ্রুত নীতিমালার মধ্যে আছে কঠোর দুর্নীতিবিরোধী আইন প্রণয়ন ও এ সংক্রান্ত উদ্যোগের বাস্তবায়ন, সুরক্ষা বলয়কে আরও বিস্তৃত করা ও করের বোঝা কমানো।

আইএমএফ'র ঋণের শর্ত মেনে বিদায়ী সরকার কয়েকটি খাতে ভর্তুকি তুলে নিতে ও কর বাড়াতে বাধ্য হয়। অর্থনীতির চাকা সচল করতে উদ্যোগ নেওয়া হলেও এতে মানুষের দুর্ভোগ ও অসন্তোষ বেড়ে যায়।

এসব সমস্যার সমাধান করবেন বলে কথা দিয়েছেন দিশানায়েকে। তার দাবি, জনবান্ধব নয় এমন কর বিলুপ্ত করবেন এবং ফিরিয়ে আনবেন গুরুত্বপূর্ণ খাতে সরকারি সহায়তা।

বিশ্লেষকদের মতে, ভোটাররা দিশানায়েকের এ ধরনের আশ্বাসে প্রভাবিত হয়েছেন।

শপথ নিচ্ছেন দিশানায়েকে। ছবি: এএফপি
শপথ নিচ্ছেন দিশানায়েকে। ছবি: এএফপি

বিশ্লেষকরা দিশানায়েকের অর্থনৈতিক নীতিমালার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এ ধরনের নীতিমালায় আর্থিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাধা পড়তে পারে। শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া থমকে যেতে পারে।

নির্বাচনী প্রচারণায় একটি কথা তিনি বারবার বলেছিলেন, তা হলো—বিজয়ী হলে শ্রীলঙ্কার ঋণ পরিশোধে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবেন তিনি।

আরও জানান, আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থার (আইএমএফ) ঋণের ক্ষেত্রে নতুন করে দর কষাকষি করবেন। তিনি সংস্থাটির আরোপ করা শর্ত অন্ধের মতো মানতে চান না।

বেশিরভাগ বিশ্লেষকের মতে, দিশানায়েকের সামনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করা।

Comments

The Daily Star  | English
price hike of essential commodities in Bangladesh

Essential commodities: Price spiral hits fixed-income families hard

Supply chain experts and consumer rights activists blame the absence of consistent market monitoring, dwindling supply of winter vegetables, and the end of VAT exemptions granted during Ramadan.

13h ago