হুতিরা ইসরায়েলের জন্য কি ভয়ংকর হয়ে উঠছে

huti
ইয়েমেনের রাজধানী সানায় হুতিদের কুচকাওয়াজ। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

শিল্পোন্নত সাত দেশ বা জি-সেভেনের আলোচনায় 'ইরান সমর্থিত' হুতি। এই জোটের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা আন্তর্জাতিক নৌচলাচলের পথে হুমকি হয়ে না ওঠার জন্য হুতিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি তারা হুতিদের হাতে আটক পণ্যবাহী জাহাজ গ্যালাক্সি লিডার ও এর ক্রুদের দ্রুত মুক্তির আহ্বানও জানান।

গত বুধবার বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।

জি-সেভেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এমন আহ্বানে বোঝা যায়, ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের গুরুত্ব এখন আর দেশটির চৌহদ্দির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এমনকি, আঞ্চলিক পরিসর ছাপিয়ে হুতিরা যে এখন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত বিষয়, তা এই সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহে উঠে আসছে।

গত সোমবার জার্মান গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলের এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, 'হুতিদের ইসরায়েলি জাহাজ আটকের কারণে বিপর্যয়ের মুখে আন্তর্জাতিক নৌচলাচল।'

বেসরকারি নৌচলাচল নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান সিগাল মেরিটাইমের চিফ অপারেটর অফিসার (সিওও) দিমিত্রিস মানিয়াতিস জার্মান গণমাধ্যমটিকে বলেন, 'আমরা আশঙ্কা করছি, এমন ঘটনা আরও ঘটবে। হুতিরা দেখিয়েছে যে তারা তা করার সামর্থ্য রাখে। তারা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়। ইসরায়েলি জাহাজ সম্পর্কে তাদের কাছে তথ্য আছে। তারা জানে যে তারা কী করছে। তারা ইসরায়েলি জাহাজগুলোকে লক্ষ্য করবে। সেগুলোকে অনুসরণ করা খুবই সহজ।'

ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধে হুতিদের অবস্থান

গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র রাষ্ট্র ইয়েমেনের হুতিদের সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। যা জানা যায় তা হচ্ছে—হুতিরা 'ইরান-সমর্থিত' বিদ্রোহী গোষ্ঠী। শিয়া মতাম্বলী এই গোষ্ঠী ইয়েমেনের স্বীকৃত সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করায় প্রতিবেশী সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যে সুন্নি মতাবলম্বী অন্যান্য আরব দেশকে সঙ্গে নিয়ে হুতিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং যুদ্ধ ঘোষণা করে।

তবে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূর থেকে ইরান কীভাবে হুতিদের সমর্থন বা সহায়তা দিচ্ছে, সে সম্পর্কে বিশ্ব গণমাধ্যম থেকে সুনির্দিষ্টভাবে তেমন কিছু জানার সুযোগ কম।

বছর খানেক আগেও যখন হুতিরা প্রতিবেশী সৌদি আরবে নিয়মিত ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালাত, তখন তা কেবল আঞ্চলিক সংবাদমাধ্যম বিশেষ করে সৌদি সংবাদমাধ্যমেই শিরোনাম হতো।

গত ১৯ নভেম্বর এই হুতিরা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রধান শিরোনাম হয় মূলত লোহিত সাগরে ব্রিটিশ মালিকানাধীন ও জাপান থেকে পরিচালিত 'গ্যালাক্সি লিডার' জব্দ ও এর ২৫ ক্রুকে জিম্মি করার মধ্য দিয়ে।

সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, সশস্ত্র ব্যক্তিরা হেলিকপ্টারে করে জাহাজটির পিছু নেন। তারা হেলিকপ্টার থেকে জাহাজের ছাদে নামেন। জাহাজে উড়িয়ে দেন ফিলিস্তিন ও ইয়েমেনের পতাকা।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জাহাজ জব্দের সংবাদ বিশ্ব গণমাধ্যমকে জানিয়ে বলেন, এটি ইসরায়েলের না। যাদেরকে জিম্মি করা হয়েছে, তাদের মধ্যে কোনো ইসরায়েলি নেই।

এই বার্তার মধ্য দিয়ে নেতানিয়াহু এক ধরনের স্বস্তি প্রকাশ করলেও এ ঘটনার পরপরই পশ্চিমের বিশ্লেষকদের আলোচনায় উঠে আসে হুতি প্রসঙ্গ।

গত ৭ অক্টোবর দুর্ভেদ্য সীমানা প্রাচীর ভেঙে অবরুদ্ধ গাজা থেকে হামাস ও ইসলামি জেহাদের সদস্যরা ইসরায়েলে হামলা চালালে তেল আবিব সব শক্তি নিয়ে গাজাবাসীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেসময় লেবাননে ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহ সশস্ত্র সংগঠনের মতো ইয়েমেনে ইরান-সমর্থিত হুতিরাও ইসরায়েলকে হুমকি দেয়।

এরপর হুতিরা হামাসের সমর্থনে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরের ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়। অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ইসরায়েল সেগুলো আকাশেই ধ্বংস করে দেওয়ায় আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের অনেকে হুতিদের 'গুরুত্বহীন' মনে করতে থাকেন। এ দৃশ্যপট পাল্টে যায় ১৯ নভেম্বর লোহিত সাগরে হুতিদের হাতে জাহাজ আটকের মধ্য দিয়ে।

গত ২৪ নভেম্বর ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম তেহরান টাইমসের মূল শিরোনাম হয়, 'ফিলিস্তিন ইস্যু ইয়েমেনের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম অগ্রাধিকার'।

হুতি নিয়ন্ত্রিত ইয়েমেনি সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ কমান্ডার ও ইয়েমেনি বিমান বাহিনীর সাবেক মুখপাত্র মেজর জেনারেল আব্দুল্লাহ আল-জাফরি বিশেষ সাক্ষাৎকারে সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, 'আমাদের নেতা সৈয়দ আব্দুল মালিক বিন বদর আল দিন আল হুতি নির্দেশ দিয়েছেন যে, ইসরায়েলের যেকোনো জাহাজ অবশ্যই আটক করতে হবে।'

তিনি মনে করেন, গাজায় ইসরায়েল ও আমেরিকা আগ্রাসন চালাচ্ছে। ফিলিস্তিনের পক্ষে সমাবেশ করা ১০ লাখ ইয়েমেনি চায় এর জবাব দেওয়া হোক।

আব্দুল্লাহ আল-জাফরি আরও বলেন, 'ধর্ম, জাতীয়তা, নৈতিকতা, মানবিকতা ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইয়েমেন জোরালো কণ্ঠে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ঘোষণা দিচ্ছে যে, তারা জায়নবাদীদের (ইসরায়েলপন্থি) বিরুদ্ধে সরাসরি সংঘাতে জড়াচ্ছে।'

Yemen e Palestine er pokhye somabesh
ইয়েমেনের রাজধানী সানায় ফিলিস্তিনিদের পক্ষে হুতিদের সমাবেশ। ২০ অক্টোবর ২০২৩। ছবি: রয়টার্স

হুতিরা নতুন হুমকি?

প্রথম দিকে ইয়েমেনের সংখ্যালঘু শিয়া মতাম্বলীরা দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নি নেতৃত্বের বিরোধী ছিলেন। সেই নেতৃত্বের প্রতি সৌদি সমর্থন থাকায় নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হুতিরা হয়ে উঠেন সৌদিবিরোধী। এখন হুতিরা লড়াই করছেন মহাশক্তিধর যুক্তরাষ্ট্র ও এর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলের বিরুদ্ধে।

গত সোমবার মার্কিন সেনাবাহিনীর বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানায়, গত রোববার ইয়েমেনের হুতি-নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে এডেন উপসাগরে টহলরত মার্কিন যুদ্ধজাহাজকে লক্ষ্য করে দুইটি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার ঘটনা ঘটেছে।

প্রতিবেদন অনুসারে—ইউএস সেন্ট্রাল কমান্ডের এক বার্তায় বলা হয়, কয়েকজন অস্ত্রধারী ফসফরিক এসিড বহনকারী বাণিজ্যিক ট্যাংকার 'সেন্ট্রাল পার্ক' জব্দ করতে যাওয়ায় সহায়তার জন্য ট্যাংকারের ক্রুরা আবেদন জানালে মার্কিন নৌবাহিনী এগিয়ে আসে। সেসময় মার্কিন যুদ্ধজাহাজ লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়।

একই দিনে পেন্টাগনের মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল প্যাট রাইডার বলেন, আন্তর্জাতিক নৌপথের নিয়ম হচ্ছে যখন কেউ সহায়তার জন্য আবেদন করেন তখন কাছাকাছি থাকা জাহাজগুলোকে এগিয়ে আসতে হয়। তিনি জানান যে, সেসময় কাছাকাছি চীনা নৌবাহিনীর তিনটি জাহাজ থাকলেও তারা 'সহায়তার ডাকে সাড়া দেয়নি'।

গত ১০ বছরের ঘটনা প্রবাহ দেখে মনে হচ্ছে, ইয়েমেনের 'ঘরোয়া শক্তি' থেকে 'আঞ্চলিক মাথাব্যথা' হয়ে ওঠা হুতিরা যেন গত ৭ অক্টোবরের পর ক্রমশ 'আন্তর্জাতিক হুমকি' হয়ে উঠছে।

ইসরায়েলকে ঘিরে 'অগ্নিবলয়'

ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধে হুতিদের 'জড়িয়ে পড়া'র প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ইসরায়েলকে ঘিরে ইরানের 'অগ্নিবলয়' সৃষ্টির সংবাদ  জানানো হচ্ছে।

এই 'অগ্নিবলয়' বলতে বিশ্লেষকরা ভূমধ্যসাগর তীরে ইসরায়েলকে ঘিরে হামাস, হিজবুল্লাহ ও হুতিদের অবস্থানের পাশাপাশি সিরিয়া ও ইরাকে ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর উপস্থিতির কথা নতুন করে জানান দিচ্ছেন।

গত ১৭ অক্টোবর দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়, 'বিস্তৃত যুদ্ধের মুখে মধ্যপ্রাচ্য, সব সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে ইরান'।

প্রতিবেদনে ওয়াশিংটনভিত্তিক মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো ফিরাস মাকসাদ বলেন, 'হামাস যদি নির্মূল হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়, তাহলে ইরান কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত হাতে পেয়ে যাবে। ইরান তখন আঞ্চলিক কৌশলগত "অগ্নিবলয়" সামনে নিয়ে আসবে।'

gyaalaaksi_liddaar
লোহিত সাগরে হুতিদের হাতে জব্দ হওয়া পণ্যবাহী জাহাজ গ্যালাক্সি লিডার। ছবি: রয়টার্স

হুতি কারা?

পশ্চিমের চোখে হুতিরা বিদ্রোহী। কেননা, তারা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইয়েমেনি সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে দেশটির রাজধানী সানাসহ বিস্তৃত এলাকা দখলে নিয়েছে। দেশটির বাকি অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে ইয়েমেন সরকার ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সমর্থন পাওয়া অন্যান্য সশস্ত্র সংগঠনগুলো।

২০১১ সালে আরব বসন্তের দমকা হাওয়ায় অনুপ্রাণিত গণতন্ত্রপন্থিদের আন্দোলনে ইয়েমেনে ২২ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট আলি আব্দুল্লাহ সালেহর পতন হয়। এরপর ক্ষমতা নেন ভাইস প্রেসিডেন্ট মনসুর হাদি। এক বছর পর নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রেসিডেন্ট হয়ে তিনি বিরোধীদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করলে হাদিবিরোধী বা সালেহপন্থিরা আবার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন।

রাজনৈতিক সংকটের এমন ডামাডোলে ইয়েমেনের প্রেসিডেনশিয়াল ভবনে আত্মঘাতী হামলা চালানোর দায় স্বীকার করে আলোচনায় আসে আল কায়েদা। সন্ত্রাসীদের দমন করতে মার্কিন সেনাদের একটি 'ছোট দল' আসে ইয়েমেনে। এমন পরিস্থিতিতে আরও জটিল হয়ে উঠে ইয়েমেনের রাজনীতি।

২০১৪ সালে শিয়া নেতা সৈয়দ আব্দুল মালিক বিন বদর আল দিন আল হুতির নেতৃত্বে ইয়েমেনে শুরু হয় সরকার, সন্ত্রাস ও মার্কিনবিরোধী 'হুতি আন্দোলন'।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে হুতিদের তুলে ধরা হয় ইরানের সমর্থনপুষ্ট 'সন্ত্রাসী গোষ্ঠী' হিসেবে। ইরানের ভাষায় তারা ইয়েমেনের 'প্রতিরোধ যোদ্ধা'। তাদের সংগঠনের নাম 'আনসার আল্লাহ' হলেও তারা মূলত তাদের নেতা আল হুতির নামেই বেশি পরিচিত।

তবে হুতিরা যাই হোন না কেন মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সরব উপস্থিতি এখন যেন এটাই জানান দিচ্ছে যে—লোহিত সাগর তথা এডেন উপসাগর হয়ে যেসব জাহাজ ইসরায়েল বা ইউরোপ-আমেরিকা থেকে এশিয়ায় যাওয়া-আসা করবে, তাদেরকে বাড়তি নিরাপত্তার কথা মাথায় নিয়েই পথ চলতে হবে।

Comments