যে মন্ত্রে চলছে নরেন্দ্র মোদির রথ

যে মন্ত্রে চলছে নরেন্দ্র মোদির রথ
নরেন্দ্র মোদি। ছবি: রয়টার্স

অস্কারজয়ী 'লাইফ অব পাই'র নায়ক পাই প্যাটেল বা সুরাজ শর্মা যখন তার বাবাকে বলেন, 'কলম্বাসই তো চেয়েছিলেন ভারতে আসতে, তাহলে আমরা কেন আমেরিকায় যাবো?'

সুরাজের এই শ্লেষযুক্ত বাক্য একদিকে যেমন ভারতের প্রতি পশ্চিমের দীর্ঘদিনের আগ্রহের কথা তুলে ধরে, অন্যদিকে তা ভারতের স্বকীয়তার সৌন্দর্যও সগৌরবে ফুটিয়ে তোলে।

ভারতের প্রতি পশ্চিমের আগ্রহ শুধু ইতালীয় নাবিক কলম্বাসই দেখাননি, তারও বহু আগে গ্রিক বীর আলেক্সান্ডার তা দেখিয়েছিলেন। 'আর্য জনগোষ্ঠী' নিয়ে প্রচলিত ধারণাকে আমলে নিলে এ কথা বলা যায় যে ভারতের সঙ্গে ইউরোপের সম্পর্ক শুধু ঐতিহাসিকই নয়, প্রাক-ঐতিহাসিকও বটে।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীন হওয়ার পর ভারত নিজেকে 'জোট নিরপেক্ষ' হিসেবে তুলে ধরলেও সব জোটের সঙ্গেই নয়াদিল্লিকে সুসম্পর্ক রাখতে দেখা গেছে। এর সুফল ভারত সবসময়ই পেয়েছে।

অতি সম্প্রতি, ভারতকে দেখা যায় একইসঙ্গে মার্কিনবিরোধী বাণিজ্যিক জোট ব্রিকস ও মার্কিনপন্থি সামরিক জোট কোয়ার্ডের সদস্য হিসেবে নিজেকে গুরুত্বের সঙ্গে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরতে।

ভারতের এই সমৃদ্ধির পালে নতুন করে হাওয়া দিয়েছে দেশটির জি২০-র সভাপতির পদ।

ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে হিন্দুত্ববাদ চাপিয়ে দেওয়া, নতুন করে ধর্মীয় ও জাতিগত বিদ্বেষ উসকে দেওয়া ও বিরোধীদের দমন-পীড়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সমালোচিত। এসব সত্ত্বেও তার ভারতনীতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন এই আলোচনার বিষয়বস্তু।

ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা

বৈশ্বিক করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে শীর্ষ অর্থনীতির দেশগুলোসহ সারা বিশ্বই যখন আর্থিক মন্দায় নিমজ্জিত, তখন ভারতের অর্থনীতিকে বিশ্লেষকরা 'স্থিতিশীল' বলে অভিহিত করছেন।

নরেন্দ্র মোদি। ছবি: রয়টার্স

গত ২ জুন ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, গত ২৬ মে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৫৮৯ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার। একই দিনে শূন্য দশমিক ১ শতাংশ মান বাড়িয়ে রুপি গত ৫ সপ্তাহের মধ্যে নতুন রেকর্ড গড়ে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার মধ্যে ভারতের অর্থনীতি ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী অবস্থানে আছে। গত ৪ এপ্রিলের এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাহ্যিক চাপ সত্ত্বেও সেবাখাত থেকে ভারতের রপ্তানি আয় ক্রমাগত বাড়ছে। পাশাপাশি দেশটির বাণিজ্য ঘাটতি কমে আসছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দৃষ্টিতে, ভারতের অর্থনীতি বিশ্বে পঞ্চম। শুধু তাই নয়, ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার ৭০ বছরের মধ্যে ভারত অর্থনীতির বিবেচনায় সেই ঔপনিবেশিক শক্তিকে ছাড়িয়ে গেছে।

এমন চিত্র একই সময় বা এর কাছাকাছি সময়ে স্বাধীনতা পাওয়া দেশগুলো, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে দেখা যায়নি।

গত ১২ মে অমিতাভ কান্তের 'মেইড ইন ইন্ডিয়া' বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার গভর্নর শক্তিকান্ত দাস বলেছিলেন, 'আমরা আশাবাদী এবং আত্মবিশ্বাসী যে আমাদের প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৫ শতাংশের কাছাকাছি হবে।'

একই দিনে জাতিসংঘ ভারতের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ হতে পারে বলে প্রাক্কলন করে।

গত ২১ ফেব্রুয়ারি জার্মানির সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ ও অবকাঠামোখাতে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে।

নরেন্দ্র মোদি। ছবি: রয়টার্স

মুম্বাইভিত্তিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমির প্রধান নির্বাহী মহেশ বিয়াস গণমাধ্যমটিকে বলেন, 'ভারত একটি বিশাল ও বৈচিত্র্যময় দেশ। করোনা মহামারির সময় সরকারের নীতির কারণে দেশটির কৃষিখাত বেশ ভালো ভূমিকা রেখেছে।'

'নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে ভারতের করপোরেটখাতও বেশ ভালো করেছে, যদিও মধ্যম ও ক্ষুদ্রশিল্প ভুগেছে' বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তার মতে, 'সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপের ফলে ভারতে মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরা সম্ভব হয়েছে।'

ব্যবসায়ীদের 'প্রিয়' ভারত

গত ৩০ এপ্রিল মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের 'কেন ব্যবসায়ীরা এখন ভারতকে এত পছন্দ করছেন' শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত সরকার শিল্পখাতকে শক্তিশালী ও রপ্তানি বাণিজ্যকে প্রসারিত করতে অন্য দেশগুলোর সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তির দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। নয়াদিল্লির এই প্রচেষ্টা সারাবিশ্বই সাদরে গ্রহণ করছে।

উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, ২০২১ সালে অস্ট্রেলিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মরিশাসের সঙ্গে এমন চুক্তি করে ভারত। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও কানাডার সঙ্গে চুক্তির জন্য আলোচনা চলছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পশ্চিমের দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্ক নষ্ট হওয়ায় নয়াদিল্লির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করতে মস্কো বেশ আগ্রহী। চীনের প্রধানমন্ত্রী শি জিনপিংকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন 'বেস্ট ফ্রেন্ড' হিসেবে আখ্যা দিলেও রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে বলা হয়, 'সময়ের পরীক্ষিত বন্ধু'।

এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রও চাচ্ছে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করতে। বিশেষ করে, প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তিখাতে। মূলত চীনকে ঠেকাতে এমন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়।

লন্ডনভিত্তিক ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের অর্থনীতিবিদ শিলান শাহ সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, 'আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতায় ঝুঁকি আছে। ওয়াশিংটনকে খুশি রেখে মস্কোর সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষায় দিল্লিকে ভারসাম্যপূর্ণ কৌশলী পথে হাঁটতে হচ্ছে।'

প্রতিবেদন অনুসারে, পশ্চিমের অন্য দেশের নেতারাও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে আগ্রহী। কারণ, ১৪২ কোটি জনগণের এই দেশটি বিশ্বের বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশও বটে। নিরবচ্ছিন্ন দীর্ঘ গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের কারণে পশ্চিমের দেশগুলো ভারতকে আপন মনে করে বলেও মন্তব্য বিশ্লেষকদের।

'চীন থেকে চোখ ফেরান'

বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিতীয় অর্থনীতির দেশ চীনের স্বার্থগত সংঘাত চলায় ওয়াশিংটনের মিত্রদের কাছে এখন ভারত যেন এক 'উপযুক্ত বিকল্প'। তাদের কাছে চীনের কর্তৃত্ববাদী সরকারের তুলনায় ভারতের গণতান্ত্রিক সরকার যেন বেশি গ্রহণযোগ্য।

দিল্লি স্কুল অব ইকোনমিকসের এমিরিটাস অধ্যাপক পার্থ সেন মনে করেন, সাম্প্রতিক সময়ে অনেক দেশ বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান তাদের 'সব ডিম চীনের ঝুলিতে' রেখেছে। পশ্চিমের সঙ্গে বেইজিংয়ের রেষারেষির কারণে এখন তারা বিনিয়োগের জন্য নতুন জায়গা খুঁজছে। ভারত তাদের সেই সুযোগ দিচ্ছে।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্করের মতে, 'পণ্য উৎপাদন' অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চাবিকাঠি। তিনি 'চীনের দিকে তাকানো' বন্ধের আহ্বানও জানিয়েছেন। ভারতের কর্মকর্তারা ধনী দেশগুলোকে ক্রমাগত বুঝিয়ে যাচ্ছেন যে বিনিয়োগ গ্রহণে ভারত সার্বিকভাবেই প্রস্তুত।

এ ক্ষেত্রে, ২০২৪ সালের এপ্রিল থেকে ভারতে আইফোন তৈরির ঘোষণার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। ধারণা করা যেতে পারে, অ্যাপলের পথ ধরে আরও অনেক প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানও ধীরে ধীরে ভারতের দিকে ঝুঁকবে। এমনটি হলে ভারতের অর্থনীতি আরও চাঙ্গা হবে তা বলাই বাহুল্য।

রুশ তেলে ভারতের সুবিধা

পশ্চিমের নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার কাছ থেকে অন্য দেশগুলো যখন তেল কেনা বন্ধ বা কমিয়ে দিয়েছে, তখন ভারতকে দেখা যায় মস্কো থেকে কম দামে রেকর্ড পরিমাণ অপরিশোধিত তেল কিনতে।

শুধু তাই নয়, এই কারণে যখন ভারতের ওপর পশ্চিমের নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা করা হচ্ছিল তখনই জানা যায়, ভারতের কাছ থেকে পরিশোধিত তেল কেনার সংবাদ।

সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন জানায়, ভারত হয়ে রুশ তেল পেছনের দরজা দিয়ে ইউরোপে ঢুকছে।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, রাশিয়া থেকে কম দামে তেল কিনে তা ইউরোপে রপ্তানি করে ভারত অর্থনৈতিকভাবে ২ দিক দিয়েই লাভবান হয়েছে। ভারতের মতো এমন উদ্যোগ নিতে অন্য দেশগুলোকে দেখা যায়নি। নিজ দেশের স্বার্থে নরেন্দ্র মোদির সরকারের এমন সাহসী চিন্তা-পরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়ন নিঃসন্দেহে বিচক্ষণতার প্রমাণ রেখেছে।

ভারতের সামরিক শক্তি

জাতিসংঘের হিসাবে ১৪২ কোটি জনগণ নিয়ে ভারত এখন বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ। গত বছর চীনের জনসংখ্যা ছিল ১৪২ কোটি। এরপর তা কমতে শুরু করেছে। সেই হিসাবে, বিশ্বের বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের মুকুটে যোগ হয়েছে নতুন পালক।

এ ছাড়া, বিশ্বের পঞ্চম অর্থনৈতিক দেশটির খ্যাতি আছে বিশ্বের চতুর্থ সামরিক শক্তির দেশ হিসেবেও।

গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার জানিয়েছে, চলতি বছরে বৈশ্বিক সামরিক সক্ষমতার দিক থেকে ১৪৫ দেশের মধ্যে ভারত চতুর্থ অবস্থানে আছে। ৬০টির বেশি দিক বিবেচনায় ভারত এই অবস্থান পেয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

প্রভাবশালী সাময়িকী ফরেন পলিসির এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ভারতের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা ব্যাহত হচ্ছে। কেননা, ভারতের সামরিক বাহিনী ব্যাপক হারে রুশ অস্ত্র ব্যবহার করে।

এর আগে, রাশিয়ার এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা কেনার ঘোষণা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রোষানলে পড়ার হুমকি পেয়েছিল ভারত। বাস্তবতা হচ্ছে, রাশিয়া-ঘেঁষা সমরনীতির কারণে ভারতকে পশ্চিমের কাছে কখনই ব্রাত্য হতে হয়নি। বরং দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটিকে যুক্তরাষ্ট্র কাছে টেনে নিয়েছে সামরিক জোট কোয়ার্ডের সদস্য করে।

সম্প্রতি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল অনিল চৌহান গত ১৩ মে ক্যালিফোর্নিয়ায় ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তার বিষয়ে মার্কিন সামরিক কর্মকর্তাদের পাশাপাশি জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন।

বিশ্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ভারতের ভূমিকা গুরুত্ব পাচ্ছে—জেনারেল চৌহানের এই সফর বিশ্ববাসীকে যেন সেই বার্তাই দিলো।

মুসলিম বিশ্ব ও ভারত

ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে মূলত ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে ভিত্তি করে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, দলীয় স্বার্থে সরকারি প্রতিষ্ঠান ব্যবহারসহ নানা অভিযোগ আছে বিরোধীদের। এসবের অনেক ঘটনা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে শিরোনামও হয়েছে।

এ সত্ত্বেও, বিশ্ববাসীর সামনে এক 'সহনশীল ও সমৃদ্ধ' ভারতকে তুলে ধরতে সদা সচেষ্ট মোদি সরকার।

সংবাদ প্রতিবেদনগুলোর মাধ্যমে জানা যায়, মুসলিম দেশগুলোর প্রধান সংগঠন ওআইসির ৫৭ সদস্যের মধ্যে শুধুমাত্র প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বৈরী সম্পর্ক।

সম্প্রতি কাশ্মীরে অনুষ্ঠিত জি২০ এর সম্মেলনে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরব ও তুরস্কের অংশ না নেওয়ায় ধরে নেওয়া যেতে পারে এই ২ প্রভাবশালী মুসলিম দেশের সঙ্গেও ভারতের সম্পর্কে 'টানাপড়েন' চলছে।

তবে এ ঘটনার আগেই দেখা গেছে, যোগ ব্যায়ামকে সৌদি শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করে নরেন্দ্র মোদি মধ্যপ্রাচ্যের এই সম্পদশালী দেশটিকে সাংস্কৃতিক বন্ধনে আবদ্ধ করে নিয়েছেন।

দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানায়, ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নরেন্দ্র মোদি সবচেয়ে জনবহুল মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া থেকে শুরু করে সবচেয়ে সম্পদশালী সৌদি আরবসহ সব মুসলিম দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের দাবি করে আসছেন।

ফরেন পলিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনকে টেক্কা দিতে ভারত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর দিকে হাত বাড়িয়েছে। ভারতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা সেখানে নিয়মিত সফর করছেন। জল-স্থল ও আকাশপথে মধ্যপ্রাচ্যকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করতে কাজ করছে মোদি সরকার।

বৌদ্ধবাদ 'সেরা উপহার'

শুধু মুসলিম দেশই নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর সঙ্গেও সুসম্পর্ক বজায় রাখছে ভারত। দেশটির সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়, বৌদ্ধ মতবাদকে ভারতের 'সেরা উপহার' হিসেবে তুলে ধরে মোদি সরকার প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমার থেকে শুরু করে দূরবর্তী ভিয়েতনাম ও তাইওয়ান পর্যন্ত বৌদ্ধের শান্তির বাণী নতুনভাবে প্রচার করে চলছে।

সম্প্রতি, নয়াদিল্লিতে ২ দিনের দ্য গ্লোবাল বুড্ডিস্ট সামিট আয়োজন করে অংশগ্রহণকারী ৩০ দেশের প্রতিনিধিদের কাছে বৌদ্ধের 'অহিংস বাণী' পুনঃপ্রচারের পাশাপাশি মোদি সরকার ভারতকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য 'আদর্শ স্থান' হিসেবে তুলে ধরে।

শিখ আন্দোলন ও মোদি সরকার

নানা জাতি ও বর্ণের দেশ ভারতে 'বিশেষ সুবিধা দিয়ে' শিখ ধর্মাবলম্বীদের আপন করে নেওয়ার বার্তাও প্রবাসী শিখদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে মোদি সরকার।

নতুন আইন করে শিখদের পবিত্রতম স্থান স্বর্ণ মন্দিরকে আন্তর্জাতিক তহবিল নেওয়ার অধিকার ও তাদের 'লঙ্গর'র ওপর থেকে কর তুলে নেওয়ার কথাও প্রচার করছে 'মোদিপন্থি' পোর্টালগুলো।

গত মাসে অস্ট্রেলিয়ার ব্ল্যাকটাউন সিটিতে এর প্রতিফলন দেখা যায়। অন্যদের অনুরোধে নিরাপত্তার স্বার্থে শিখ অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন 'শিখস ফর জাস্টিস'র অনুষ্ঠান বাতিল করে দেয় সিটি কাউন্সিল।

কানাডা সরকারে প্রভাব বিস্তারকারী প্রবাসী শিখদের আন্দোলনকে 'গতিহীন' করতেও কাজ করে যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদির প্রশাসন। এই প্রশাসন বিদেশিদের কাছে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে জালিয়ানওয়ালাবাগে শিখদের চরম ত্যাগ স্বীকারের ইতিহাসও তুলে ধরছে।

ভারতের বহুত্ববাদকে সামনে এনে নরেন্দ্র মোদির এমন প্রচারণাকে অনেকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেও দেখছেন।

যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত

রাশিয়ার 'সব সময়ের বন্ধু' ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কেমন?—এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রিন্সিপাল ডেপুটি মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটালের বক্তব্যটি স্মরণ করা যেতে পারে।

গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি বেদান্ত বলেছেন, 'ভারতের সঙ্গে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে।' মোদির আসন্ন যুক্তরাষ্ট্র সফর নিয়ে তিনি বলেন, 'আমরা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তার সরকারের সদস্যদের অভ্যর্থনা জানাতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। আমরা ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করতে চাই।'

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আগামী ২১ থেকে ২৪ জুন যুক্তরাষ্ট্র সফর করবেন। সেসময় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাকে নিয়ে হোয়াইট হাউসে নৈশভোজে অংশ নেবেন।

গত ৬ জুন দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানায়, ২০০৯ সালের পর এই প্রথম কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র সফর করছেন। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর মোদি হোয়াইট হাউসে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করলেও সেসব সফরকে রাষ্ট্রীয় সফর হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়নি।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রায় ১৪ বছর পর ভারতের পক্ষ থেকে নরেন্দ্র মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফর তার সাফল্যের তালিকাকে আরও ঋদ্ধ করবে।

যে মন্ত্রে চলছে মোদির রথ

সম্প্রতি, কর্ণাটক রাজ্যে বিজেপির পরাজয়ে অনেকে 'মোদি ঝলক' ম্রিয়মাণ হতে চলেছে বলে মন্তব্য করেছেন। তবে মোদিভক্তরা মনে করেন, এখনো পর্যন্ত দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের কাছে নরেন্দ্র মোদিই তাদের 'উদ্ধারকর্তা'। কেননা, তার কর্মকৌশল বা কারিশমার কাছে বিরোধীদের প্রবল হওয়ার দৃষ্টান্ত তেমন দৃশ্যমান নয়।

সংবাদ প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করে এ কথা বলা যেতে পারে যে, জাতীয় নেতা হিসেবে দেশের জনগণের বিপুল আস্থা, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সাহসী নীতি ও বিশ্বমঞ্চে শান্তি-সৌহার্দ্যের মন্ত্র নরেন্দ্র মোদির রথকে সামনের দিকে নিতে সাহায্য করছে।

গুজরাট দাঙ্গাসহ শত সমালোচনা সত্ত্বেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও ভারতকে নতুন লেন্সে দেখার সময় এসেছে বলে মনে করছেন এই নেতার অনেক বিরোধীরাও।

Comments

The Daily Star  | English

Have patience for election

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus yesterday said the government would issue a roadmap to the election as soon decisions on electoral reforms are made.

6h ago