ইরান-চীনের ‘সখ্যতা’ কি নতুন বৈশ্বিক মেরুকরণের অংশ

ইব্রাহিম রাইসি, শি জিন পিং, ইরান, চীন, মধ্যপ্রাচ্য,
বেইজিংয়ে শি জিনপিং ও ইব্রাহিম রাইসি। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

'কেন চীন সফরে গেলেন ইরানের প্রেসিডেন্ট রাইসি?'

গত ১৪ ফেব্রুয়ারি টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এমন এক শিরোনামের প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০ বছরের মধ্যে এই প্রথম কোনো ইরানি প্রেসিডেন্ট চীন সফর করলেন।

ইরানের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক সুপ্রাচীন হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইরানের পশ্চিমমুখী নীতির কারণে তা নানান চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করেছে। ইসলামি বিপ্লবের পরেও বেইজিং-তেহরান সম্পর্কে কোনো নাটকীয় পরিবর্তন দেখা যায়নি।

মধ্যপ্রাচ্যে চীন ইরানের শত্রু-মিত্র সবার সঙ্গেই ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইরান ইস্যুতে চীন অবস্থান নিয়েছে নিজের সুবিধা বুঝে। দেশ ২টি সব সময়েই নিজেদের 'বন্ধু' বলে ঘোষণা দিলেও বাস্তবতার নিরিখে সেই বন্ধুত্ব কতটা জোরালো তা নিয়ে বিশ্লেষকদের ভিন্ন মত আছে।

এমন পরিস্থিতিতে ইরানের প্রেসিডেন্টের চীন সফরকে ঘিরে ২ দেশের মধ্যকার সম্পর্ক নতুন আলোচনার রসদ জুগিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, রাইসির এই সফর কি ইরান-চীনের নতুন করে কোনো 'সখ্যতার' ইঙ্গিত, নাকি এটি বৈশ্বিক কোনো মেরুকরণের অংশ?

বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের আমন্ত্রণে ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয় সফরে বেইজিং যান। তার ৩ দিনের এই সফরকে 'উচ্চ পর্যায়ের' বলে মন্তব্য করে টাইম ম্যাগাজিন বলে, 'এই সফর এমন সময়ে হলো যখন উভয় দেশই নানান বিষয় নিয়ে পশ্চিমের দেশগুলোর চাপে আছে।'

প্রতিবেদন অনুসারে, রাইসির সঙ্গে ছিলেন দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর এবং অর্থনীতি, পেট্রোলিয়াম, পররাষ্ট্রনীতি, বাণিজ্য, যোগাযোগ, কৃষি ও নগর উন্নয়ন নিয়ে কাজ করা মন্ত্রিপরিষদের ৬ সদস্য।

ধরে নেওয়া যেতে পারে, মূলত এসব দ্বিপাক্ষিক বিষয় নিয়ে ২ নেতা কথা বলেছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ইরান নতুন করে পশ্চিমের নিষেধাজ্ঞায় পড়েছে। এরপর রাশিয়ায় পাঠানো ইরানের ড্রোন ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহারকে কেন্দ্র করে তেহরান নতুন করে চাপে পড়ে।

অন্যদিকে, চীনা 'গোয়েন্দা' বেলুনকে কেন্দ্র করে ওয়াশিংটন-বেইজিং সম্পর্ক আরও তিক্ত হয়ে উঠেছে।

এ ছাড়াও ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন নিয়ে চীন ও ইরানের ভূমিকা 'অস্পষ্ট' হওয়ায় এশিয়ার এই দেশ ২টিকে প্রায়শই পশ্চিমের হুমকি শুনতে হচ্ছে।

'হোয়াট ইজ ইরান?' বইয়ের লেখক ও লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক শিক্ষা বিভাগের অধ্যাপক আরশিন আদিব-মোগাদ্দাম টাইম ম্যাগাজিনকে বলেন, 'আমরা এখন বিশ্ব রাজনীতির নতুন মেরুকরণের মাঝপথে আছি।'

তার মতে, পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে এখন নতুন জোট গড়ে ওঠার পাশাপাশি সেগুলো শক্তিশালীও হয়ে উঠছে।

'ইরান-চীন সখ্যতাকে নতুন বৈশ্বিক মেরুকরণের অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে,' বলে মনে করেন তিনি।

গত ১৭ ফেব্রুয়ারি মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন'র প্রতিবেদনে ইরান ও চীনের সম্পর্কের 'টানাপোড়েন' তুলে ধরা হয়।

এতে বলা হয়, চীন সফরের ঠিক আগে রাইসি তার শক্তিশালী মিত্র চীনের মৃদু সমালোচনা করে বলেছেন, '২ দেশের সম্পর্ক এখনো কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেনি।'

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, 'চীন ইরানের সঙ্গে সখ্যতা বাড়াতে খুব একটা আগ্রহী নয়।'

চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের প্রসঙ্গ টেনে রাইসি তেহরান ছাড়ার আগে বলেন, 'দুর্ভাগ্যজনক হলেও আমি বলবো যে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আমরা পিছিয়ে আছি।'

এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে যে, ২০২১ সালে চীন ও ইরানের মধ্যে 'কৌশলগত অংশীদারিত্ব পরিকল্পনা' চুক্তি সইয়ের সময় বলা হয়েছিল—আগামী ২৫ বছরে চীন অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত ইরানে ৪০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। সেসময় উপসাগরীয় দেশটিকে সামগ্রিকভাবে বদলে দেওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষাও প্রকাশ করা হয়েছিল।

গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর ২২ বছর বয়সী কুর্দি নারী মাহসা আমিনি পুলিশি হেফাজতে মারা গেলে দেশব্যাপী সরকারবিরোধী যে বিক্ষোভ শুরু হয়, এর পরিপ্রেক্ষিতে বলা যেতে পারে—চীনের 'বিশাল বিনিয়োগ পরিকল্পনা' ইরানের জনজীবনে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি।

এমনকি, ঐতিহাসিক চীন সফরের ঠিক আগে প্রেসিডেন্ট রাইসির 'উষ্মা' দেখেও বলা যেতে পারে যে, চীনকে নিয়ে অবরোধ-নিষেধাজ্ঞাপীড়িত ইরানের অসন্তোষ আছে।

ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির জ্যেষ্ঠ ফেলো হেনরি রোম সিএনএনকে বলেন, 'ইরানের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় করতে চীনের দ্বিধাদ্বন্দ্বের কারণে তেহরান যে বিরক্ত, সেটাই হয়তো রাইসির বক্তব্যে প্রকাশ পেয়েছে।'

গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শি-রাইসি বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, 'কৌশলগত অংশীদারিত্ব পরিকল্পনা' চুক্তি বাস্তবায়নে চীন ও ইরান একসঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক।

এ ছাড়াও, বাণিজ্য, কৃষি, শিল্প, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও অবকাঠামোসহ অন্যান্য খাতে সম্পর্ক জোরদার করতে ২ দেশ কাজ করে যাবে।

চীন সফরের একদিন পর রাইসির সফরসঙ্গী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসাইন আমির আবদুল্লাহর বরাত দিয়ে ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ইরনা জানায়, চুক্তি বাস্তবায়নে সেসব বাধা আছে তা দূর করতে দেশ ২টি রাজি হয়েছে।

২ দেশের সমঝোতার সুফল নিয়ে ইরান আশাবাদী উল্লেখ করে ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ইরনা আরও বলে, আগামীতে ইরান সফরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রেসিডেন্ট রাইসির আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন।

ইরান-চীনের ‘সখ্যতা’ কি নতুন বৈশ্বিক মেরুকরণের অংশ
বেইজিংয়ে ইরান ও চীনের প্রতিনিধি দলের বৈঠক। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

বন্ধুর খোঁজে ইরান

এক এক করে ৪৪ বছর কেটে গিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের অবরোধের কারণে এই দীর্ঘ সময় ধরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মধ্যপ্রাচ্যের তেল-গ্যাসসমৃদ্ধ দেশ ইরান অনেকটাই 'একা'।

১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইরানের শেষ সম্রাট মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভীর তেহরান ত্যাগ ও প্যারিসে নির্বাসন শেষে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির তেহরানে ফিরে আসার মধ্য দিয়ে দেশটিতে যে জনবিপ্লব ঘটেছিল তা পশ্চিমের জন্য ছিল চরম অস্বস্তিকর।

এরপর সে বছর এপ্রিলে গণভোটে বিপুল সমর্থন নিয়ে খোমেনি ইরানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করলে ধীরে ধীরে অবরোধ-নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে আটকে ফেলা হয় ইরানকে।

শাহের আমলে পশ্চিমের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইরানকে সবসময়ই মিত্র খুঁজে বেড়াতে হচ্ছে। ১৯৮০-র দশকে প্রতিবেশী ইরাক সীমানাবিরোধকে কেন্দ্র করে ইরান আক্রমণ করে বসলে সৌদি আরবের প্ররোচনায় যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপ সমর্থন দেয় ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে।

'বন্ধুহীন' ইরান অস্ত্র ও অন্যান্য সহায়তার জন্য হাত বাড়ায় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা আজকের রাশিয়ার দিকে। সেসময় পরাশক্তি চীনের 'নিরপেক্ষ' থাকার ভূমিকার কথা সবার জানা।

যুক্তরাষ্ট্রের একসময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইরান ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী হয়ে উঠলে তৎকালীন সোভিয়েত ব্লকের সঙ্গে 'ভারসাম্যপূর্ণ' সম্পর্ক বজায় রেখে চলে উপসাগরীয় দেশটি।

১৯৮৮ সালে ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধ শেষের পরপর সোভিয়েত ব্লক ভাঙতে শুরু করলে এবং ১৯৯১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলে 'বন্ধু' সংকটে পড়ে ইরান।

তবে ১৯৯০ সালে ইরাক প্রতিবেশী কুয়েত দখল করলে ইরানের 'দখলবিরোধী' অবস্থান তাকে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে শত্রু-মিত্র সবার কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।

এরপর চীনের অর্থনৈতিক বিকাশ শুরু হলে দেশটির ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটানোর জন্য ইরান আলাদাভাবে গুরুত্ব পায় চীনের কাছে।

রাইসির 'সফল' সফর

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম তেহরান টাইমস জানায়, ইরানের সমুদ্রবিষয়ক প্রকল্পগুলোয় অংশ নিতে চীন প্রস্তুত।

প্রেসিডেন্ট রাইসির সাম্প্রতিক সফরকে 'সফল' হিসেবে উল্লেখ করে এতে আরও বলা হয়, বড়মাপের জাহাজ তৈরিতে প্রযুক্তি সহায়তা দিতে ২ দেশের মধ্যে আলোচনা হয়েছে।

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি রাইসির চীন সফরের বিষয়ে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস জানায়, শি জিনপিং ইরানের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে ও বিশ্বশক্তির সঙ্গে পরমাণু চুক্তিতে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

তবে ইরানের আঞ্চলিক প্রতিযোগী সৌদি আরবের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক জোরদার করতে শি আগ্রহ প্রকাশ করায় অস্বস্তিতে পড়ে তেহরান।

শুধু সৌদি আরবের সঙ্গেই নয়, মধ্যপ্রাচ্যে গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের ৬ সদস্য দেশের সঙ্গেই সম্পর্কের উন্নয়ন চায় চীন। গত ডিসেম্বরে এই ধনী আরব দেশগুলোর সঙ্গে যৌথ বিবৃতিতে চীনের প্রেসিডেন্ট সই করায় নাখোশ হয় ইরান।

বেইজিং-তেহরানের মধ্যে '২৫ বছর' মেয়াদী চুক্তির সুফল ইরান এখনো পায়নি উল্লেখ করে এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়—চীন প্রতিবেশী রাশিয়া থেকে আরও বেশি পরিমাণ তেল নিতে পারে এমন জল্পনার মধ্যে প্রেসিডেন্ট রাইসি বেইজিং সফর করলেন।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, ওয়াশিংটনের সঙ্গে বেইজিংয়ের সম্পর্কে টানাপোড়েন নতুন মাত্রা পাওয়ায় এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে প্রকাশ্যে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে ঝুঁকি থাকায় এশিয়ার বৃহত্তম দেশটি তেহরানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আশ্বাস দিচ্ছে।

গত ৪ ফেব্রুয়ারি ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানায়, ইরানের গোয়েন্দা কর্মসূচিতে 'সহায়তা'কে কেন্দ্র করে কয়েকটি চীনা প্রতিষ্ঠানের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কথা ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের বিপ্লবী গার্ডের কাছে এই প্রতিষ্ঠানগুলো গোয়েন্দা উপকরণ বিক্রি করছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি দ্য ডিপ্লোম্যাট'র প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়, 'নিজেদের বন্ধুত্ব থেকে ইরান ও চীন যা চায় তা তারা কেউই পাবে না।' কেননা, ইরান চায় চীনের বিনিয়োগ আর চীন চায় বিশ্বশক্তির সঙ্গে ইরানের পরমাণু সমস্যা আগে শেষ হোক।

একই দিনে আল জাজিরার মন্তব্য প্রতিবেদনে বলা হয়, রাইসির সফর চীন-ইরান সম্পর্কে খুব একটা পরিবর্তন আনবে বলে মনে হয় না।

চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম সিসিটিভির বরাত দিয়ে জার্মানির গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলে জানায়—প্রেসিডেন্ট শি বলেছেন, 'পরিবর্তিত বিশ্বে চীন ও ইরান একে অপরকে সহযোগিতা করতে কাজ করবে।'

জবাবে রাইসি বলেছেন, 'কঠিন সময়েও ইরান ও চীন একে অপরের বন্ধু।'

Comments

The Daily Star  | English

Palak admits shutting down internet deliberately on Hasina's order

His testimony was recorded by the International Crime Tribunal's investigation agency following a questioning session held yesterday

50m ago