আতঙ্কের আরেক নাম সরকারি হাসপাতালের লিফট

'আমি যেকোনো সময় মারা যেতে পারি সারাক্ষণ এমন ভয় নিয়েই কাজ করতে হয়।' 
ছবি: স্টার

এক বছর ধরে জীবনের ভয় নিয়ে রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের একটি ভবনে লিফটম্যান হিসেবে কাজ করেন শিপন মিয়া (ছদ্মনাম)। জরাজীর্ণ লিফটটি কত বছর আগে বসানো হয়েছিল তা জানেন না শিপন। এমনকি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও এ বিষয়ে কিছু বলতে পারেনি।

কলাপসিবল গেটের ওই লিফটের ভেতরে পাঁচটি বোতাম আছে। কিন্তু বোতামগুলোর ওপরে কোনো নম্বর লেখা নেই। লিফট ওপরে ওঠা বা নিচে নামার জন্য একটি বোতাম টিপে ধরে রাখতে হয় শিপনকে। 

ছবি: স্টার

'এই লিফটে আটকে যাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু আমি ভয় পাই লিফট কখন বিদ্যুতায়িত হয়ে যায় তা নিয়ে। লিফট যদি বিদ্যুতায়িত হয় আর সেসময় কেউ যদি লিফট স্পর্শ করে তাহলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারাত্মক কিছু ঘটতে পারে। কোনো কোনো সময় হঠাৎ করে লিফট বন্ধ হয়ে যায়, চালু হতে কমপক্ষে ১০ মিনিট লাগে', বলেন তিনি।

এই লিফটটির ভেতরে ও বাইরে নোটিশে লেখা আছে, লিফটটি অনেক পুরাতন। শুধুমাত্র ট্রলি এবং হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী রোগীরা এ লিফট ব্যবহার করতে পারবেন। অপারেটর ছাড়া কেউ যেন লিফট ব্যবহার না করেন এবং লিফটম্যানসহ একসঙ্গে মোট তিনজনের বেশি লিফটটি ব্যবহার করতে পারবেন না।

ছবি: স্টার

শিপন বলেন,'আমি যেকোনো সময় মারা যেতে পারি সারাক্ষণ এমন ভয় নিয়েই কাজ করতে হয়।' 

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (মিটফোর্ড) রোগীদের খাবার পরিবেশন করেন ফজলুল হক। লিফট দুর্ঘটনায় সহকর্মীর মৃত্যুর পর থেকে লিফট ব্যবহার করতে ভয় পান তিনিও।

'২০২১ সালের ৩ জুন। আমার সহকর্মী সুমন ও আমি রোগীদের খাবার বিতরণ করার জন্য লিফটে উঠি। আমরা দ্বিতীয় তলায় যাওয়ার জন্য লিফটে উঠেছিলাম। তখন অপারেটর ছিল না। সুমন লিফটের একটি বোতামে স্পর্শ করার মাত্রই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান।'

'তারপর থেকে আমি আর লিফট ব্যবহার করতে পারি না,' বলেন তিনি।

বিগত কয়েক বছরে রাজধানীসহ দেশের অধিকাংশ সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের লিফটগুলোতে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২০১৪ সালের ২৩ মার্চ লিফটে আটকে থাকা অবস্থায় একজন নারী রোগীর মৃত্যুও হয়েছিল।

ঢাকার অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালের লিফট ব্যবহার করা ঝুঁকিপূর্ণ। লিফটে রোগী ও রোগীর সঙ্গে থাকা ব্যক্তিদের ভেতরে আটকে পড়ার মতো ঘটনাও বাড়ছে। অনেক লিফটই অতিরিক্ত ব্যবহার করা হয় এবং ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি লোক বহন করে।

সম্প্রতি রাজধানীর ১৩টি বড় সরকারি হাসপাতাল সরেজমিনে পরিদর্শন করেছে দ্য ডেইলি স্টার। দেখা গেছে, অধিকাংশ হাসপাতালেই সাধারণ অভিযোগ হলো লিফট খারাপ হয়ে যাওয়া। কোনো কোনো লিফট মাঝে মাঝে জোরে শব্দ করে, কোনো কোনো লিফট আটকে যায় বা দরজায় ত্রুটি দেখা দেয়। কোনোটির আবার সবসময় দরজা খোলা থাকে কিংবা দরজা একবার বন্ধ হয়ে গেলে আর সহজে খোলা যায় না।

গত ১২ মে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজে লিফটে আটকে এক হৃদরোগীর মৃত্যুর পর হাসপাতালে লিফট সমস্যার বিষয়টি সামনে আসে।

এ ঘটনার পর দেশের প্রতিটি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের জরুরি সেবা, লিফট সেফটি সিস্টেম ও সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর মধ্যে রয়েছে সব লিফট অপারেটরদের হাজিরা প্রতিদিন পরীক্ষা করা ও তাদের যোগ্যতা পুনরায় পরীক্ষা, হাসপাতালে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিতকরণ ও সব লিফট পরীক্ষা করার জন্য পিডব্লিউডিকে চিঠি দিতেও নির্দেশনায় বলা হয়েছে।

তবে রাজধানীর হাসপাতালের লিফটের অবস্থা অসন্তোষজনক। মহাখালীর জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ও হাসপাতালের দুটি ভবনে আটটি লিফট রয়েছে। তাদের সবগুলোই ত্রুটিপূর্ণ।

লিফটের অপারেটর আমিনুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'লিফটের অবস্থা এতটাই খারাপ যে কেউই সহজে হাত দিয়ে লিফটের দরজা খুলতে পারে। এর ফলে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।'

এছাড়া অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে অতিরিক্ত গরম হয়ে লিফট আটকে যাওয়াও একটি নিত্যদিনের ঘটনা বলে জানান তিনি।

জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ২০২২ সালে ১৭ সেপ্টেম্বর ৬০ বছর বয়সী এক ক্যানসার রোগী ত্রুটিপূর্ণ লিফটের কারণে দুর্ঘটনায় মারা যান। 

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, অন্তত সাতটি লিফট সবসময়ই ধারণক্ষমতার বেশি লোক বহন করে, যা নিরাপত্তার জন্য গুরুতর ঝুঁকি। 

ঢামেক হাসপাতালের লিফট অপারেটর শাকিল মাহমুদ বলেন, 'প্রতিটি লিফটই অতিরিক্ত লোক বহন করে। কখনো কখনো এত ভিড় হয়ে যায় যে মানুষজনকে নেমে যেতে বাধ্য করতে হয়। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই লোকজন ঝুঁকি উপেক্ষা করে লিফটে চলাচল করে।'

ছবি: স্টার

অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে ঢামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রতিটি লিফট প্রতিদিন চার ঘণ্টা করে বন্ধ রাখে। 

ঢামেক হাসপাতালের পিডব্লিউডির উপ-সহকারী প্রকৌশলী সামাদ আজাদ বলেন, 'ওভারলোডের কারণে লিফটগুলো প্রায়ই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।'

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ট্রমাটোলজি অ্যান্ড অর্থোপেডিক রিহ্যাবিলিটেশন (নিটোর) এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) পরিদর্শনে গিয়ে রাতেরবেলায় কোনো লিফটম্যান খুঁজে পাওয়া যায়নি। দেখা গেছে, অপারেটর না থাকায় রোগীদের অনেকেই না জেনে লিফট ব্যবহার করছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিটোর হাসপাতালের এক রোগী বলেন, 'লিফট কীভাবে ব্যবহার করতে হয় আমি জানি না। সেজন্য লিফট চালানো আমার পক্ষে খুব কঠিন।'

আরেক রোগী আলাল উদ্দিন বলেন, 'আমি লিফটে উঠতে করতে খুব ভয় পাই কারণ এখানে কোনো অপারেটর নেই। এই প্রথম আমি লিফট ব্যবহার করছি। তাই আমার জন্য এটা খুব ভয়ের।'

লিফট দুর্ঘটনা নিয়ে আরেকটি অভিজ্ঞতা জানান বিএসএমএমইউ-এর ব্লক-সি-এর একজন কর্মী নুরজাহান বেগম। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি আগে কখনোই লিফটে উঠতে ভয় পাইনি। কিন্তু ১০ বছর আগে, একটি দুর্ঘটনার পর আমি লিফটে উঠতে ভয় পাই।'

'দশ বছর আগে, এই হাসপাতালে একজন নার্স নিচতলা থেকে ওপরের তলায় যাচ্ছিলেন। হঠাৎ লিফট খারাপ হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। পরে হঠাৎ করেই লিফট দ্রুতগতিতে নিচতলায় পড়ে যেতে থাকে। তখন যারা ভেতরে ছিলেন তারা সবাই আতঙ্কে চিৎকার করছিলেন। নিচতলায় যখন লিফট থামে তখন দেখা যায় ওই নার্সের পা ভেঙে গেছে,' বলেন তিনি। 

'দুর্ঘটনাটি আরও গুরুতর হতে পারত। তারপর থেকে আমি লিফট ব্যবহার করতে ভয় পাচ্ছি। খুব প্রয়োজন ছাড়া যেমন সঙ্গে রোগী আছে এমন দরকার ছাড়া আমি লিফটে উঠি না,' বলেন তিনি।

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজেস, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালসহ অন্যান্য বড় হাসপাতালেও ঘন ঘন লিফট সমস্যা, সন্ধ্যার পর অপারেটর না থাকার অভিযোগ সাধারণ।

গত ৩১ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালের একটি লিফটে আটকে যান। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গতকাল লিফট রক্ষণাবেক্ষণে গাফিলতি এবং অপারেটরদের প্রশিক্ষণের অভাবের ঘটনা খুঁজে পেয়েছে।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক ডা. মঈনুল আহসান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, কিছু হাসপাতাল ২৪ ঘণ্টা লিফট ব্যবহার করে, সেখানে কখনো কখনো সমস্যা হয়।

'লিফট শুধুমাত্র রোগীদের ব্যবহারের জন্য। অন্যদের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহারে এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। অনেক সময় অতিরিক্ত লোকের কারণে লিফট ওভারলোড হয়ে যায়,' বলেন তিনি।

তিনি আরও জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জরুরি পরিষেবা, লিফট ও পরিষেবা ব্যবস্থাপনাসহ হাসপাতালের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সারাদেশের সব সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের অংশগ্রহণে একটি জরুরি সভায় নির্দেশনা জারি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

Comments