অস্বাস্থ্যকর খাবারে মারাত্মক ঝুঁকিতে শিশুরা
ছুটির দিনের বিকেলে চার বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে হাঁটতে বের হয়েছিলেন রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বসিলার বাসিন্দা আকবর হোসেন। হাঁটার একপর্যায়ে হঠাৎ মেয়ে সায়রা চিপস আর চকলেট কিনে দেওয়ার বায়না জুড়ে। এগুলো খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর, মেয়েকে বোঝাতে গিয়ে ব্যর্থ হলেন আকবর। অগত্যা মেয়ে কান্না জুড়ে দিলে বাধ্য হন চিপস আর চকলেট কিনে দিতে।
দ্য ডেইলি স্টারকে আকবর জানান, মেয়েকে নিয়ে বাসার বাইরে বের হলেই সে চিপস, জুস এসব খাওয়ার জেদ ধরে। ওর বয়স যখন দেড় বছর তখন মাঝে মধ্যে তিনি বাইরে থেকে চিপস, জুস নিয়ে যেতেন। কিন্তু এটিই যে এখন অভ্যাস হয়ে দাঁড়াবে বুঝতে পারেননি। এখন বহু চেষ্টা করেও মেয়েকে এসব খাবার থেকে নিবৃত্ত করতে পারছেন না।
আকবর বলেন, 'বাচ্চাগো এসব খাওয়া ঠিক না, কিন্তু বাচ্চারা তো বুঝবার চায় না।'
আকবরের মতো একই সমস্যায় ভুগছেন মিরপুরের টোলারবাগ এলাকার বাসিন্দা আবদুল হামিদও।
তার ছোট দুই ছেলে-মেয়ে, যারা চিপস আর চাটনি ছাড়া কিছু বুঝেই না।
হামিদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'খালি আমার বাচ্চারাই না। সবার বাচ্চাই অহন ভাত না খাইয়া চিপস, চানাচুর আর হাবিজাবি খায়।'
পুষ্টিবিদদের মতে, জন্মের পর থেকে প্রথম ছয় মাস শিশুর একমাত্র খাবার মায়ের বুকের দুধ। এরপর থেকে দুই বছর পর্যন্ত শিশুকে বুকের দুধের পাশাপাশি বাড়িতে তৈরি হালকা ও নরম পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো উচিত। কিন্তু বর্তমানে দেশে শিশুদের খাবার ও পুষ্টি পরিস্থিতির চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন।
চলতি বছরের এপ্রিলে প্রকাশিত বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ-২০২২ থেকে জানা যায়, দেশে ৬ থেকে ২৩ মাস বয়সী শিশুদের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ চরম অস্বাস্থ্যকর খাবার খাচ্ছে। এসব খাবারের মধ্যে রয়েছে- অতিরিক্ত চিনিযুক্ত কোমল পানীয়, মাত্রাতিরিক্ত লবণ এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার।
জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (নিপোর্ট) এই জরিপটি করে। জরিপে খাদ্য সংক্রান্ত বিষয়ে ৬ থেকে ২৩ মাস বয়সী দুই হাজার ৫৭৮ শিশুর তথ্য নেওয়া হয়।
জরিপের তথ্যে দেখা গেছে, ৩২ শতাংশ শিশু জরিপের তথ্য সংগ্রহের আগের দিন কোমল পানীয় পান করেছে এবং ৪৯ শতাংশ শিশু অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়েছে।
জরিপে কোন ধরনের খাবারকে অস্বাস্থ্যকর হিসেবে ধরা হয়েছে জানতে চাইলে নিপোর্টের গবেষণা পরিচালক মোহাম্মদ আহছানুল আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কোমল পানীয় বলতে আমরা বুঝিয়েছি বাজারে বিক্রি হওয়া বিভিন্ন ধরনের কার্বোনেটেড বেভারেজ ও বিভিন্ন কোম্পানির ফলের জুস। এসব খাবারে প্রচুর প্রিজারভেটিভ দেওয়া থাকে। চিনি জাতীয় ও অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবারের মধ্যে আমরা বার্গার, পিৎজা, ইনস্ট্যান্ট নুডলস, চিপসসহ বিভিন্ন জাংক ফুডকে বুঝিয়েছি।'
জরিপে কেন শুধু ৬ থেকে ২৩ মাস বয়সী শিশুদের তথ্য নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ছয় মাস থেকে শিশুদের মায়ের দুধের পাশাপাশি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক খাবার খেতে দেওয়া হয়। এ সময়ে যদি শিশুদের পরিপূর্ণ পুষ্টি নিশ্চিত না করা যায়, তবে আর কখনোই শিশুদের পুষ্টি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। বর্তমানে শিশুদের কী ধরনের খাবার দেওয়া হচ্ছে, তা তুলে ধরতেই এই বয়সী শিশুদের বেছে নেওয়া হয়েছে।'
জরিপে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং ইউনিসেফের ২০২১ সালের একটি বিবৃতির বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, এই খাবারগুলো চরম অস্বাস্থ্যকর এবং স্বাস্থ্যের পক্ষে ঝুঁকিপূর্ণ। এসব খাবার খাওয়ার কারণে শিশুদের শৈশবকালীন স্থূলতার ঝুঁকি বাড়ে। বিশেষ করে অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার বা পানীয় দাঁতের ক্ষয় করে এবং অস্বাস্থ্যকর চর্বিযুক্ত খাবার শিশুদের ওজন বাড়ায়। সুষম খাবারের পরিবর্তে শিশুরা এসব খাওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ায় পরিমাণমত পুষ্টি সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে শিশুরা অপুষ্টির শিকার হয়।
এ ধরনের খাবারে মূলত যা থাকে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. খালেদা ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শিশুরা কোমল পানীয় ও ফলের জুসের নামে যেসব পানীয় পান করছে তাতে প্রচুর পরিমাণে চিনি ও প্রিজারভেটিভ দেওয়া থাকে। অন্যদিকে চিপস, চাটনি, চানাচুর, ইনস্ট্যান্ট নুডলসে প্রচুর পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট ও লবণ দেওয়া থাকে, যা শিশুদের শরীরে চর্বি হিসেবে জমা হচ্ছে।'
শিশু বিশেষজ্ঞরা জানান, এসব খাবারে পুষ্টি বলতে তেমন কিছুই নেই। অপরদিকে তা শিশু স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকির। কোমল পানীয়তে প্রচুর পরিমাণে চিনি থাকায় তা গ্রহণ করায় শিশুদের ক্ষুধামন্দাও দেখা যাচ্ছে। যার ফলে শিশুদের একটি বড় অংশেরই মানসিক ও শারীরিক বিকাশ ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এসব খাবার শিশুদের জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) শিশু হেমাটোলজি অ্যান্ড অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ও শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ টি এম আতিকুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জন্মের প্রথম ৫ বছর শিশুর জন্য ভীষণ সংবেদনশীল। মাত্রাতিরিক্ত প্রিজারভেটিভ সব বয়সীদের জন্যই ক্ষতিকারক, শিশু স্বাস্থ্যের জন্য তা অত্যন্ত বিপজ্জনক। এসব খাবার গ্রহণে শিশু স্বাস্থ্যে জটিলতা প্রথমে যত না প্রকাশ পায়, বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সমস্যাগুলো আরও জটিলাকার ধারণ করে। এসব খাবার গ্রহণে শিশুদের কিডনি, লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি ক্যান্সারও হতে পারে।'
অধ্যাপক ড. খালেদা ইসলাম বলেন, 'এসব খাবারে কোনো পুষ্টিই নেই। শিশুর জন্মের পর হাজার দিন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়েই যদি শিশু এসব খাবারে অভ্যস্ত হয় তবে শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশ চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। এ সময়ে যদি শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করা না যায় তবে এই শূন্যস্থানটি কখনোই পূরণ করা সম্ভব হবে না।'
কোমল পানীয় যতটা বিপজ্জনক
ঢাকার বাজারে বিক্রি হওয়া 'কোমল পানীয় এবং এনার্জি ড্রিংক স্বাস্থ্যের জন্য কতোখানি ক্ষতিকারক' শীর্ষক একটি গবেষণা করেছিলেন বিএসএমএমইউ'র পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের ডা. এ এইচ এম গোলাম কিবরিয়া। ২০২২ সালে প্রকাশিত গবেষণাটিতে উঠে এসেছিল কোমল পানীয় গ্রহণের ঝুঁকির তথ্য।
সেই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, কোমল পানীয়তে অতিরিক্ত চিনি, ক্যাফেইন ও ভারী ধাতুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। গবেষণার জন্য বাজার থেকে নেওয়া ২৫০ মিলিলিটারের কোমল পানীয়তে পিএইচ মাত্রা ২.৫ থেকে ৩.৪ সীমারেখা থাকলেও তাতে ২০.৮ থেকে ২৮.৮ গ্রাম পর্যন্ত চিনি পাওয়া গেছে।
গবেষণটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকির ওপর নির্ভর করে করা হলেও তাতে শিশু স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছিল।
গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কোমল পানীয়তে থাকা অতিরিক্ত চিনি, ভারী ধাতু অসংক্রামক রোগের কারণ। বাংলাদেশের ৬৭ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয় অসংক্রামক রোগে। শিশুদের ক্ষেত্রে এটি আরও অধিকতর বিপজ্জনক হতে পারে।
ডব্লিউএইচও'র গাইডলাইন অনুযায়ী, ২৪ মাস পর্যন্ত শিশুদের বাড়তি চিনিযুক্ত খাবারের ব্যাপারে পুরোপুরি নিষেধ করা হয়েছে। একইসঙ্গে এ বয়সী শিশুদের সোডা, চিনিযুক্ত দই, কুকিজ খাওয়ানোর বিষয়েও নিষেধ করে বলা হয়েছে, এসব খাবারে সাধারণত চিনি যোগ করা হয়।
গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে কোমল পানীয় শিশু স্বাস্থ্যের জন্য কতটা বিপজ্জনক জানতে চাইলে ডা. এ এইচ এম গোলাম কিবরিয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সামান্য ২৫০ মিলিলিটার কোমল পানীয়তে যে পরিমাণ চিনি থাকে তা একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের পুরো একদিনের চিনি গ্রহণের সমান। তাই ৬-২৩ মাস বয়সে এই পরিমাণ চিনি গ্রহণ শিশুর জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করবে। যা শিশুকে স্বেচ্ছায় একপ্রকার ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়ার মতো।'
পরিত্রাণের উপায়
শিশুদের এ ধরনের খাবার থেকে নিবৃত্ত রাখতে সচেতনতাকেই সবচেয়ে বড় মাধ্যম বলেছেন শিশু বিশেষজ্ঞরা।
অধ্যাপক ডা. এ টি এম আতিকুর রহমান বলেন, 'এ ক্ষেত্রে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। আমরা যেমন শিশুদের প্রথম ছয় মাসে আবশ্যিক মাতৃদুগ্ধ পানের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সচেতনতা তৈরি করতে পেরেছি, ঠিক তেমনি এ ক্ষেত্রেও আমাদের জোরালো ভূমিকা নিতে হবে। এজন্য শিশুর খাবারের জন্য তিনটি ধাপের ওপর আমরা জোর দিয়ে থাকি। শিশুকে অবশ্যই ঘরে তৈরি খাবার খেতে হবে, হাঁড়ির খাবার খেতে হবে এবং ধোয়ার পর খেতে হবে। এই তিনটি পদ্ধতি যদি মানা যায়, তবেই কেবল আমরা পরিত্রাণ পেতে পারি।'
অধ্যাপক ড. খালেদা ইসলাম বলেন, 'খাবারের বিষয়ে মা-বাবাকে পরিপূর্ণ সচেতন করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় সচেতন না হওয়ার কারণে নিম্নবিত্ত মা-বাবারা মনে করেন শিশুদের বুঝি যেকোনো একটা কিছু খাওয়াতে পারলেই হয়। তাই সব মহলে এমনভাবে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে যেন তারা বুঝতে পারে এসব খাবার গ্রহণে তাদের সন্তানের লাভের পরিবর্তে দীর্ঘস্থায়ী মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। তখন মা-বাবারাই তাদের সন্তানদের এসব খাবার থেকে বিরত রাখবেন।'
Comments