হাসপাতালটির দেয়ালে ফাটল, ছাদ থেকে খসছে পলেস্তারা

ছবি: দীপংকর রায়

হাসপাতালটির দেয়ালে ফাটল ধরেছে। বৃষ্টি হলে ছাদ চুঁইয়ে ওয়ার্ডের মধ্যে পানি পড়ে। ভবনের দেয়াল ও ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ে লোহার রড বের হয়ে আছে। পিলারগুলোর অর্ধেক খসে পড়েছে। রোগীদের জন্য নির্ধারিত প্রায় সবগুলো শৌচাগারই ব্যবহারের অনুপযোগী।

এ চিত্র খুলনা বক্ষব্যাধি হাসপাতালের। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার যক্ষ্মা রোগী, বিশেষ করে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা রোগীদের চিকিৎসার একমাত্র ভরসাস্থল এই ১০০ শয্যার হাসপাতাল। কিন্তু যথাযথ তদারকির অভাবে ৫৮ বছর বয়সী এই হাসপাতালের সবকটি ভবন বর্তমানে জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়।

যেখানে লবণাক্ত অঞ্চলে অবস্থিত এই ভবনগুলোর জন্য বিশেষ তদারকি দরকার ছিল, সেখানে এই দীর্ঘ সময়ে শুধু কয়েক দফা নিয়ম মাফিক সংস্কার করা হয়েছে। বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় এই ভবনেই ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসা দিচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা।

এই ভবনে চিকিৎসা নিতে এসে রোগীরাও থাকেন আতঙ্কে। এই সমস্যার পাশাপাশি এখানে আছে চিকিৎসক সংকটও। ফলে ব্যহত হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় ২ বছর ধরে অস্ত্রোপচার বন্ধ।

খুলনা নগরের অন্য সরকারি হাসপাতালগুলোতে যেখানে রোগীদের উপচে পড়া ভিড়, তখন বক্ষব্যাধি হাসপাতালে রোগী শয্যার তুলনায় অনেক কম। ১০০ শয্যার এই হাসপাতালে প্রতিদিন মাত্র ২৫ থেকে ৪০ জন রোগী ভর্তি থাকে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালের ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা কেউ ভর্তি হতে চান না। করোনার পর থেকে এই রোগী সংকট বেড়েছে।

এই হাসপাতালে কর্মরত মেডিকেল অফিসার পার্থ বিশ্বাস ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিভিন্ন এনজিও যক্ষ্মা রোগীদের প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে বিনা পয়সায় চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। সে কারণে যক্ষা রোগীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কমে গেছে। বেশিরভাগ সময় শয্যা সংখ্যার তুলনায় রোগী কম ভর্তি থাকে। এখানে সরকার থেকে যক্ষ্মা রোগীদের বিনামূল্যে অনেক ওষুধ দেওয়া হয়। যাদের কেনার সামর্থ্য নেই তারা এখানে ভর্তি হয়, সামর্থ্যবানরা বাইরে থেকে চিকিৎসা নেন।'

ছবি: দীপংকর রায়

'তবে জরাজীর্ণ ভবন সবাইকে আতঙ্কের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বিশেষ করে বাইরে থেকে যেসব রোগী এখানে ভর্তি হন তারা সবসময় ভয়ে থাকেন। অনেকে ভয়ে চলেও যান', যোগ করেন তিনি।

খুলনার পাইকগাছা সদরের মনজিদপুর থেকে গত মাসের মাঝামাঝি মো. আবদুর রহমান ভর্তি হন বক্ষব্যাধি হাসপাতালে। এক বছর আগে তিনি যক্ষ্মা আক্রান্ত হন। পরে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেলেও আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন।

তিনি বলেন, 'আমি গত বছর একবার এখানে ভর্তি ছিলাম। গত মাসে আবার চিকিৎসা নিতে এসেছি। কিন্তু হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ছাদের দিকে তাকালেই বুক কেঁপে উঠে। বিভিন্ন জায়গায় ফাটল ধরেছে। ভিতরের রডগুলো বের হয়ে আসছে। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ছাদের কার্নিশ দেখলে আরও ভয় করে। কোথাও কোথাও কার্নিশ ভেঙে ঝুলে পড়েছে।'

আব্দুর রহমানের পাশের বেডে বেশ কয়েক মাস ধরে চিকিৎসা নিচ্ছেন বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার শেখ দিলদার।

তিনি বলেন, 'এমনিতেই আমি অসুস্থ। এরকম জায়গায় চিকিৎসা নিতে আসলে মনে আরও ভয় ঢুকে যায়। কত জায়গায় কত নতুন নতুন বিল্ডিং হচ্ছে কিন্তু এই হাসপাতালের এই অবস্থা।'

ছবি: দীপংকর রায়

ওই ওয়ার্ডে ডিউটিরত সিনিয়র স্টাফ নার্স লিন্ডা অধিকারী বলেন, 'প্রথম প্রথম খুব ভয় লাগত। এখন সেটা সয়ে গেছে। আর ভয় করে যাবই বা কোথায়? যাদের দেখার দরকার তারা যদি না দেখেন তাহলে তো করার কিছু নেই।'

'এখানে ভর্তি যক্ষ্মা বা টিবি রোগীদের ৬ মাস থেকে ৯ মাস পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা দেওয়া হয়। তাই এখানে সুস্থতার জন্য দীর্ঘ সময় থাকার যে মানসিক পরিবেশ, সেই ব্যবস্থা থাকা খুবই দরকার', মত দেন তিনি।

ওই হাসপাতালে রোগী ভর্তির তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে এই বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত মোট ভর্তি রোগী ছিলেন ২৯৭ জন। এরমধ্যে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা (এমডিআর টিবি) রোগী ১৬১ জন।

গত মে মাসের তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, ৫১ জন ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ২৯ জন ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা (এমডিআর টিবি) নিয়ে ভর্তি হন। ওই মাসে প্রতিদিন গড়ে ৩২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি থেকেছেন।

জুলাই মাসে এই সংখ্যা ছিল ৫৯ জন। আর এমডিআর টিবি রোগীর সংখ্যা ছিল ৩৭ জন। আগের মাসগুলোতে নিয়মিত ভর্তি থেকেছেন তাদের সংখ্যা ২৫ থেকে ৪০ এর মধ্যে উঠানামা করে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬৫ সালে খুলনা নগরের খানজাহান আলী থানা এলাকার মীরেরডাঙ্গায় ৭ একর জায়গার ওপর খুলনা বক্ষব্যাধি হাসপাতাল নির্মিত হয়। ৫৮ বছরে কয়েক দফা সংস্কার করা হলেও কার্যকরী ও বড় কোনো সংস্কার করা হয়নি।

গত সপ্তাহে ওই হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের এক্সরে রুমেও বড় বড় ফাটল। এক্সরে মেশিনটিও কয়েক মাস ধরে অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। রোগীদের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ এই মেশিনটি সচল না থাকায় বাইরে থেকে এক্সরে করে আনতে হয়।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এই এক্সরে মেশিনটি ২০০৮ সালে আনা হয়। তারপর নতুন কোনো মেশিন আনা হয়নি। মাঝেমাঝে মেরামত করে চালানো হয়।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এই হাসপাতালে চিকিৎসকের ১১টি পদের মধ্যে বিশেষজ্ঞের ২টিসহ ৫টিই শূন্য। এখন এখানে হাসপাপাতালের তত্ত্বাবধায়ক, ৪ জন চিকিৎসা কর্মকর্তা এবং একজন আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা কর্মরত।

পদ থাকলেও হাসপাতালে প্যাথলজি ও রেডিওলজির কোনো চিকিৎসকও নেই। নার্স ছাড়া অন্য সব পদে রয়েছে জনবল সংকট। হাসপাতালে ২৫ জন অফিস সহায়কের ১৬টি পদ ও ১৫টি পরিচ্ছন্নতাকর্মীর পদের মধ্যে ১২টি শূন্য। আউটসোর্সিংয়ের লোক দিয়ে পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপত্তার কাজ চালানো হচ্ছে।

অনেক পরীক্ষা রোগীদের বাইরে থেকে করাতে হয়, যা দরিদ্র রোগীদের জন্য কষ্টসাধ্য। এসব কারণে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিতে অনীহা বাড়ছে।

এ বিষয়ে খুলনার স্বাস্থ্য পরিচালক, খুলনা ডা. মো. মনজুরুল মুরশিদ বলেন, 'বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ দেয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের জন্য আমরা প্রতিনিয়ত লিখছি। নতুন করে নিয়োগ না দেওয়ায় বাকি শূন্যপদগুলো পূরণ করতে পারছি না।'

হাসপাতালের চিকিৎসা তত্ত্বাবধায়ক প্রদীপ চন্দ্র মন্ডল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হাসপাতালটির ভবনগুলোর অবস্থা ভয়াবহ পর্যায়ে চলে গেছে। কর্তৃপক্ষের আগেই এ বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার ছিল।'

তিনি আরও বলেন, 'জরাজীর্ণ ভবন ও পরিত্যক্ত আবাসিক ভবনগুলো পুননির্মাণের জন্য গণপূর্ত থেকে চলতি বছরের শুরুতে ২টি প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে তারা ভিজিট করে গেছেন। তারা জানিয়েছেন, এটি আর সংস্কারযোগ্য নয়, নতুন করে নির্মাণ করতে হবে।'

'তাছাড়া হাসপাতালে ২ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, একজন প্যাথলজিস্ট ও একজন রেজিওলজিস্টের পদ থাকলেও কোনো পদায়ন নাই। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে এ বিষয়ে লিখিতভাবে ও মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে। কিন্তু এখনও কোনো সমাধান হয়নি', যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

1h ago