ভুল চিকিৎসার অভিযোগ ও বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য

বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের গ্যাস্ট্রো অ্যান্টারোলজি এবং হেপাটোলজি বিভাগের কনসালটেন্ট অধ্যাপক ডা. এম এস আরেফিনের বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ তুলেছে মেহবিশ জাহানের পরিবার। তবে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে রোগী ও তার অভিভাবকদের মতামত নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি মেনেই চিকিৎসা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. এম এস আরফিনের বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ তুলে গত ২৯ আগস্ট ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সম্মেলন করে মেহবিশ জাহানের পরিবার (বামে)। সেই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের বক্তব্য জানিয়েছে (ডানে)। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের গ্যাস্ট্রো অ্যান্টারোলজি এবং হেপাটোলজি বিভাগের কনসালটেন্ট অধ্যাপক ডা. এম এস আরেফিনের বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ তুলেছে মেহবিশ জাহানের পরিবার। তবে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে রোগী ও তার অভিভাবকদের মতামত নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি মেনেই চিকিৎসা করা হয়েছে।

মেহবিশ জাহানের স্বামী আহনাফ খানের দাবি, রোগীকে অবহেলা করা হয়েছে এবং ভুলভাবে চিকিৎসা করা হয়েছে।

আজ শুক্রবার তিনি বলেন, 'গত ৯ আগস্ট সকাল সাড়ে ৯টার দিকে প্রসিডিউরের জন্য আমার স্ত্রী হাসপাতালে ভর্তি হন এবং অস্ত্রোপচার বা প্রক্রিয়ার কল পাওয়ার জন্য বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেন।'

'অস্ত্রোপচারের আগে কোনো ডাক্তার বা হাসপাতালের স্টাফ আসেনি এবং আমাদেরকে ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করেনি। আমাকে সন্ধ্যা সাড়ে ৫টার দিকে ই-আর-সিপি রুমে ডাকা হয়েছিল এবং ডা. এম এস আরফিন বলেছিলেন যে রোগীর অবস্থা গুরুতর। কারণ প্রক্রিয়া চলাকালীন একটি আর্টারি কেটে গেছে এবং তাকে আইসিইউতে স্থানান্তরিত করতে হবে। তখন ডক্টর ইমরুল হাসান খান বা কোনো জরুরি চিকিৎসক দলও উপস্থিত ছিলেন না। দলটির সেখানে পৌঁছাতে ১০ থেকে ১৫ মিনিট লেগেছিল। রোগীকে আইসিইউতে স্থানান্তরিত করার সময় ডা. ইমরুল হাসান হস্তক্ষেপ করেন এবং রোগীকে আইসিইউতে না নিয়ে সরাসরি ওটিতে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। অপারেশন শুরু হওয়ার সময় রোগীর কোনো পালস ছিল না। অস্ত্রোপচার শুরু করার পর তারা আমাদেরকে ৭ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করতে বলেন। ডা. আরেফিন চিকিৎসার ঝুঁকি সম্পর্কে উল্লেখ করেনি। এতে করে রোগীর পরিবার আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে পারেনি এবং হাসপাতালও এই ব্যাপারে প্রস্তুত ছিল না। কারণ ওই সময়ে ব্লাড ব্যাংকয়ে রক্ত বা রক্তের ডোনার পাওয়া যায়নি।'

তিনি আরও বলেন, 'অপারেশনের পর রোগীকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। তিনি ভেনটিলেশনে ছিলেন এবং তার অবস্থা এতটাই সংকটজনক ছিল যে তাকে ৩ দিন আইসিইউতে রাখতে হয়। পরবর্তীতে তাকে এইচডিইউতে দেড় দিন এবং তারপর কেবিনে স্থানান্তরিত করা হয়। রোগী হাসপাতালে থাকাকালীন ডা. আরফিন রোগীর পরিবারের কাছে দেখা করতে আসেননি এবং বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে ডাকেননি।'

আহনাফ খানের অভিযোগ, 'হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রথমে ৭০ হাজার টাকা মতো বিল ধারণা দিলেও বিল আসে ৪ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ৪০ হাজার টাকা ছাড় দিয়ে ৪ লাখ ১৭ হাজার টাকার চূড়ান্ত বিল করেন। আমার স্ত্রী অফিস থেকে বিমা কভারেজ পায় ২ লাখ ১৭ হাজার। তার অফিস থেকে প্রাপ্ত জীবন বিমা কাভারেজ থেকে ২ লাখ ১৭ হাজার এবং নগদ ২ লাখ টাকা যুক্ত করে হাসপাতালের বিল পরিশোধ করা হয়। ভুল চিকিৎসার কারণে আমার স্ত্রীর মূল চিকিৎসা আগামী ৬ মাস বিলম্বিত হবে।'

'আমরা প্রাথমিকভাবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কয়েকটি উত্তর চেয়েছিলাম। তবে, পাইনি। এ ছাড়াও হাসপাতাল থেকে কেউ আমাদের এই দুর্ঘটনার পরিপেক্ষিতে কথা বলতে আসেনি। আমরা যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তাদের কাছে থেকে কোনো উত্তর পাইনি', যোগ করেন তিনি।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য

এ বিষয়ে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও সিইও আল এমরান চৌধুরীর সই করা এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের গ্যাস্ট্রো অ্যান্টারোলজি এবং হেপাটোলজি বিভাগের কনস্যালটেন্ট অধ্যাপক ডা. এম এস আরেফিন কর্তৃক একজন রোগী মেহবিশ জাহানের (২৮ বছর) পক্ষে তার অভিভাবক বা অভিভাবকরা ভুল চিকিৎসাজনিত অভিযোগ আনেন এবং সেই আলোকে কিছু সংবাদমাধ্যমে সংবাদ পরিবেশিত হয়। উল্লিখিত কথিত 'ভুল চিকিৎসার' সংক্রান্ত বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গত ২৫ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন। এরপর আবারও রোগীর আত্মীয়রা ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটিতে ২৯ আগস্ট একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য হচ্ছে:

রোগী মেহবিশ জাহান অধ্যাপক ডা. এম এস আরেফিনের কাছে গত প্রায় ৫ বছর ধরে আন্তরিকতা, চিকিৎসা পদ্ধতি, আনুষঙ্গিক বিষয়ে সন্তুষ্ট হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। রোগী মেহবিশ জাহানের অগ্নাশয়ে সিস্ট থাকায়, রোগী এবং তার অভিভাবকদের মতামত নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত চিকিৎসাশাস্ত্রের সব ধাপ অনুসরণ করে অ্যান্ডোসকপি প্রসিডিউরের মাধ্যমে ড্রেইনেজের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। অগ্নাশয়ে কোনো ধরনের সিস্ট হলে উপযুক্ত ক্ষেত্রে তা অ্যান্ডোসকপির মাধ্যমে গ্যাস্ট্রো অ্যান্টারোলজিস্টরাই ড্রেনেজ করে থাকেন। এই ধরনের প্রসিডিউর করার সময় কখনো কখনো জটিলতার উদ্ভব হতে পারে, যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।

এতে আরও বলা হয়েছে, যে কারণে রোগীর প্রসিডিউরের পূর্বে এই পদ্ধতির জটিলতা সম্পর্কে রোগীর লোকজনকে বিস্তারিতভাবে অবহিত করা হয়। ডা. এম এস আরেফিন ওই রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অবহেলা, অসচেতনতা, পেশাদারিত্বের ঘাটতি বা গাফিলতি করেননি। ওই প্রসিডিউরে যে কিছুটা জটিলতা হয়ে থাকতে পারে, সে ব্যাপারেও নিয়ম অনুযায়ী রিস্কবন্ড তার বর্তমান বৈধ অভিভাবক (স্বামী) আহনাফের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে।

চিকিৎসার জন্য রোগীর পরিবারের পক্ষ থেকে চিকিৎসকদের ধন্যবাদ দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, রোগীর প্রসিডিউর করার সময় অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ শুরু হলে সঙ্গে সঙ্গে অ্যান্ডোসকপির মাধ্যমে তা বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়। তারপরও রক্ত বন্ধ না হওয়ায় এবং রোগীর প্রেশার কমে যাওয়ায় 'কোড ব্লু' কল করা হয়। দেরি না করে হেপাটোবিলিয়ারি সার্জন ডা. ইমরুল হাসান খানকে কল করা হয়। একই সময়ে সাময়িক সাপোর্টের জন্য আইসিইউ ডিপার্টমেন্টকে প্রস্তুতি নিতে বলা হয়। রোগীকে নিয়ে আইসিইউতে রওনা করার সময়েই সার্জন ইমরুল হাসান এসে পৌঁছান। তিনি এসে দ্রুততম সময়ের মধ্যে রোগীর জীবন রক্ষার্থে যা যা করণীয় তা সফলভাবে করেন এবং রোগীর অপারেশনের পর কোনো ধরনের ঝুঁকি না নিয়ে রোগীকে আইসিইউতে পাঠানো হয়। সেখান থেকে ২ দিন পরে রোগীর অবস্থার উন্নতি ঘটলে তাকে এইচডিইউতে স্থানান্তরের পর রোগী সব ধরনের ঝুঁকিমুক্ত হয়ে ডিসচার্জ নিয়ে হাসপাতাল ছেড়ে বাসায় চলে যান। সেসময় রোগী ও রোগীর লোকজন চিকিৎসকদের ধন্যবাদ জানান। এরপরও রোগী ফলোআপে ২১ আগস্ট হাসপাতালে আসেন, তখনো রোগী বা তার অভিভাবকদের পক্ষ থেকে কোনো রকমের অভিযোগ বা অসন্তোষ প্রকাশ পায়নি।

তারপরও বিভিন্ন মাধ্যমে রোগীর অভিভাবকদের অপপ্রচারে বাধ্য হয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের প্রখ্যাত গ্যাস্ট্রো অ্যান্টারোলজিস্ট, হেপাটোলজিস্ট ও হেপাটোবিলিয়ারি সার্জনদের নিয়ে একটি বৈঠকের আয়োজন করা হয়। রোগী মেহবিশ জাহানের প্রসিডিউর বিষয়ে বিস্তারিত শোনার পর দেশের প্রখ্যাত এইসব চিকিৎসকদের সম্মিলিতভাবে তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন, রোগী মেহবিশ জাহানের প্রসিডিউর যেভাবে করা হয়েছে, প্রসিডিউর করাকালীন যে কমপ্লিকেসি হয়েছে, এরপর যে ট্রিটমেন্ট করা হয়েছে, তার সবই আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড মেনেই করা হয়েছে। এই ব্যাপারে চিকিৎসক বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোনোরূপ গাফিলতি বা ভুল ছিল না।

বৈঠকে অভিমত দেওয়া বাংলাদেশের প্রখ্যাত গ্যাস্ট্রো অ্যান্টারোলজিস্ট, হেপাটোলজিস্ট ও হেপাটোবিলিয়ারি সার্জনদের মধ্যে রয়েছেন প্রফেসর এ কিউ এম মহসিন, অধ্যাপক আনিসুর রহমান, অধ্যাপক এস এম এ রায়হান, অধ্যাপক হাসান মাসুদ, অধ্যাপক এ এইচ এম রওশন, অধ্যাপক হাবিবুর রহমান, অধ্যাপক ফারুক আহমেদ, অধ্যাপক স্বপন চন্দ্র ধরম, অধ্যাপক হাসান মাসুদ, অধ্যাপক ব্রিগে. জেনারেল বাহার হোসেন, অধ্যাপক তারেক মাহমুদ ভুঁইয়া, অধ্যাপক তৌহিদুল করিম, অধ্যাপক শাহিনুল আলম, অধ্যাপক গোলাম আজম, অধ্যাপক ফিরোজ আহমেদ খান, অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী, ডা. ফাওয়াজ হোসেন শুভ, ডা. মাসুদুর রহমান, ডা. তাজিন আফরোজ শাহ প্রমুখ।

Comments

The Daily Star  | English
Impact of esports on Bangladeshi society

From fringe hobby to national pride

For years, gaming in Bangladesh was seen as a waste of time -- often dismissed as a frivolous activity or a distraction from more “serious” pursuits. Traditional societal norms placed little value on gaming, perceiving it as an endeavour devoid of any real-world benefits.

18h ago