ডেঙ্গু: বিপজ্জনক লক্ষণ দেখেও দেরিতে হাসপাতালে ভর্তিতে বাড়ছে ঝুঁকি ও খরচ

ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

গত ৩১ জুলাই নিজের ৫ বছর বয়সী কন্যা ইসরাত জাহান ফাতেমার নাক দিয়ে রক্ত পড়তে দেখে ভয় পেয়ে যান মায়া আক্তার সুমি।

অথচ ৩ দিন পর জ্বর কমে যাওয়ায় অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন সুমি ও তার স্বামী। ২ মেয়েকে নিয়ে রাজধানীর মিরপুর-২ নম্বরে একটি ভাড়া বাসায় থাকেন এই দম্পতি।

ওই রাতেই তাকে ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ অ্যান্ড শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন রক্ত পরীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনা করে চিকিৎসকরা দ্রুত তাকে শ্যামলীর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে ভর্তির পরামর্শ দেন।

কিন্তু ফাতেমাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় ৩ আগস্ট।

চিকিৎসকদের ভাষ্য, হাসপাতালে ভর্তির পর ফাতেমার বেশকিছু শারীরিক জটিলতা দেখা দেয় এবং এতে চিকিৎসার খরচও বেড়ে যায়।

গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে সুমি বলেন, 'রক্ত পড়া যে ডেঙ্গুর বিপজ্জনক লক্ষণ, তা আমাদের জানা ছিল না। আমরা ভেবেছিলাম আমাদের মেয়ে ঠিক আছে, কারণ ৩ দিনের মধ্যে তার জ্বর চলে গেছে। এখন আমরা আমাদের মেয়েকে নিয়ে চিন্তিত।'

'হাসপাতালে শুধু ওষুধ কিনতে প্রতিদিন গড়ে ৫-৬ হাজার টাকা খরচ করতে হতো। খরচ সামলাতে আমাদের টাকা ধারও করতে হয়েছিল', বলেন তিনি।

চিকিৎসকরা বারবার বলছেন, বিপজ্জনক লক্ষণ দেখার পরেও হাসপাতালে দেরিতে ভর্তি করালে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুর ঝুঁকি ও চিকিৎসা খরচ বেড়ে যায়।

সাভারের হেমায়েতপুরের ২১ মাস বয়সী রাফিয়া ইসলামকে গত ২৫ জুলাই দেরিতে শিশু হাসপাতালে ভর্তি করায় তার বাবা-মাকে শুধু ওষুধের জন্য ৬০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে।

অন্যদিকে লেগুনাচালক শাহাদাত হোসেনকে তার ১১ বছর বয়সী ছেলের জন্য কিনতে হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার টাকার ওষুধ, যা জোড়ার করা তার জন্য যথেষ্ট কষ্টদায়ক ছিল।

চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুসারে, উপরে উল্লেখিত ৩টি ক্ষেত্রেই প্রধান ব্যয় ছিল ব্যয়বহুল অ্যান্টিবায়োটিক—মেরোপেনেম ইনজেকশন ও অ্যালবুমিনের জন্য।

শিশু হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ও চিফ কনসালট্যান্ট ডা. কামরুজ্জামান কামরুল গতকাল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেরিতে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ফলে অ্যান্টিবায়োটিক ও অন্যান্য ওষুধের প্রয়োজন বেড়ে যায়। এর ফলে চিকিৎসার খরচও অনেক বেড়ে যায়।'

দেরিতে হাসপাতালে ভর্তি করালেও ঝুঁকিও বাড়ে, যা শিশুদের ক্ষেত্রে অনেক বেশি। কারণ প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের মাল্টি-অর্গান ফেইলিওর দ্রুত হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর এখন পর্যন্ত ০-১০ বছর বয়সী ৪৮ শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে, যা গতকাল পর্যন্ত মোট মৃত্যু ৪২৬ এর প্রায় ৯ শতাংশ।

হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে সামগ্রিক মৃত্যুর হার দশমিক ৫ শতাংশ হলেও শিশুদের ক্ষেত্রে এই হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি, যা হাসপাতালে ভর্তি ১০ হাজার ৮১৯ শিশুর মধ্যে প্রায় ১২ শতাংশ।

তবে এই পরিসংখ্যানে ১১-১৫ বছর বয়সী শিশুদের কথা বলা হয়নি।

গতকাল পর্যন্ত এই বয়সের ৬ হাজার ৯৩৮ জন শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এবং তাদের মধ্যে ১৮ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে, যা মোট মৃত্যুর ৪ শতাংশ।

ডা. কামরুজ্জামান বলেন, 'অনেক সময় নানা কারণে ডেঙ্গু পরীক্ষার ফল নেগেটিভ হতে পারে। তাই বাবা-মাকে বাড়তি সতর্ক থাকতে হবে।'

ডেঙ্গুর বিপজ্জনক লক্ষণগুলোর বিষয়ে অভিভাবকদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. ইফফাত আরা শামসাদ গতকাল বলেন, 'যখন কোনো শিশু জ্বরে আক্রান্ত হয়, তখন চিকিৎসকের অধীনে চিকিত্সা চালিয়ে যাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেটা শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় বাড়িতে বা হাসপাতালে হতে পারে। কারণ শিশুরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পর তাদের মারাত্মক উপসর্গ দেখা দেওয়ার ঝুঁকি থাকে।'

সম্প্রতি শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক এইচ এম নাজমুল আহসান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর পেটে তীব্র ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, প্রচণ্ড দুর্বলতা, বমি অথবা মাড়ি ও নাক থেকে রক্ত আসতে দেখলে তাৎক্ষণিক হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। যদি এমন অবস্থা হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি না করা হয় তাহলে রোগীর ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম হয়ে যেতে পারে।'

গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক হাজার ৯৮৪ জন।

এ নিয়ে মোট ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ৮৯ হাজার ৮৭৫ জনে।

Comments

The Daily Star  | English

'A staged drama'

14 parties boycott proclamation dialogue

2h ago