জীবন এখন যেমন: কম কিনছেন কম খাচ্ছেন

মো. সাবাব হোসাইন (ছদ্মনাম) পেশায় একজন গার্মেন্টস কর্মকর্তা। বয়স ৫০ এর বেশি। বাড়ি হবিগঞ্জে। গত ২ মাসে খাবারসহ অন্যান্য খরচ মিলে তার ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১০ হাজার টাকা। তবে আয় ১ টাকাও বাড়েনি।

আয় না বাড়লে বাড়তি খরচের যোগান দিচ্ছেন কীভাবে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'কিছু সঞ্চয় ছিল। সেগুলো ভেঙে খরচ করছি। জানি না কতদিন চলবে। এক প্রকার নিরুপায় হয়ে গেছি।'

গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় কারওয়ান বাজারের চালের দোকানের সামনে সাবাব হোসাইনের সঙ্গে দ্য ডেইলি স্টারের কথা হয়।

স্ত্রী ও ২ সন্তান নিয়ে ৪ জনের পরিবার সাবাব হোসাইনের। কাজ করেন সাভারের একটি গার্মেন্টসে। থাকেন রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকায়। সেখানেই থেকেই অফিসে যাতায়াত করেন।

এই গার্মেন্টস কর্মকর্তা বলেন, 'আমার ২ শিশুর জন্য দুধ কিনতে হয়। প্রতি কেজি দুধের দাম প্রায় ১০০ টাকা বেড়েছে। যে চাল আগে কিনতাম ৬৮ টাকা কেজি, সেই চাল এখন ৭৪ টাকা। বাস ভাড়া বেড়েছে। প্রায় সব নিত্যপণ্যের মূল্য বেড়েছে। এমন একটা পর্যায়ে আছি না পারছি খরচ কমাতে, না পারছি কমদামি পণ্য কিনতে। বাধ্য হয়েই সঞ্চয় ভেঙে চলছি।'

এভাবে আর কতদিন চলতে পারবেন, জানতে চাইলে কিছুক্ষণ চুপ থাকেন তিনি। তারপর বলেন, 'মনের কষ্টগুলো কাউকে বলতে পারি না। কিছুদিন আগে আমাদের গার্মেন্টেসের মালিক বলেছেন তাদের নাকি বিক্রি কমে গেছে। লোক ছাঁটাইয়ের কথা ভাবছে। আমাদেরকে চাকরি খুঁজতে বলেছেন। পরে আমরা বাধ্য হয়ে সবাই বলেছি ছাঁটাই না করে আমাদের বেতন একটু কমিয়ে দেন। এই বয়সে কোথায় চাকরি খুঁজব। সবমিলে আমার আয় কমেছে, কিন্তু ব্যয় বেড়েছে।'

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে খাবার কমিয়েছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমি যে পরিস্থিতিতে আছি, চাইলেও খাবার কমানো বা খরচ কমানো সম্ভব না। তবে আমার অনেক বন্ধু-বান্ধব খরচ কমিয়েছে। যারা আগে চিকন চাল কিনতেন, তারা এখন মোটা চাল খাচ্ছেন। কেউ বা পরিবার গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে অফিসের আশেপাশে একটা রুম নিয়ে থাকছেন। এভাবে চলতে থাকলে আমাকেও হয়তো পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে কম খরচে চলতে হবে।'

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সানজিদা আক্তার (ছদ্মনাম) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আগে নিয়মিত কফি খেতাম, এখন আর খাই না। আমার বাসায় সবসময় ফলমূল থাকত। কাঠবাদাম, কাজুবাদাম এগুলো খেতাম। এখন ৩ বেলা খেতে পারলেই বাঁচি। মুখ লজ্জায় এই কথাগুলো কারো সঙ্গে শেয়ারও করতে পারি না।'

'আমার আয় বাড়েনি, কিন্তু খরচ বেড়েছে। ব্যাংকে কিছু টাকা ছিল, সেখান থেকে চলছি। বেশি অবস্থা খারাপ হলে গ্রামে চলে যাব। সেলাইকাজ জানি। সেটি দিয়েই টুকিটাকি আয় করে চলব', তিনি যোগ করেন।

মানুষ যে তাদের সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ডেইলি স্টার আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকেও। গত শনিবার ডেইলি স্টার আয়োজিত 'আর্থিক খাতের চ্যালেঞ্জ ও করণীয়' সম্পর্কিত এক গোলটেবিল বৈঠকে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ১০ জন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে এনআরবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মামুন মাহমুদ শাহ বলেন, 'দেশে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির কারণে মানুষ তাদের জমা টাকা তুলে নিচ্ছেন। গত ৯ মাসের চিত্র থেকে বললে, ৩৫ শতাংশ এফডিআর গ্রাহকরা ভেঙেছেন প্রাত্যহিক খরচ চালাতে।'

অন্যান্য ব্যাংকের কর্মকর্তারা তার এই বক্তব্যকে সমর্থন করেন এবং তাদের ব্যাংকেও প্রায় একই অবস্থা বলে জানান।

মানুষ যে কম কিনছেন, সেই প্রমাণও পাওয়া যায় দোকানীদের সঙ্গে কথা বলে। ঢাকা রাইসের সত্ত্বাধিকারী মো. সায়েম বলেন, 'আমার আগের যে ক্রেতারা চিকন চাল কিনতেন, তারা এখন মোটা চাল কিনছেন। এমনো কিছু ক্রেতা আছেন যারা আগে প্রতিমাসে ২৫ কেজি চাল কিনতেন, তারা এখন ১৫-২০ কেজি কিনছেন। কম চাল কেনে চলেন কীভাবে, সেটা তারাই ভালো জানেন। দেখ বোঝা যায় সবাই অনেক কষ্টে আছেন।'

আগামী বৈশাখ মাসের আগে চালের দাম কমারে সম্ভাবনা কম জানিয়ে তিনি বলেন, 'ভাতের জন্যে যে চালটা আসে, তা মূলত বৈশাখ মাসে যে ধান হয়, সেখান থেকেই। অন্য সময়ে যে ধান হয়, সেখান থেকে ভাতের জন্য ভালো চাল আসে না এবং সেই চালের ভাতও ভালো হয় না।'

মানুষ এখন দামাদামি বেশি করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'চালের দাম কম থাকলে আমাদের বিক্রি বেশি হয়, লাভও বেশি হয়। এখন মানুষ কয়েক দোকান ঘুরে চাল কিনছেন। এ মাসের শুরুতে আটাশ চালের কেজি ছিল ৫৪ থেকে ৫৬ টাকা। সেটি এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৭ থেকে ৫৮ টাকায়। মিনিকেট ছিল ৬৮ থেকে ৭০ টাকা কেজি, এখন বিক্রি হচ্ছে ৭২ থেকে ৭৪ টাকায়, প্রতি কেজি নাজিরশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮২ টাকায়, যা আগে ছিল ৭৫ থেকে ৭৮ টাকা।'

আটা-ময়দা বিক্রেতা লাকসাম দোকানের মালিক আবুল হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হোটেলগুলোতে এখন কম বিক্রি হচ্ছে। সম্ভবত জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষ কম খাচ্ছেন। তাই আমাদেরও বিক্রি প্রায় ৫০ শতাংশ কমেছে। আগে যেখানে ৩০ থেকে ৪০ বস্তা বিক্রি করতাম, এখন করি ১৫ থেকে ২০ বস্তা।'

আবুল হোসেন কথার সত্যতা মিলে তেজতুরি বাজারের একটি হোটেল গিয়ে। হোটেল মালিক রনি বলেন, 'আগে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার টাকা বিক্রি করতাম। এখন প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা বিক্রি হয়। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষ এখন কম খাচ্ছে। কেউ বা আগে ২০ টাকার খেত, এখন ১০ টাকার খাচ্ছে।'

কারওয়ান বাজারের একটি খেজুরের দোকানের সামনে প্রায় ৩০ মিনিট দাঁড়িয়ে ছিলেন এই প্রতিবেদক। এই সময়ের মধ্যে সেখানে মাত্র ২ জন ক্রেতা আসেন। তবে তারা বিভিন্ন খেজুরের দাম জিজ্ঞেস করে চলে যান।

দোকানের মালিক খাইরুল ইসলাম বলেন, 'আমি ১ মাস আগেও প্রতিদিন গড়ে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার খেজুর বিক্রি করতাম। এখন ৪ থেকে ৫ হাজার টাকার বিক্রি হয়। কয়েকদিনের মধ্যে একদিন সর্বোচ্চ ৬ হাজার টাকার বিক্রি করেছি। সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষ এখন অন্যান্য জরুরি পণ্য কিনতেই হিমশিম খাচ্ছেন। তাই বেশি দাম শুনে খেজুর না কিনেই চলে যান।'

প্রতিটি খেজুরে দাম বেড়ে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, '১ মাস আগে আজওয়া খেজুর ছিল ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি, এখন তা ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা, মাবরুম মরিয়ম ছিল ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকা, এখন তা ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা, কলমি মরিয়ম ছিল ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা, তা বেড়ে হয়েছে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা। সব খেজুরেরই দাম বেড়েছে প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। খেজুর মূলত মানুষ অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি খায়। দাম বেড়ে যাওয়ায় যারা আগে এক কেজি কিনতেন, তারা এখন আধা কেজি কিনছেন। কেউ আবার কেনাই বাদ দিয়েছেন।'

বিক্রি কম হলে আয়ও কম হবে। তাহলে চলছেন কীভাবে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমরা মূলত আতপ চালের ভাত খাই। এক মাসে আগে যে চাল ৩ হাজার ৩০০ দিয়ে কিনেছি, সেই চাল এখন ৪ হাজার ১০০ টাকা চায়। দোকানে গিয়ে ঘুরে এসেছি। এখন বুঝি সিদ্ধান্ত বদলাতে হবে। সাধারণ চালের ভাত খেতে হবে।'

আল্লাহর দান মুদি দোকানের মালিক মো. ওমর ফারুক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রায় ১ সপ্তাহের ব্যবধানে ১৩০ টাকার মসুর ডাল ১৩৫ টাকা, ১০৫ টাকার মসুর ডাল ১১০ টাকা, প্যাকেটজাত ৯০ টাকার চিনি ৯৫ টাকা, খোলা ৮৫ টাকার চিনি ৯০ টাকা, ১১০ টাকার আটার প্যাকেট (২ কেজি) ১২৬ টাকা, ২১০ টাকার নুডুলস এখন ২৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি ৫ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৯৪৫ টাকা, লবণ ৩৫ টাকা থেকে বেড়ে ৩৮ টাকা হয়েছে।'

'দাম বাড়ায় যেখানে আগে বিক্রি করতার ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা, সেখানে এখন বিক্রি করি ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। সবাই কষ্টে আছে। মানুষ জিনিসপত্র কম কিনছে', যোগ করেন তিনি।

কারওয়ান বাজারের ফলমূলের দোকান ঘুরে দেখা যায়, মাল্টা প্রতি কেজি ২৩০ টাকা, সবুজ আপেল ৩০০ টাকা, রয়েল গালা আপেল ২৮০ টাকা, ফুজি আপেল ২৫০ টাকা, নাশপাতি ২৫০ টাকা, আনার ৪০০ টাকা, কমলা ৩০০ টাকা ও লাল আঙ্গুর ৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

Comments

The Daily Star  | English

Record toll collection on Padma and Jamuna bridges

Padma Bridge generated a record toll revenue of Tk 54.32 crore, while Jamuna Tk 41.81 crore

2h ago