ডেঙ্গু কি থেকেই যাবে?

ডেঙ্গু
স্টার ফাইল ফটো

সাধারণত বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেশি হয়। শীত নামতে নামতে সংক্রমণ কমে আসে। কিন্তু এ বছর এক ভিন্ন চিত্র দেখছে বাংলাদেশ।

চলতি বছরের ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন দুই লাখ ৯৩ হাজার ৫৭২ জন। আর সবমিলিয়ে এ বছর এক হাজার ৪৮৪ জনের প্রাণ কেড়েছে ডেঙ্গু।

চলতি নভেম্বরেও প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। গড়ে প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা থাকছে ১০ এর আশপাশেই।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও বিশেষজ্ঞদের অভিমত, চলতি নভেম্বরে সংক্রমণ ও মৃত্যু কিছুটা কমে আসলেও এখনো তা গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি। সেইসঙ্গে চলতি বছর এই রোগটি যেভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, তাতেও আশঙ্কার কালো মেঘ দেখছেন তারা।

এমন পরিস্থিতিতেও এখন পর্যন্ত সরকারের তরফ থেকে কার্যকর ও সমন্বিত উদ্যোগ না থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তারা। সেইসঙ্গে তারা ডেঙ্গুকে এখন সারা বছরের রোগ হিসেবেই বিবেচনা করতে চাচ্ছেন।

গতকাল সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের প্রতিবেদনে বলা হয়, রোববার সকাল ৮টা থেকে সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক হাজার ৭৪০ জন; এ সময়ে মশাবাহিত রোগটিতে মৃত্যু হয়েছে আট জনের।

সারা দেশে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে এক হাজার ৫৪৫ জন ঢাকা মহানগরে ও চার হাজার ৪৭২ জন দেশের অন্যান্য হাসপাতালের ভর্তি ছিলেন।

'আমরা তো পাবলিক হেলথ ইমার্জেন্সি ঘোষণার কথা বলেছিলাম। তারা (সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও সরকারি সংস্থা) তো এটাতে খুব রিঅ্যাক্ট করলেন। হাসপাতালের বেডে যখন রোগীকে জায়গা দেওয়া যায় না, মেঝেতে রাখতে হয়— তখন এর চেয়ে ইমার্জেন্সি আর কী হতে পারে। সুতরাং এতটুকু গুরুত্ব না দিলে তো ক্ষয়ক্ষতি হতেই থাকবে।'

দেশে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগের বড় প্রাদুর্ভাব হয় ২০০০ সালে। সে বছর ৯৩ জনের মৃত্যু হয়। এরপর সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড হয়েছিল গত বছর, ২৮১ জন।

এই ২২ বছরের মধ্যে বেশির ভাগ বছরেই ডেঙ্গুতে কমবেশি মৃত্যু দেখেছে দেশ। এবার মৃত্যুর রেকর্ড সবকিছুকেই ছাড়িয়ে গেছে।

পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে এক লাখ ৮৯ হাজার ৬৬৪ জন ঢাকার বাইরের জেলাগুলোর। এই রোগে মৃত্যু হওয়া এক হাজার ৪৮৪ জনের মধ্যে ৬১৯ জন ঢাকার বাইরে হাসপাতালগুলোয় মারা গেছেন।

ডেঙ্গু

এভাবে মূল মৌসুম ছাপিয়ে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু সংক্রমণের বিস্তৃতি, এখন পর্যন্ত সেভাবে সংক্রমণ না কমা এবং চলমান প্রবণতার ভবিষ্যৎ শঙ্কা নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজীর আহমেদের সঙ্গে।

বিষয়টি নিয়ে মুশতাক আহমেদ বলেন, 'এডিস মশার প্রজনন তো চলতেই থাকবে। বৃষ্টি কমে আসলে পরিমাণটা কম হয়। কিন্তু পরিষ্কার পানি জমে থাকার যে পরিবেশ, সেই পরিবেশ তো আগের মতোই আছে। প্লাস্টিকের বোতলে পানি জমে থাকছে, পলিথিনে পানি জমছে, ভবনে-ভাঙা রাস্তায় পানি জমছে। বৃষ্টি ছাড়াও কৃষিকাজে আমরা পরিষ্কার পানি ব্যবহার করছি, নগর উন্নয়নের কাজে পানি ব্যবহার করছি।'

'সুতরাং রোগী থাকবে। মৃত্যু হয়তো কমে যাবে কিছুদিন পরে। রোগীর সংখ্যা কমলে মৃত্যুও কমবে। সেটা দেখতে হয়তো ডিসেম্বর লাগবে। কিন্তু রোগীশূন্য কিংবা মৃত্যুশূন্য একেবারেই হয়ে যাবে সেই আশা করা যাচ্ছে না। এটা কোনো না কোনোভাবে থেকেই যাবে।'

চলতি বছরের মাঝামাঝি থেকে সংক্রমণ ও মৃত্যুর উর্ধ্বগতি সত্ত্বেও সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো 'সামগ্রিক উদ্যোগ' নেয়নি মন্তব্য করে এই জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ আরও বলেন, 'আমরা তো পাবলিক হেলথ ইমার্জেন্সি ঘোষণার কথা বলেছিলাম। তারা (সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও সরকারি সংস্থা) তো এটাতে খুব রিঅ্যাক্ট করলেন। হাসপাতালের বেডে যখন রোগীকে জায়গা দেওয়া যায় না, মেঝেতে রাখতে হয়— তখন এর চেয়ে ইমার্জেন্সি আর কী হতে পারে। সুতরাং এতটুকু গুরুত্ব না দিলে তো ক্ষয়ক্ষতি হতেই থাকবে।'

তার মতে, 'আমরা যদি পরিবেশ পরিষ্কার না রাখি, চিকিৎসার সাংগঠনিক কাঠামোকে যদি বিকেন্দ্রীকরণ না করি, সবাই যদি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসে, প্রাইমারি কেয়ার, সেকেন্ডারি কেয়ার যদি আমরা ফাংশনাল না করি তাহলে তো মৃত্যু কমাতে পারব না।'

'আমার মনে হয় সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে এখনই একটা জাতীয় কর্মকৌশল প্রণয়ন করা দরকার। স্থানীয় সরকার দিয়ে এটা হবে না। হেলথকেই লিডারশিপটা দিতে হবে। ভেক্টর কন্ট্রোলের জন্য এন্টোমলোজিস্ট, এন্টোমলোজিক্যাল ক্যাপাসিটি বাড়াতে হবে দেশজুড়ে। না হলে অসহ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা আছে।'

'রোগী কমানোর কাজটি খুব কষ্টের। কারণ সার্বিক উদ্যোগ নিলেও মশা নিয়ন্ত্রণে আনতে কয়েক বছর লাগবে। কিন্তু রোগীর মৃত্যু কমানো সম্ভব। সেটাও তো করা হচ্ছে না।'

গত ৩০ অক্টোবর প্রকাশিত 'ডেঙ্গু সংকট প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ' শীর্ষক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট পূর্বসতর্কতা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মপরিকল্পনা থাকার পরও সরকার এতে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়নি। মশাবাহিত এই রোগটি মোকাবিলায় ব্যর্থতার দায় অনৈতিকভাবে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব এড়ানোর কারণে সারা দেশে এ বছর সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

এর বাইরে বর্ষা শেষে শীত প্রায় চলে আসলেও সংক্রমণ সেভাবে না কমার ব্যাখ্যায় বে-নজীর আহমেদ বলেন, 'এখানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আছে। যে কারণে অকাল বৃষ্টিপাত ও মৌসুমের অতিরিক্ত বৃষ্টির বাইরেও সারাবছর বিভিন্ন সময় বৃষ্টিপাত হচ্ছে।'

'দ্বিতীয় বিষয়টা হচ্ছে তাপমাত্রা বৃদ্ধি। শীতকালে তাপমাত্রা কমে গেলে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে আসে। কিন্তু এখন নভেম্বরেও দেখা যায় তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে থাকছে। এগুলো এই ট্রান্সমিশনে সাহায্য করছে।'

ডেঙ্গু
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সন্তানসম্ভবা ফারজানার মৃত্যুতে মেয়ে সায়মার আহাজারি। ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার ফাইল ফটো

এর পাশাপাশি চলতি বছর ঢাকার বাইরে রোগটি ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে এই গবেষক বলেন, 'ডেঙ্গুর চার ধরন—ডেন ১, ডেন ২, ডেন ৩ ও ডেন ৪। সাধারণত দেখা যায় এর যেকেনো একটা সেরোটাইপ দ্বারা আক্রান্ত হলে ওই সেরোটাইপ দ্বারা পরবর্তীতে আর কেউ আক্রান্ত হয় না। কারণ এর বিপরীতে একটা রেসিস্ট্যান্স দাঁড়িয়ে যায়। ঢাকায় যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে সংক্রমণ হচ্ছে, তাই ঢাকার মানুষ ইতোমধ্যেই বিভিন্ন সেরোটাইপ দ্বারা আক্রান্ত। সুতরাং তাদের আর ওই সেরোটাইপ দ্বারা সংক্রমণ হবে না।'

'কিন্তু ঢাকার বাইরে সেটা হবে না। তারা যেহেতু আগে আক্রান্ত হননি, তাই যেকোনো সেরোটাইপই আসুক না কেন গ্রামের মানুষ এখন আক্রান্ত হতে থাকবেন। এই ঘটনাটা আগামী ১০-২০ বছর ধরে চলতে পারে; যতদিন না তারা একাধিক সেরোটাইপ দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন।'

বে-নজীর আহমেদের বক্তব্য, ঢাকার বাইরে এভাবে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার কারণে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে একটা বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। সবমিলিয়ে সামনের দিনগুলোয় আসলে কী হতে পারে—তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।

তিনি আরও বলেন, 'আমার মনে হয় সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে এখনই একটা জাতীয় কর্মকৌশল প্রণয়ন করা দরকার। স্থানীয় সরকার দিয়ে এটা হবে না। হেলথকেই লিডারশিপটা দিতে হবে। ভেক্টর কন্ট্রোলের জন্য এন্টোমলোজিস্ট, এন্টোমলোজিক্যাল ক্যাপাসিটি বাড়াতে হবে দেশজুড়ে। না হলে অসহ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা আছে।'

'আমাদের ইউনিয়ন কাউন্সিলগুলোতে তো ভেক্টর কন্ট্রোলের কোনো ক্যাপাসিটি নেই। ছোট ছোট পৌরসভাগুলোতেও নেই। ঢাকা সিটিতেই যদি আমরা খাবি খাই তাহলে দেশজুড়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে কী হবে—তা ভাবাও যাচ্ছে না।'

Comments

The Daily Star  | English

Smaller in size, larger in intent

Finance Adviser Salehuddin Ahmed has offered both empathy and arithmetic in his budget speech, laying out a vision that puts people, not just projects, at the heart of economic policy.

10h ago