প্রবল ঘূর্ণিঝড় হয়ে আঘাত হানতে পারে দানা, বাংলাদেশের ঝুঁকি কতটা?
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় দানা শক্তিশালী হয়ে উঠছে। আবহাওয়াবিদরা মনে করছেন, এটি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়ে উপকূলে আঘাত হানতে পারে।
ঝড়ের কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর খুবই উত্তাল রয়েছে। এছাড়া, গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালার কারণে উপকূলীয় এলাকা চট্টগ্রাম, সন্দ্বীপ, বরিশাল, হাতিয়া, খুলনার পাশাপাশি রাজশাহী ও রংপুরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
পাশাপাশি আবহাওয়া অনুকূল না হওয়া পর্যন্ত উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় দানা ঠিক কোথায় এবং কখন আঘাত হানতে পারে, তা নিশ্চিত করে বলতে হলে আরও অপেক্ষা করতে হবে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। তবে তারা ধারণা করছেন, ভারতের ওডিশা ও পশ্চিমবঙ্গের মাঝামাঝি কোনো একটি জায়গা দিয়ে দানা উপকূল অতিক্রম করতে পারে।
আজ বুধবার দিবাগত রাতে বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখন পর্যন্ত গাণিতিক মডেল অনুযায়ী, ২৪ অক্টোবর মধ্যরাত থেকে ২৫ অক্টোবর সকালের মধ্যে ঝড়টি উপকূল অতিক্রম করতে পারে।'
'তবে এখনো সুনির্দিষ্ট করে বলার সময় আসেনি। কারণ ঝড়টি এখনো উপকূল থেকে অনেক দূরে। সাধারণত ঘূর্ণিঝড়ের বডি মুভমেন্ট থাকে ঘণ্টায় ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার, কখনো কখনো ঘণ্টায় ২৫ কিলোমিটার। ২০২২ সালে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, উপকূল অতিক্রম করার এক ঘণ্টা আগে এর গতি বেড়ে হয়েছিল সর্বোচ্চ ৫৭ কিলোমিটার। মিধিলির সময়ও আমরা এ রকম ব্যতিক্রম আচরণ দেখতে পেয়েছি,' যোগ করেন তিনি।
আবুল কালাম মল্লিক জানান, ঘূর্ণিঝড় দানার বড়ি মুভমেন্ট ঘণ্টায় ১২ থেকে ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে ওঠানামা করছে। যদি এই গতিতেই এগোতে থাকে, তাহলে ২৪ অক্টোবর মধ্যরাত থেকে ২৫ অক্টোবর সকালের মধ্যে ঝড়টি উপকূল অতিক্রম করবে।
একই তথ্য জানিয়েছেন ভারতের আবহাওয়া দপ্তরের প্রাদেশিক অধিকর্তা সোমনাথ দত্ত।
ঘূর্ণিঝড়ে সাধারণত বাতাসের গতিবেগ হয় প্রতি ঘণ্টায় ৬২ থেকে ৮৮ কিলোমিটার। বাতাসের গতি ৮৯ থেকে ১১৮ কিলোমিটার থাকলে প্রবল ঘূর্ণিঝড় বলা হয়। বাতাসের গতি ১১৯ থেকে ২১৯ পর্যন্ত অতি প্রবল এবং প্রতি ঘণ্টায় ২২০ কিলোমিটারের বেশি থাকলে সুপার সাইক্লোন বিবেচনা করে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ছয় নম্বর বিশেষ বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, বুধবার সন্ধ্যা ৬টায় দানা পায়রা সমুদ্রবন্দরের সবচেয়ে কাছে ছিল। ঘূর্ণিঝড়টি বন্দর থেকে ৫৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে অবস্থান করছিল। সে সময় ঝড়ের কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার। দমকা বা ঝড়ো হাওয়া আকারে যা ঘণ্টায় ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছে।
চলতি মাসের শুরুতেই দীর্ঘ মেয়াদি পূর্বাভাসে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছিল যে, অক্টোবরে বঙ্গোপসাগরে একটি থেকে তিনটি লঘুচাপের সৃষ্টি হতে পারে। যার মধ্যে একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
যে কারণে অক্টোবরের শেষে বারবার ঘূর্ণিঝড়, বাংলাদেশের ঝুঁকি
আবহাওয়া পরিসংখ্যান অনুসারে, অক্টোবর মাসে এই অঞ্চলে ১৮৯১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৩২ বছরে ঘূর্ণিঝড় হয়েছে ৫১টি এবং অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় হয়েছে ৪৩টি। এর মধ্যে বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডের উপকূল অতিক্রম করেছে ১৯টি, আটটি ঘূর্ণিঝড় এবং ১১টি অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়।
বঙ্গোপসাগরে অক্টোবর মাসে যে ১৯টি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্ট হয়েছে, তার প্রত্যেকটি ২০ তারিখের পরে।
ঘূর্ণিঝড় দানা বাংলাদেশ উপকূলে সরাসরি আঘাত না করলেও জোয়ারের সময় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি জলোচ্ছ্বাস কিংবা টানা বৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতার আশঙ্কা রয়েছে।
এর কারণ ব্যাখ্যা করে আবুল কালাম মল্লিক বলেন, 'এখানে অনেকগুলো বিষয় কাজ করে। গত ১৩ অক্টোবর আমাদের এখান থেকে মৌসুমি বায়ু বিদায় নিয়েছে এবং ২৩ অক্টোবর সূর্যের দক্ষিণায়ন হয়েছে। এই সময়টায় সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। বর্তমানে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা রয়েছে ২৮ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে।'
'এ ছাড়া, পূবালী লঘুচাপের বর্ধিতাংশ যখন আমাদের দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর বা আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কাছাকাছি এসে পড়ে, তখন সেই লঘুচাপটি শক্তিমাত্রা অর্জন করে ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। মেডেন-জুলিয়ান ওসিলেশন (এমজেও) শর্তগুলো অনুকূলে থাকলে ঝড়ের চতুর্দিকে গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা তৈরি হয়ে বজ্রবৃষ্টি হয় এবং ঘূর্ণিঝড় ঘনীভূত হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করে,' বলেন তিনি।
ট্রপিকাল সাইক্লোন হিট পটেনশিয়ালের মান অনুকূলে আছে জানিয়ে এই আবহাওয়াবিদ বলেন, 'এটি আজ মধ্যরাত থেকে ঘূর্ণিঝড় দানাকে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।'
ঘূর্ণিবায়ুর আবর্তনের শক্তিমাত্রাও ক্রমশ বাড়ছে, যা প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার জন্য অনুকূল বলে জানান তিনি।
এই আবহাওয়াবিদ বলেন, 'ঊর্ধ্ব আকাশ ও ভূ-পৃষ্ঠের কাছাকাছি, এই দুই স্তরের বাতাসের পার্থক্য কমে গেলেও ঘূর্ণিঝড় শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সেটিও এখন অনুকূল অবস্থায় রয়েছে। ঝড় প্রচণ্ড বেগে ঘুরতে থাকলে সাগরে বাষ্পায়নের হার বেড়ে যায়। জলীয়বাষ্প বাতাসে মিশে যায় এবং সুপ্ত তাপ ছেড়ে দিয়ে ঘূর্ণিঝড়কে স্তরে স্তরে শক্তিশালী করে তোলে।'
ঘূর্ণিঝড়টির উপকূল অতিক্রম করার সময় ডান দিকে থাকবে বাংলাদেশের উপকূল। ডান দিকে থাকার কারণে বাংলাদেশের উপকূলে এর প্রভাব থাকবে অপেক্ষাকৃত বেশি, বাম দিকে থাকলে সাধারণত কম থাকে। ফলে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়া বয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, হতে পারে বজ্রসহ বৃষ্টি।
আবুল কালাম মল্লিক বলেন, 'ঝড় কাছাকাছি এলে বজ্রঝড়, নদ-নদীর পানি ফুলে উঠে উপকূলীয় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। বৃহস্পতিবার দুপুরের পরে এটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।'
Comments