যেসব কারণে আতশবাজি ফুটিয়ে উদযাপন উচিত নয়

ছবি: সৌরভ দে

প্রায় সারা বছরই জমজমাট থাকে পুরান ঢাকার নারিন্দা এলাকা। বছরের শেষ দিনে এর মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ২০২১ সালের ইংরেজি নববর্ষের শুরুটাও ঠিক এমনই ছিল। ১২ বছর বয়সী জেরিন তার সমবয়সীদের সঙ্গে আকাশে আতশবাজির খেলা দেখছিল। লাল, নীল, হলুদ, সাদা নানান রঙে আকাশ থেকে ছড়িয়ে পড়ছিল আলোর কণা।

জেরিনের আনন্দ আরও বেড়ে যায় যখন সে দেখে তার বারান্দায় অনেকগুলো পাখি ছুটোছুটি করছে। তাদের মধ্যে একটি পাখি থেকে যায় জেরিনের বাসায়। ছটফট করা পাখিটিকে সারারাত যত্ন করে সে। সকালে পাখিটি মারা যায়। থার্টি ফার্স্টের আনন্দ পরদিন সকালেই শোকে পরিণত হয়।

জেরিনের মতো আরও অনেকেই থার্টি ফার্স্ট নাইট কিংবা নববর্ষ উদযাপনের আলোর ঝলকানির পেছনের এই অন্ধকারের দিকের সঙ্গে পরিচিত।

পশুপাখির আতঙ্ক, পরিবেশের ক্ষতি

কুকুরের শ্রবণশক্তি মানুষের চেয়ে চার গুণ বেশি। কুকুর ৬০ হাজার হার্জ পর্যন্ত শব্দ শুনতে পায়।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ির বাসিন্দা অন্তু দাস পেশায় ব্যাংকার। 'অ্যালেক্স' নামের স্যামোয়েড ব্রিডের একটি কুকুর পোষেন তিনি।

অন্তু বলেন, 'প্রায় ৪ বছর ধরে অ্যালেক্স আমাদের সঙ্গে থাকে। প্রতিবছর ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টার আগে থেকেই বাড়িতে-বাড়িতে আতশবাজির ফাটানোর হিড়িক পড়ে যায়। অ্যালেক্স তখন ভয়ে ছুটোছুটি করে, টেবিল বা বিছানার নিচে লুকিয়ে থাকে।'

একই কথা জানিয়েছে তরুণ উদ্যোক্তা সুদয় সাহার। একসময় পাখি পালতেন তিনি। পরে আতশবাজির বিকট শব্দে পাখির কষ্ট হয় শুনে তিনি পাখি পোষাই বন্ধ করে দিয়েছেন।

'আমি শুনেছি আতশবাজির শব্দে পাখিদেরও হার্ট অ্যাটাক হয়। আর পুরো ডিসেম্বর জুড়েই বিয়ে থেকে শুরু করে নববর্ষ, সবকিছুতে থাকে আতশবাজির আয়োজন। তাই এসময়ে পাখিগুলোকে ঘরের ভেতরে, শব্দের থেকে যতটা দূরে রাখা যায় ভালো,' বলেন তিনি।

২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আরকানাস অঞ্চলে প্রায় ৫ হাজার লাল ডানাবিশিষ্ট পাখি মারা যায় থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপনের জন্য।

মানুষেরও ক্ষতি করে আতশবাজির উদযাপন

চীনের ৩৩৫টি শহরে ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বছরের অন্যান্য দিনের তুলনায় নববর্ষে আতশবাজির ব্যবহারে বাতাসে ক্ষতিকর কণার পরিমাণ ৮৯ শতাংশ বেড়ে যায়। এছাড়া বায়ূমান সূচক ও সালফার ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ে যথাক্রমে ৫৭ শতাংশ ও ৬৯ শতাংশ।

এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরম্যাটিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, 'থার্টি ফার্স্ট নাইটে যেসব আতশবাজি ব্যবহার করা হয় সেগুলোতে প্রচুর পরিমাণে, সালফার, পটাশিয়াম নাইট্রেট, লেড ও ক্যাডমিয়ামের মতো ভারী ধাতুর পিএম ১০ ও ২.৫ কণা থাকে যা ফুসফুসের জন্য ক্ষতিকর, ক্যান্সার হওয়ারও সম্ভাবনা রাখে।'

মানুষের চুলের গড় আকার ৭০ মাইক্রোমিটার হলে পিএম ১০ এর সাত ভাগের এক ভাগ আর পিএম ২.৫ হলো তারও চার ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ এতোটাই ক্ষুদ্র যে এই কণাটি সহজেই রক্তে প্রবেশ করতে পারে। ফলে ভারী ধাতু সম্বলিত এসব কণা রক্তে প্রবেশ করলে জীবন অনেকটাই ঝুঁকিতে বলা যায়।

সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকে শিশু ও বৃদ্ধরা। তিনি বলেন, 'স্বল্প ও দীর্ঘ এই দুই মেয়াদী প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এর মধ্যে যারা হার্টের রোগী, যাদের অ্যাজমা আছে কিংবা যাদের স্ট্রোক হয়েছে তাদের জীবন আতশবাজির মুহূর্তে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের শ্বাসকষ্ট থেকে শুরু করে বুকে ব্যাথাসহ বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ দেখা দিতে পারে।'

আতশবাজির প্রচলন যেভাবে

চীনা উপকথায় 'নিয়ান' নামে এক দৈত্যের কথা পাওয়া যায়। চাইনিজ নববর্ষের আগের রাতে এক শিংবিশিষ্ট এই দৈত্য গ্রামে-গ্রামে আক্রমণ করে।

একবার নববর্ষের আগে গ্রামবাসী নিয়ানের ভয়ে পালাচ্ছিল। এমন সময় এক বৃদ্ধ ভিক্ষুক গ্রামে প্রবেশ করে। সবাই গ্রাম ছেড়ে পালালেও, রয়ে গেল বৃদ্ধ।

পরদিন গ্রামবাসী গ্রামে ফিরে বৃদ্ধকে দেখতে পেল। এছাড়াও তারা লক্ষ্য করল, তাদের বাড়িগুলোর দেয়াল লাল রঙে রাঙানো আর উঠান ও দেয়ালে কিছু বাজি পড়ে আছে।

সেখান থেকে গ্রামবাসীর ধারণা 'নিয়ান' লাল রঙ, আলো ও বাজির শব্দ ভয় পায়। এখান থেকেই অপশক্তিকে তাড়ানোর জন্য আতশবাজির ব্যবহার শুরু করে চীনারা।

খ্রিস্টপূর্ব ২ শতকে নববর্ষের সময় চীনারা ফাঁপা বাঁশের ডাটা আগুনে নিক্ষেপ করলে সেগুলো বিস্ফোরিত হতো আর এভাবেই নববর্ষ উদযাপন করতো তারা।

হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য

ভারতের বাণিজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'বিজনেস রিসার্চ ইনসাইটস' এর তথ্যমতে, ২০২২ সালে বিশ্বে আতশবাজির বাজার ছিল প্রায় ২ হাজার ৬৮৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের, যা ২০৩১ সাল নাগাদ প্রায় ৩ হাজার ৭৯২ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'রিপোর্টস অ্যান্ড ডেটা' বিশ্বের বিভিন্ন বাণিজ্য নিয়ে অর্থনৈতিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে।

আতশবাজি নিয়ে সংস্থাটি একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে ব্যবহারের দিক থেকে আতশবাজিকে রাষ্ট্রীয়, বাণিজ্যিক, ব্যক্তিগত ও অন্যান্য, এই চারটি বিভাগে ভাগ করা হয়েছে।

২০১৯ সালে রাষ্ট্রীয় খাতে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন, বাণিজ্যিক খাতে ৬০০ মিলিয়ন, ব্যক্তিগত খাতে সাড়ে ৫০০ মিলিয়ন ও অন্যান্য খাতে সাড়ে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজার ছিল আতশবাজির। ২০৩০ সাল আতশবাজির বাজার প্রায় দ্বিগুণ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

প্রতিবেদনে এই চারটি খাতকে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়া প্যাসিফিক এই তিন অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে উত্তর আমেরিকা প্রায় ৭৯০ মিলিয়ন, ইউরোপে ৭৩০ মিলিয়ন ও এশিয়ায় ৮৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজার রয়েছে।

ওয়ার্ল্ডস টপ এক্সপোর্টস ও ট্রেন্ড ইকোনমির তথ্যমতে ২০২২ সালে ১,১০০ মিলিয়ন ডলারের আতশবাজি রপ্তানি করে রপ্তানিকারকের তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে চীন। ৩১.২ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি করে জার্মানি দ্বিতীয়, ৩০.৫ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি করে নেদারল্যান্ডস তৃতীয়, ১৯.৬ ডলার রপ্তানি করে পোল্যান্ড চর্তুথ ও ১৭ মিলিয়ন ডলারের আতশবাজি রপ্তানি করে স্পেন পঞ্চম স্থানে রয়েছে।

আমদানির ক্ষেত্রে ৮০৩ মিলিয়ন ডলার খরচ করে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। পোল্যান্ড, ইতালি, যুক্তরাজ্য ও জার্মানি আতশবাজি আমদানিতে যথাক্রমে ৫৫, ৫৪, ৫৩ ও ৫৩ মিলিয়ন ডলার খরচ করে।

সারাদেশে আগুন-দুর্ঘটনা, কোটি টাকার ক্ষতি

বাংলাদেশে প্রতি বছর পুলিশের নানা বিধিনিষেধের মধ্যেও থার্টি ফার্স্ট রাতে ঢাকার আকাশ আলোকিত হয়ে যায় আতশবাজি আর ফানুসে। বিভিন্ন স্থানে আগুন লাগা ও নানা দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, ২০২২ সালের থার্টি ফাস্ট নাইটে আতশবাজি ফোটানো ও ফানুস উড়ানোর কারণে প্রায় ১০০টি স্থানে আগুনের ঘটনা ঘটে। এতে আনুমানিক ১৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ক্ষতি হয়।

আতশবাজি ফোটানো ও ফানুস উড়ানো থেকে ২০২১ সালে ১৬টি অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৪ লাখ ৫ হাজার টাকার ক্ষতি হয় এবং আতশবাজির উচ্চশব্দে তানজিম উমায়ের ওরফে মাহমুদুল হাসান নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়।

২০২০ সালে ৫০টি অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১৪ লাখ ৩৫ হাজার টাকা, ২০১৯ সালে ৭২টি অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১৪ লাখ ৪৭ হাজার টাকা এবং ২০১৮ সালে ৪২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রায় ৫৬ লাখ ৬ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে।

সবমিলিয়ে ৫ বছরে ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ৮ লাখ টাকা। এসব অগ্নিকাণ্ডে উদ্ধারকাজে ফায়ার সার্ভিস ৩ কোটি ৬৯ লাখ ৯৫ হাজার টাকার সম্পদ উদ্ধার করেছে।

Comments

The Daily Star  | English

US retailers lean on suppliers to absorb tariffs

Rather than absorbing the cost or immediately passing it on to consumers, many US apparel retailers and brands have turned to their suppliers in Bangladesh, demanding they share the pain

6h ago