বিশ্ববাজারে জ্বালানির কোনো সংকট নেই, দামও কমেছে
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), ক্রুড ওয়েল ও কয়লার দাম বাড়লেও এখন তা কমে প্রায় যুদ্ধ-পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে এগুলোর সরবরাহও পর্যাপ্ত। ডলার সংকটে বাংলাদেশ তা কিনতে পারছে না।
আজ সোমবার দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপকালে এ কথাই বলেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
তাদের ভাষ্য, ডলার সংকটে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রয়োজনীয় জ্বালানি কিনতে পারছে না। ফলে আমাদের বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদনের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা বন্ধ করে রাখতে হচ্ছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম পৌঁছেছিল টনপ্রতি সর্বোচ্চ ৩৫০ ডলারে। এখন তা কমে এসেছে ২০০ ডলারে নিচে। ইন্দোনেশিয়ান কয়লা ১৫০ ডলারের নিচে নেমে এসেছে। ক্রুড ওয়েলের দাম পৌঁছেছিল ব্যারেলপ্রতি ১২০ ডলারে, যা এখন ৭০ ডলার। আর এলএনজির দাম পৌঁছেছিল প্রতি এমএম বিটিইউ সর্বোচ্চ ৭০ ডলারে, যা এখন ১৩-১৪ ডলার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক শিক্ষক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. বদরূল ইমাম বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লা, ক্রুড অয়েল বা এলএনজির দাম এখন অনেক কমেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দাম অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তা এখন প্রায় আগের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। আর তেল, গ্যাস ও কয়লা পৃথিবীতে প্রচুর পরিমাণে আছে। এটা অ্যাভেইলেভিলিটি নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। বিষয়টি হলো চুক্তি করে বাজার থেকে সেগুলো আনা। বাজারে এগুলো আছে, এগুলো আনতে হবে। বাজারে থাকার পরেও যদি বলা হয় নেই, তাহলে সেটা যারা বলবে, তাদের দোষ। তার মানে তারা খুঁজে পাচ্ছে না বা বাজারে যেতে আগ্রহী না।'
'আমি অবশ্য এটা শুনছিলাম, প্রধানমন্ত্রী বোধহয় একটা বক্তব্য দিচ্ছিলেন এই ধরনের। তিনি মিসগাইডেড হয়েছেন। উনাকে সঠিকভাবে তথ্য দেওয়া হয়নি। উনার পক্ষে তো সবকিছুর ডেটা রাখা সম্ভব নয়। উনাকে তার অ্যাসোসিয়েটসদের ওপর নির্ভর করতে হয়। আমি বুঝি না তারা কীভাবে তাকে ভুল তথ্য দিচ্ছে', বলেন তিনি।
ডলার সংকটের কথা উল্লেখ করে এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, 'আমাদের দেশে যথেষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র আছে। সংকটটা জ্বালানির। কয়লা যে আমদানি করব, আমাদের তো সেই ডলার নেই। ডলার থাকলে তো আমি আজকে যেয়েই কয়লা কিনে আনতে পারি। আমরা ইন্দোনেশিয়ার যেখান থেকে কয়লা কিনি, তারা দিচ্ছে না কারণ আমাদের ইতোমধ্যে বকেয়া আছে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার। এটা আমরা দেই নি। এখন আমরা এটা না দিলে তো কিনতে পারব না। অ্যাভেইলেভিলিটি নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হলো আমার ডলার নেই।'
নিজেদের গ্যাস খনন করে বের করতে পারলে তো আমাদের আমদানি-নির্ভর হতে হতো না। আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা তো আমাদেরকে কমাতে হবে। এটা করতে পারলেই আমাদের সংকট কাটবে। অন্যথায় ভবিষ্যতে এই সংকট আরও বাড়বে।
'এলএনজির উচ্চমূল্য ছিল। কিন্তু এখন তো এটার দাম অনেক কমে গেছে। এখন তো এটাতে স্বস্তি দেওয়া উচিত। কিন্তু ডলার আমরা খরচ করে ফেলেছি নানা মেগা প্রকল্পে। এলএনজিতে গত ২ বছরে আমাদের অনেক খরচ হয়ে গেছে। আবার আমরা এত বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র বানিয়েছি, ২৫ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার কেন্দ্রে আমরা উৎপাদন করি তারও অর্ধেক। এখন এত বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরিতেও তো আমরা অনেক টাকা খরচ করে ফেলেছি। আমাদের বর্তমান যে পরিস্থিতি, সেটা একদিনে হয়নি। অনেক দিনের ফল এটা। যুদ্ধের কারণে এই পরিস্থিতি দ্রুত সামনে চলে এসেছে। কিন্তু এটা আসতই।'
জ্বালানি খাতের জন্য সরকারের যা করণীয় ছিল, তা করা হয়নি বলে মনে করেন অধ্যাপক ড. বদরূল ইমাম। 'নিজেদের গ্যাস খনন করে বের করতে পারলে তো আমাদের আমদানি-নির্ভর হতে হতো না। আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা তো আমাদেরকে কমাতে হবে। এটা করতে পারলেই আমাদের সংকট কাটবে। অন্যথায় ভবিষ্যতে এই সংকট আরও বাড়বে। আরও বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হচ্ছে। ১০ বছর পরে আমাদের অবস্থা কী হবে? সংকট আরও বাড়বে', যোগ করেন তিনি।
আন্তার্জতিক বাজারে জ্বালানির দাম নিম্নগামী এবং সরবরাহও পর্যাপ্ত উল্লেখ করে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) উপদেষ্টা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, 'মৌলিক বিষয় হচ্ছে আমরা এখন অর্থাভাবের শিকার। বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে ভুগছি। এর প্রভাবই জ্বালানি খাতে পড়ছে।'
তিনি বলেন, 'এরকম অবস্থায় একটা পরিবার কী করে? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয়টা রাখার জন্য অন্য খাতে ব্যয় কমায়। তখন একটা পরিবারের মধ্যে যে অভাব থাকে, সেটা সব সদস্যের সমবণ্টন হয়। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তো সরকারেও একই নীতি নেওয়া উচিত। খাদ্যের অভাব হলে যেমন মানুষ মারা যায়, তেমনি জ্বালানির অভাবে ভুগলে অর্থনীতি মারা যায়। এর ফলে অর্থনীতির চাকার গতি স্থবিরতার দিকে চলে যায়। তখন আয় কোত্থেকে আসবে? এত বড় বাজেট, টাকার সংস্থান হবে কোত্থেকে? মার্কেটে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে, মানুষ কিনতে পারবে না।'
গ্রামের মানুষ যত লোডশেডিং ভোগ করবে, গুলশান-বনানী-ধানমন্ডির মানুষকেও একই লেভেলের লোডশেডিং ভোগ করতে হবে। বরং গুলশান-বনানী-ধানমন্ডিতে আরও বেশি লোডশেডিং হওয়া দরকার।
'সরকার যে ৫ লাখ কোটি টাকা আদায় করতে চাচ্ছে কর থেকে, সেটা পাবে কোথায়? এসব বিবেচনা করে জ্বালানি নিরাপত্তা খাদ্য নিরাপত্তার মতোই গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হয়। কারণ জ্বালানি নিরাপত্তা না থাকলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না। সরকারকে এগুলো সমন্বিতভাবে ভাবতে হবে। খাদ্য খাত তো বাণিজ্যিক না। সেখানে বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা দিয়ে খাদ্য খাতকে নিরাপদ করা হয়। জ্বালানি খাতে তো উল্টো। এখান থেকে বরং বিভিন্নভাবে অর্থ আহরণ করা হচ্ছে। খাদ্যের অনুরূপে জ্বালানি খাতকে দেখে এই খাতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।'
এই মুহূর্তে ডলার সাশ্রয় করা খুব জরুরি বলে মনে করেন এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ। 'ডলার ব্যয় করার সব খাতেই প্রচন্ড রকমের কৃচ্ছ্রতাসাধন করতে হবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর ক্ষেত্রে বিদেশ ভ্রমণ কি এখন জরুরি? সেখানে তো ঠিকই পয়সা খরচ হচ্ছে। নানা অজুহাতে টাকা বিদেশে যাচ্ছে এখনো। এগুলো অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে', বলেন তিনি।
লোডশেডিংটাকে সমতার ভিত্তিতে বণ্টন করতে হবে উল্লেখ করে অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, 'সব ধরনের গ্রাহকের মাঝেই এটা সমবণ্টন করতে হবে। যেসব গ্রাহকরা ৩২ কেভি উপরে ব্যবহার করে, তারা লোডশেডিংয়ের আওতায় থাকবে না, কেপিআই ইনস্টলেশন লোডশেডিংয়ের আওতায় থাকবে না, এভাবে কাউকে সুরক্ষা দেওয়া হবে আর গ্রামের মানুষ চরম লোডশেডিংয়ের শিকার হবে, এটা তো হতে পারে না। গ্রামের মানুষ যত লোডশেডিং ভোগ করবে, গুলশান-বনানী-ধানমন্ডির মানুষকেও একই লেভেলের লোডশেডিং ভোগ করতে হবে। বরং গুলশান-বনানী-ধানমন্ডিতে আরও বেশি লোডশেডিং হওয়া দরকার। কারণ যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো, তাদের তো আইপিএসও থাকে। গ্রামের মানুষ তো আইপিএস ব্যবহার করে না। মোদ্দা কথা লোডশেডিং সমতাভিত্তিক হতে হবে।'
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম ও সরবরাহ নিয়ে একই ভাষ্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পেট্রোলিয়াম প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ম তামিমেরও। তিনি বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারে যদি জ্বালানি সরবরাহে সংকট থাকত, তাহলে তো দাম আরও বেড়ে যেত। কিন্তু দাম তো কমছে। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে আমরা কিনতে পারছি না।'
করণীয় বিষয়ে তিনি বলেন, 'এই মুহূর্তে স্বল্পমেয়াদে ১০-১৫ দিন বা ২ মাসের জন্য আমাদের তো করণীয় খুব বেশি কিছু নেই। এখন যেটা করণীয়, বিদ্যুৎ কম ব্যবহার করা, যেটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বারবার বলছেন যে বিদ্যুৎ কম ব্যবহার করেন। তাহলে চাহিদা কমবে এবং লোডশেডিংও কমবে। এটাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় করণীয়।'
আমাদের দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদনের যথেষ্ট ক্ষমতাও থাকলে জ্বালানির অভাবে তা করা যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ।
বিশ্বব্যাংক একটা সমীক্ষা করে বলেছে, আমাদের পরিত্যক্ত কয়লা প্রকল্পের যেগুলো সরকারি, সেই জায়গায় এবং জামালপুরের আরও একটি জায়গায় সোলার বসিয়ে আমাদের প্রায় ৬ হাজার মেগাওয়াটের সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।
সৌরবিদ্যুতের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক ড. ম তামিম বলেন, 'সোলার এনার্জি থেকে সাহায্য পেলে দিনের লোডশেডিং কমানো অনেক সম্ভব। এটা করতে পারলে অনেক ফুয়েল সেভিংসও হবে। এই মুহূর্তে দিনে আমাদের দুই থেকে আড়াইহাজার মেগাওয়াটের ঘাটতি আছে। আমরা যদি সোলারের মাধ্যমে ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যোগ করতে পারতাম, তাহলে এই সংকটটা থাকত না।
'সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক একটা সমীক্ষা করে বলেছে, আমাদের পরিত্যক্ত কয়লা প্রকল্পের যেগুলো সরকারি, সেই জায়গায় এবং জামালপুরের আরও একটি জায়গায় সোলার বসিয়ে আমাদের প্রায় ৬ হাজার মেগাওয়াটের সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। সৌরবিদ্যুতের ক্ষেত্রে তো জায়গা একটা বড় ইস্যু। সেক্ষেত্রে সরকারের অধিগ্রহণ করা জায়গাতেই যদি কাজটা করা যায়, তাহলে সহজেই করা যাবে। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে বেসরকাারি খাতকে এখানে অন্তর্ভুক্ত করে উৎপাদন আরও বাড়ানো যাবে। এতে করে অল্প সময়ে আমরা একটা বেটার অবস্থায় দাঁড়াতে পারব। পুরো সমস্যা হয়তো সমাধান হবে না। কিন্তু এখানকার চেয়ে ভালো অবস্থায় যেতে পারব।'
Comments