ফেনীর বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ৩ উপজেলা
ফেনীর পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়ায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার রাত থেকে পাহাড়ি ঢলের পানির চাপ বেড়ে গেছে। এতে তিন উপজেলার প্রায় সব এলাকা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে।
এছাড়া ফেনী সদর ও দাগনভূঁঞা উপজেলার চারটি ইউনিয়ন ছোট ফেনী নদীর পানিতে প্লাবিত হয়েছে।
স্থানীয়রা জানায়, গত প্রায় ৩৭ বছর পর এলাকাবাসী আবার এ ধরনের ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে।
পরশুরাম ও ফুলগাজীতে বন্যার্তদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। উদ্ধার কাজে সেনাবাহিনীর স্পিডবোট ও হেলিকপ্টার ব্যবহৃত হচ্ছে বলে আইএসপিআর জানিয়েছে।
আনন্দপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক সদস্য মোহাম্মদ সেলিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলায় প্রতিবছর পাহাড়ি ঢলের পানিতে বন্যা হলেও ১৯৮৮ সালের পর এ ধরনের ভয়াবহ বন্যা আর হয়নি। তিন উপজেলায় প্রায় প্রতিটি বাড়ি ও বসতঘরে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে।'
পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলার হাজারো মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। গ্রামীণ সব সড়ক, ফসলি মাঠ এখনো পানিতে তলিয়ে আছে। পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। পরশুরামে একজন নিখোঁজ রয়েছে বলে জানা গেছে।
ফেনী-পরশুরাম আঞ্চলিক সড়কসহ স্থানীয় সব গ্রামীণ সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বা যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
গতকাল রাত থেকে কয়েকটি ডিঙ্গি নৌকায় লোকজনকে উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় ছিল সামান্য।
আজ বুধবার বিকেল থেকে সেনাবাহিনীর ৬টি স্পিডবোট বন্যায় আটকে পড়া পরিবারগুলোকে উদ্ধার শুরু করেছে।
ফেনী জেলা প্রশাসন জানায়, জেলার ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) সদস্যরাও উদ্ধার কাজে নিয়োজিত আছেন। তাদের ৩টি স্পিডবোট কাজ করছে।
এছাড়া সেনাবাহিনীর আরও ৬টি স্পিডবোট আছে এবং চট্টগ্রাম থেকে কোস্টগার্ড সদস্যরা রওনা হয়েছে বলে জানা গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানি বিপৎসীমার প্রায় ১০০ মিলিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
জেলা প্রশাসন, পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, তিন উপজেলায় বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে ও হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
ফেনীতে গত ১ জুলাই প্রথম দফা ও ২ আগস্ট দ্বিতীয় দফা বন্যার সময় বেড়িবাঁধের ১২টি স্থানে ভাঙনের সৃষ্টি হয়। এবার তৃতীয় দফা বন্যার শুরু থেকেই বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে পানি ঢুকে তিন উপজেলার ৯০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এদিকে অনেক এলাকায় গতকাল রাত থেকে বিদ্যুৎ নেই।
পরশুরামের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফরোজা হাবিব ডেইলি স্টারকে জানান, গত কয়েকদিনের অতিবৃষ্টি এবং ভাঙনের স্থান দিয়ে উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে পৌরসভা এবং তিনটি ইউনিয়নের প্রায় ৯৫ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। হাজারো পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
তিনি আরও জানান, ফায়ার সার্ভিসের সহযোগিতায় ১০০ জনকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। ৫০০ পরিবারকে শুকনো খাবার দেওয়া হয়েছে। আরও ৫০০ প্যাকেট শুকনো খাবার এবং ৫০ টন চাল মজুদ আছে।
ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানিয়া ভূঁইয়া জানান, মুহুরী, সিলোনিয়া, কহুয়া নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে ফুলগাজী উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ছে। অনেক বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়েছে।
ফুলগাজী উপজেলায় মুহুরী, সিলোনিয়া নদীর বাধে নতুন করে ফাটল না দেখা দিলেও আগের ফাটল দিয়ে এবং বাঁধ উপচে বন্যার পানি বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত করেছে। বর্তমানে ফেনী-বিলোনিয়া আঞ্চলিক মহাসড়ক প্লাবিত হওয়ায় জেলা সদরের সঙ্গে উপজেলার সড়কপথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পরেছে।
ছাগলনাইয়া উপজেলার ৫টি ইউনিয়ন ও ছাগলনাইয়া পৌর এলাকার বেশিরভাগ এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। গ্রামীণ এলাকায় সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
ফেনীর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, উপজেলার শর্শদি, পাঁচগাছিয়া ও ফাজিলপুর ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামে বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়েছে।
দাগনভূঁঞা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, উপজেলার সিন্দুরপুর, এয়াকুবপুর ইউনিয়নের কয়েক গ্রামে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে।
টানা বৃষ্টিতে ফেনী শহরের পাড়া-মহল্লার সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। অনেক বাসাবাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহরিয়ার হাসান ডেইলি স্টারকে জানান, মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানি বিপৎসীমা অনেক উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, 'সীমান্তের ওপারে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কোনো বাঁধ কেটে দিয়েছে কিনা জানি না। তবে সীমান্ত এলাকায় নদীতে অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় এবার পানি অনেক তীব্রগতিতে বাংলাদেশের দিকে নেমে আসে। এতে এমন ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।'
জানতে চাইলে ফেনীর জেলা প্রশাসক শাহীনা আক্তার বলেন, 'বন্যা পরিস্থিতির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন কাজ করছে। পানিবন্দি মানুষ উদ্ধারে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা কাজ করছে।'
Comments