প্রশাসন ‘ম্যানেজ করেই’ সাঙ্গু নদী থেকে বালু উত্তোলন

সাঙ্গু নদী থেকে বালু উত্তোলন
সাঙ্গু নদীতে অবৈধভাবে ড্রেজিং মেশিন বসিয়ে দিনরাত বালু তোলা হচ্ছে। ছবি: মংসিং হাই মারমা/ স্টার

বান্দরবানে রুমা খালের মোহনায় তিনটি এলাকার সাঙ্গু নদীতে অবৈধভাবে ড্রেজিং মেশিন বসিয়ে দিনরাত বালু তোলা হচ্ছে। এর ফলে নদীর পানি দূষিত হওয়ায় দুর্ভোগে পড়েছে সেই এলাকায় ১০৫ পরিবার। কেননা, সাঙ্গু নদীই তাদের পানির একমাত্র উৎস।

গত শনিবার সরেজমিনে দেখা যায়, রুমা সদর ইউনিয়নের রুমা খালের মোহনায় মুন লাই পাড়া ঘাট, রুমাচর পাড়া ঘাট ও পলিকা পাড়া ঘাট থেকে অবাধে বালু তোলা হচ্ছে।

রুমা খালের মুখ ও রুমাচর পাড়ার মধ্যবর্তী সাঙ্গু নদী থেকে ২৪ হর্স ক্ষমতাসম্পন্ন পাঁচটি মেশিনে ১০ ইঞ্চি পাইপ যুক্ত করে বালু তোলা হচ্ছে।

স্থানীয়রা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, বালু তোলার কারণে পারের ফসলি জমি নদীতে বিলীন হচ্ছে। এ ছাড়াও, পানি দূষিত হয়ে তীরবর্তী মানুষদের জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

রুমাচর পাড়াবাসী উথোয়াই মং মারমা (৪০) ডেইলি স্টারকে জানান, তাদের পাড়ার নিচে ৭০টি ও উপরে ৩৫টি মিলে মোট ১০৫ পরিবারের বসবাস। এই পাড়ায় গভীর নলকূপ নেই। তারা সবাই সাঙ্গুর পানির ওপরই নির্ভরশীল।

তিনি বলেন, 'গত দুই বছর ধরে শুষ্ক মৌসুম আসলেই সাঙ্গুতে মেশিন বসিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। এ কারণে নদীর নিচের দিকে পানি ঘোলা ও ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।'

সাঙ্গু নদী থেকে বালু উত্তোলন
সাঙ্গু নদী থেকে অবৈধভাবে বালু তোলা হচ্ছে। ছবি: মংসিং হাই মারমা/ স্টার

স্থানীয়রা আরও জানান, বালু তোলার কারণে গত বর্ষায় সাঙ্গু পাড়ে ভাঙন দেখা দেয়। একসঙ্গে তিন-চারটি মেশিন দিয়ে বালু তোলার কারণে তেল মিশে নদীর পানি তৈলাক্ত হয়ে পড়ছে।

স্থানীয় বাসিন্দা চসানু মারমা (৩৬) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নদীর তীরে প্রতি বছরের মতো এবারও দুই কানি (৪০ শতক) জমিতে মটরশুঁটি, শিমসহ অন্যান্য সবজি চাষ করেছিলাম। কিন্তু নদী থেকে মেশিন দিয়ে বালু তোলায় তীর ভেঙে জমি নদীতে বিলীন হয়েছে।'

তা ছাড়া, সাঙ্গুর মাঝখানে বালু তোলার মেশিন বসানোয় নৌ চলাচলে সমস্যা হচ্ছে। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও আছে বলে জানান নৌকাচালক মুইম্রা অং মারমা।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রুমাচর-পলিকাপাড়া মুখ এলাকার সাঙ্গুর মাঝখানে বালু তোলার মেশিন বসানোয় রুমা বাজার থেকে গ্যালেঙ্গ্যা পাড়া ও বলিপাড়ার মধ্যে নৌকা চালাতে সমস্যা হচ্ছে। যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।'

সরেজমিনে ওই এলাকা কর্মরত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা ছয় জন আবু বক্কর মেম্বারের অধীনে প্রায় আট দিন ধরে বালু তোলার কাজ করছেন।

মো. আবু বক্কর রুমা উপজেলা সদর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও রুমা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।

শ্রমিক ও স্থানীয়রা জানান, আবু বক্কর ছাড়াও উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক অংচ মারমা, স্থানীয় বাসিন্দা মুরাদ, মো. মতলব, মো. দস্তগির, জুয়েল দাশ, মিল্টন মারমা, প্রণব লাল চক্রবর্তী, এ কে মালেক, শাকিলসহ কয়েকজনের সিন্ডিকেট এই বালু তোলার কাজে জড়িত।

স্থানীয়দের অভিযোগ, অবৈধভাবে বালু তোলার বিষয়টি মো. আবু বক্করকে জানাতে গেলে তিনি ক্ষমতার দাপট দেখান ও পাল্টা হুমকি দেন।

এ বিষয়ে আবু বক্কর ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি কাউকে হুমকি দিইনি। উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহারের জন্য বালু তোলা হচ্ছে।'

সাঙ্গু নদী থেকে বালু উত্তোলন
সাঙ্গু নদী থেকে অবৈধভাবে বালু তোলায় ক্ষতিগ্রস্ত নদী তীরের ফসলি জমি। ছবি: মংসিং হাই মারমা/ স্টার

এ ব্যাপারে প্রশাসনের অনুমতি নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমি প্রশাসনসহ আরও অনেককে ম্যানেজ করেই বালু তুলছি। আপনারা চাইলে প্রশাসনের সঙ্গে দেখা করতে পারেন।'

প্রশাসনের সবাইকে 'ম্যানেজ করেই' বালু তোলা হচ্ছে বলে জানান উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক অংচ মারমা।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি বয়সে ছোট এবং ছাত্রলীগের বড় দায়িত্বে আছি। এ কারণে সংগঠন চালাতে অনেক টাকা দরকার, তাই এই সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইনি। সুযোগ আসার সঙ্গে সঙ্গে কাজটা করেছি। উপজেলায় প্রশাসনসহ সবাইকে ম্যানেজ করেই বালু উত্তোলন করেছি।'

রুমা উপজেলা ভূমি অফিসের কর্মকর্তা (এসি ল্যান্ড) সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. দিদারুল আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কয়েকদিন আগে অভিযোগ পেয়ে অভিযান চালিয়ে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছিল।'

তার অফিস থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে এখনো দিনরাত বালু তোলা হচ্ছে জানানো হলে তিনি বলেন, 'এখন নির্বাচনী কাজে ব্যস্ততা আছি। আর আজকে ছুটির দিন (শনিবার)। আমাদের লোকবলও কম। তাই এই মুহূর্তে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।'

তিনি পরামর্শ দেন পরিবেশ অধিদপ্তরে জানিয়ে পরিবেশ আইনে এই বিষয়ে যেন নিয়মিত মামলা করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

বান্দরবান পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ফখর উদ্দিন চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রুমা উপজেলায় সাঙ্গু থেকে অবৈধভাবে বালু তোলার অভিযোগ পেয়েছি। তবে, নদী ও নদীর বালু এটি পরিবেশ অধিদপ্তরের আওতায় নয়। এগুলো সম্পূর্ণভাবে স্থানীয় প্রশাসনের আওতাধীন।'

তিনি আরও বলেন, 'তবু যেহেতু অভিযোগ এসেছে তাই অতি দ্রুত অভিযান পরিচালনা করে দেখব। প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জনজীবনের ক্ষতির প্রমাণ পেলে পরিবেশ আইনে দোষীদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

Comments

The Daily Star  | English
Overall situation of foreign direct investment

Net foreign direct investment hits six-year low

The flow of foreign direct investment (FDI) in Bangladesh fell to $104.33 million in the July-September quarter of fiscal year 2024-25, the lowest in at least six years, as foreign investors stayed away from Bangladesh amid deadly political unrest, labour agitation, and a persistent economic crisis.

13h ago