ক্যাশলেস লেনদেনের জন্য আর কত অপেক্ষা

গত জুনের ঘটনা। কক্সবাজারের একটি হোটেল থেকে চেকআউট করে পকেটের শেষ টাকাটাও খরচ করে ফেলেছিলেন ঢাকার সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার সানজিদ ইমরান। এরপর নির্ভার মনেই উঠে বসেন ঢাকাগামী বাসে। সানজিদের ভাষায়, 'ভেবেছিলাম, দরকার হলে পথেই টাকা তুলে নিতে পারব। অবশ্য, ঢাকায় ক্যাশ ছাড়া চলতে তেমন অসুবিধা হবে না।'
মাঝপথে বিরতির জন্য বাসটি যখন মহাসড়কের পাশে থামে, তখন সানজিদ বাস থেকে নেমে যান। হঠাৎ তার খিদে পায়। আশেপাশের দোকানগুলোর দিকে তাকান। খোঁজেন এটিএম বুথ। কোথাও বিকাশ বা নগদ এজেন্ট পাননি। কোনো কিউআর কোড স্টিকার নেই। সব দোকানেই পণ্য কেনা যায় শুধু নগদ টাকায়।
'অথচ, আমরা প্রতিনিয়ত ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলি।'
২০২৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা দিয়েছিল—২০২৭ সালের মধ্যে দেশের মোট লেনদেনের ৭৫ শতাংশ ডিজিটাল হবে। এটি ছিল উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য।
ভারতে ইউনিফাইড পেমেন্টস ইন্টারফেস (ইউপিআই) এবং চীনে আলিপে ও উইচ্যাট পে প্রবল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এমনকি ছোট অর্থনীতির ভুটান ও নেপালও ডিজিটালাইজেশনের দিকে নীরবে এগিয়ে গেছে।
কিন্তু বাংলাদেশে ডিজিটালাইজেশনের প্রক্রিয়া এখনও দুর্বল। অবকাঠামো দুর্বল, ইন্টারনেট অনির্ভরযোগ্য। ব্যাংকগুলোর অনীহা, গ্রাহকদের অবিশ্বাস ও প্রণোদনার অভাব এর মূল কারণ। দেড় বছরেরও কম সময় যেতে না যেতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সেই লক্ষ্য ক্রমশ ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে বলে মনে হয়।
'বিনিময়', 'বাংলা কিউআর' ও 'টাকাপে' উদ্যোগগুলোর উদ্দেশ্য ছিল ডিজিটাল বিপ্লবের সূচনা করা। এখন সেই প্রতিষ্ঠানগুলো আছে সতর্ক অবস্থানে।
২০২২ সালের নভেম্বরে ৬৫ কোটি টাকায় চালু হওয়া 'বিনিময়'র লক্ষ্য ভারতের ইউপিআই'র মতো এমএফএস সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকগুলোর মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন লেনদেনের প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা। সরকারের আইসিটি বিভাগের ইনোভেশন ডিজাইন অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনারশিপ একাডেমি প্রজেক্ট এটি তৈরি করে। কাগজে-কলমে সব ঠিকঠাক মনে হলেও বাস্তবে এটি গ্রাহক টানতে ব্যর্থ হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গ্রাহকের অনভিজ্ঞতা, প্রচারণার অভাব ও একীভূত হতে ব্যাংকগুলোর অনীহার কারণে "বিনিময়" ব্যর্থ হয়। ২০২৪ সালের আগস্টে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর প্রকল্পটি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যায়।'
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে চালু হওয়া 'বাংলা কিউআর' সব প্ল্যাটফর্ম ও ব্যাংকে কিউআর কোড পেমেন্টকে মানসম্মত করার চেষ্টা করেছিল। দুই বছর পরও বেশিরভাগ দোকানে এটি আর দেখা যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অপর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অনেক ব্যাংকে 'বাংলা কিউআর' চালানোর মতো ডিজিটাল অবকাঠামো নেই।'
বিকাশ ও নগদের মতো মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্রোভাইডারদের স্টিকারের আধিপত্য থাকায় সমন্বিত কোনো পদ্ধতি দাঁড়াতে পারেনি।
ভিসা ও মাস্টারকার্ডসহ আন্তর্জাতিক পেমেন্ট নেটওয়ার্কগুলোর ওপর নির্ভরতা কমাতে ২০২৩ সালে চালু হয়েছিল টাকাপে। এটি দেশীয় মুদ্রার ডেবিট কার্ড। এই ধরনের প্রথম হওয়া সত্ত্বেও মাত্র আট ব্যাংক এটি অফার করে।
দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হুসেইন খান এসব ত্রুটির কথা স্বীকার করে বলেন, 'লক্ষ্য করেছি, নানা কারণে নগদ টাকা ছাড়া লেনদেনের উদ্যোগ থেমে আছে। এ অবস্থায় আগামী ছয় মাসের মধ্যে সব ব্যাংকে বাংলা কিউআর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।'
এ ছাড়াও, কেন্দ্রীয় ব্যাংক 'বিনিময়'র পরিবর্তে নতুন আন্তঃপরিচালনযোগ্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম নিয়ে গেটস ফাউন্ডেশনের সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মোজালুপের সঙ্গে কাজ করছে।
তিনি বৃহত্তর জনসচেতনতার প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করেন। তিনি নগদ টাকা ছাড়া লেনদেনের প্রচারের জন্য সেমিনার করার পরিকল্পনার কথা জানান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন—ছোট ব্যবসার মালিক, রাস্তার বিক্রেতা বা মাঝারি আকারের খুচরা ব্যবসায়ীরা নগদ টাকায় লেনদেন করলে ভ্যাট, কর বা নজরদারিতে পড়তে হয় না। কিন্তু, ডিজিটাল মাধ্যমে সেগুলো এড়ানো যায় না।
আরিফ হুসেইন খান আরও বলেন, 'ডিজিটাল লেনদেনে কোনো প্রণোদনা নেই। আছে ভ্যাট ও কর।'
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন হলে ভ্যাট-ট্যাক্সের বিষয় থাকে। নগদ টাকায় লেনদেন হলে তা এড়ানো যায়।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র জানান, ক্যাশলেস ব্যবস্থায় যাওয়া মূল অগ্রাধিকার হিসেবে আছে। টাকা ছাপানো, পরিবহন, সংরক্ষণ ইত্যাদিতে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচ হয়। 'আমাদের ডিজিটাল লেনদেনে যাওয়া ছাড়া বিকল্প নেই,' বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী হিসাব করে দেখেছেন—নগদ টাকা পরিবহন, নিরাপত্তা ও সংরক্ষণের কাজে দেশের একটি ব্যাংককে প্রতি বছর ২৬০ কোটি টাকা খরচ করতে হয়।
অথচ, গ্রাহকদের ডিজিটাল লেনদেনে উৎসাহী করতে কর ছাড় বা ক্যাশব্যাক অফারের মতো প্রণোদনা নেই।
দেশে ১৩টি এমএফএস প্রোভাইডার কাজ করছে। এর মধ্যে বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায় এর ব্যবহার বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে—গত মে মাসে এমএফএস ক্যাশ-আউট লেনদেন ৪৪ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকায় পৌঁছে। এর আগের মাসে তা ছিল ৩৮ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা।
এমএফএস'র মাধ্যমে মার্চেন্ট পেমেন্ট হয়েছে সাত হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা, সরকার থেকে ব্যক্তি পর্যায়ে (জিটুপি) লেনদেন হয়েছে ৬৫৫ কোটি টাকা। ইউটিলিটি বিল পরিশোধের পরিমাণ তিন হাজার ৩৭২ কোটি টাকা।
এমএফএস প্ল্যাটফর্মগুলো এখন সঞ্চয়, পিয়ার-টু-পিয়ার ট্রান্সফার, বিল ও বাণিজ্যিক পেমেন্ট, মোবাইল রিচার্জ ও জিটুপি বিতরণের মতো সেবা দেয়। এতে নগদ টাকার ওপর নির্ভরতা অনেক কমেছে।
গাজীপুর সদরের বাসিন্দা ঝর্ণা পারভীন (৬০) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ছেলে নিয়মিত আমাকে বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাঠায়। কিন্তু, বিকাশের মাধ্যমে কিভাবে কেনাকাটা করতে হয় তা আমার জানা নেই। আমি টাকা হারাতে চাই না। তাই সব টাকা ক্যাশ-আউট করি।'
বিকাশের হেড অব কর্পোরেট কমিউনিকেশনস শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম জানান, তারা এই পরিস্থিতি পরিবর্তনে কাজ করছেন। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ছোট ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, নতুন ফিচার চালু করছি এবং বিকাশ ব্যবহারকারীদের শুধু ক্যাশ-আউটের অভ্যাস থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। তবে চ্যালেঞ্জ অনেক।'
ব্যাংক কর্মকর্তা ও খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন—এমএফএস'র পাশাপাশি ইন্টারনেট ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং ও ডিজিটাল ওয়ালেট ক্যাশলেস লেনদেনে অবদান রাখলেও সামগ্রিক অগ্রগতি ধীর।
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী মনে করেন, সরকারি নীতির মাধ্যমে এই রূপান্তর ঘটবে না। এর জন্য দরকার আইন।
ভারতের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন—'প্রতিবেশী দেশটিতে ডিজিটাল পেমেন্ট না থাকলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করতে পারে না। নবায়নের সময় তাদের যদি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকে, তাহলে অবশ্যই কিউআর কোডের মতো অন্তত একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম দেখাতে হবে।'
'যদি কিউআর কোড বাধ্যতামূলক হয়, তবে সেগুলো দেখাতে হবে। কিউআর কোড দেখানো হলে যারা কিউআর কোড ব্যবহার করে ডিজিটাল পদ্ধতিতে টাকা পরিশোধ করতে চান, তারা তা করতে পারবেন। এটি যদি ট্রেড লাইসেন্স ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং সব পৌরসভা ও উপজেলা এটি বাস্তবায়ন করে, তাহলে সব দোকান কিউআর কোড দেখাতে বাধ্য থাকবে।'
'আমরা যতই মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করি না কেন, এটি কাজ করবে না,' বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আরেকটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, 'আমাদের পিআই ব্যাংকিং আছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও তা ব্যবহার করতেন না। বলা হয়, এক মাসের মধ্যে চালু না করলে বেতন আটকে যাবে। এখন সবাই তা করেছেন।'
আবার ফিরে আসা যাক সানজিদ ইমরানের প্রসঙ্গে। তার মতো অনেকেই ডিজিটাল পদ্ধতিতে লেনদেন করতে চান কিন্তু বাস্তবতার কারণে চলতে হয় অ্যানালগ পদ্ধতিতে!
Comments