পাটের মোড়ক আইন শিথিলে প্লাস্টিকের দৌরাত্ম্য

পাটের ব্যাগ
খুলনার বড় বাজারে এক আড়তে প্লাস্টিক মোড়কে চাল। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

প্রায় দুই ডজন খাদ্যপণ্যের জন্য বাধ্যতামূলক পাটের মোড়ক ব্যবহারের আইনটি শিথিলতার কারণে ব্যবসায়ীরা প্রায় ভুলে যেতে বসেছে।

পাটের বিকাশ ও পরিবেশ রক্ষার এই উদ্যোগ ভেস্তে যাওয়ার আরও কারণের মধ্যে আছে মূল্যায়ন ছাড়াই খাদ্যপণ্যের মোড়ক হিসেবে পাটের বস্তার ব্যবহারের সিদ্ধান্ত। পাটের বস্তার প্রাপ্যতা ও প্লাস্টিকের তুলনায় এর দাম নিয়ে না ভেবেই হঠাৎ তা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, এই আইন বাস্তবায়নে দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছিল না।

অর্থনীতিবিদ, পরিবেশবিদ ও খাতসংশ্লিষ্টরা এখন আইনটির পূর্ণ বাস্তবায়নের পরিবর্তে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রয়োগের দাবি জানাচ্ছেন।

২০১০ সালে সরকার চাল সংরক্ষণ, সরবরাহ ও প্যাকেজিংয়ে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে।

মিল মালিকরা চাল প্যাকেজিংয়ে পাটের ব্যাগ ব্যবহার শুরু করলে পরবর্তী পাঁচ বছর পাটের বস্তার ব্যবহার বেড়ে যায়।

তবে ভারত থেকে আমদানি করা চাল প্লাস্টিকের মোড়কে আসায় দেশের অনেক মিল মালিক ও ব্যবসায়ী আবার প্লাস্টিকের ব্যাগের দিকে ঝুঁকে পড়েন।

চাল, গম, ভুট্টা, ডাল, আটাসহ ১৯ নিত্যপণ্যে পাটের ব্যাগের ব্যবহার নিশ্চিত করতে 'পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন, ২০১০' প্রণয়ন করা হয়।

২০১৭ সালে রান্নার অন্যান্য পণ্য যেমন মরিচ, হলুদ, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, ধনেপাতা ও আলু প্যাকেজিংয়ে পাটের মোড়ক ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়। ২০১৮ সালে পাটের মোড়ক ব্যবহারের আওতায় পণ্যের সংখ্যা বাড়িয়ে পোল্ট্রি ও ফিশ ফিড যোগ করা হয়।

আইন অমান্য করলে এক বছরের কারাদণ্ড, সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান আছে।

ব্যবসায়ীরা প্লাস্টিক ব্যাগের পরিবেশ দূষণের কথা স্বীকার করলেও স্থানীয় চাহিদা মেটানোর মতো পর্যাপ্ত পাটের ব্যাগ আছে কিনা তা নিয়ে সংশয়ে আছেন। এ ছাড়া, পাটের বস্তা দ্রুত আর্দ্রতা শুষে নেয় বলে কিছু খাদ্যপণ্যে পাটের মোড়ক বাধ্যতামূলক করার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।

বাংলাদেশ পাটকল সমিতির মহাসচিব আব্দুল বারিক খান এই আইন প্রয়োগের অভাবের সমালোচনা করে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্লাস্টিকের কারণে পরিবেশের ক্ষতি সম্পর্কে জানলেও এই আইন প্রয়োগে অতীতের সরকারের পক্ষ থেকে জোর দেওয়া হয়নি।'

তিনি মনে করেন, আইনটির যথাযথ বাস্তবায়ন পাট শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে। লাখ লাখ পাট চাষির পাশাপাশি পরিবেশের উপকার হবে।

তিনি আরও বলেন, 'সরকারের উচিত সব চালকলে পাটের ব্যাগ বাধ্যতামূলক করা। তা না মানলে কলগুলোর নিবন্ধন বাতিল ও মালিকদের জরিমানার ব্যবস্থা করা।'

এরই মধ্যে এক শীর্ষ খাদ্য আমদানি ও প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠানের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশের পাটের বস্তার চাহিদা মেটানোর সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

তার ভাষ্য, কম খরচ ও স্থায়িত্বের কারণে প্লাস্টিকের প্যাকেজিং এখনো বিকল্প হিসাবে রয়ে গেছে।

২০১২ সালে হাইকোর্টে রিট করা হয়। আদালত স্থগিতাদেশ দিয়ে প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার চলমান রাখার অনুমতি দেয়।

সম্প্রতি ঢাকার মিরপুর, মোহাম্মদপুর ও কারওয়ান বাজারসহ কয়েকটি কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, চালের মোড়কে প্লাস্টিকের বস্তা ব্যাপকহারে ব্যবহার করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে এম খোরশেদ আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বর্তমানে কিছু ব্যবসায়ী পাটের বস্তা ব্যবহার করছেন। বিগত সরকার আইনটি বাস্তবায়নে কঠোর উদ্যোগ নেয়নি।'

আকিজ, এসিআই ও রশিদ এগ্রো ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডসহ স্থানীয় বড় শিল্পগোষ্ঠীর চালের মোড়কে পাটের ব্যবহার সম্পর্কে জানতে ডেইলি স্টার থেকে যোগাযোগ করা হলেও এ বিষয়ে তাদের মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুর রউফ স্বীকার করেছেন যে গত এক দশকে আইনটির প্রয়োগ হয়নি। বৃহত্তর রাজনৈতিক স্বার্থে পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে বলে আশা করেন তিনি।

তিনি জানান, সুপারশপ থেকে এখন চেষ্টা চলছে। গত মঙ্গলবার পাট খাতের অংশীদারদের সঙ্গে বৈঠকে চাহিদা মেটাতে দ্রুত পাটের ব্যাগ সরবরাহের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

গত রোববার পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এক অনুষ্ঠানে বলেন, 'আইন প্রয়োগের মাধ্যমে পাটের ব্যাপক ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হবে।'

তিনি আরও বলেন, 'পাটপণ্যের ব্যবহার বাড়াতে আমাদের মন্ত্রণালয় ব্যবসায়ীদের সব ধরনের নীতি সহায়তা দেবে।'

একই অনুষ্ঠানে বস্ত্র ও পাট উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, 'প্রথমে ধান, চাল ও গমে পাটের বস্তা ব্যবহার নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।'

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, 'প্রয়োগে দুর্বলতার কারণে বিগত সরকার আইনটির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে পারেনি।'

তবে দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা কাজ করছেন উল্লেখ করে তিনি আশা করেন, 'এই আইন পুরোপুরি বাস্তবায়নে পরিবেশ উপদেষ্টা যথাযথ উদ্যোগ নেবেন।'

'দেশের পাটকলগুলোর সম্ভবত চাহিদা মেটানোর সক্ষমতা নেই। এজন্য আইনটি বাস্তবায়নের আগে আমাদের যথেষ্ট প্রস্তুতি নিতে হবে,' বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তার মতে, আইনটি সব পণ্যের ক্ষেত্রে পূর্ণ বাস্তবায়নের পরিবর্তে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা গেলে তা সহজ হবে।

Comments

The Daily Star  | English

Teknaf customs in limbo as 19 mt of rice, authorised by AA, reaches port

The consignment of rice weighing 19 metric tonnes arrived at Teknaf land port on Tuesday evening with the documents sealed and signed by the Arakan Army

7h ago