শূন্য থেকে ‘সম্পদের পাহাড়’
একটা সময় ছিল, এখনো আছে হয়ত—কাউকে 'শাস্তি' দিতে চাইলে বলা হতো—'আপনাকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বদলি করা হচ্ছে।'
১৯৯০ এর দশকে এক বাংলা চলচ্চিত্রেও এমন সংলাপ শোনা গিয়েছিল। তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানকে 'দুর্গম' ও সেখানে কাউকে বদলি করাকে 'বনবাসে পাঠানো'র মতো গণ্য করা হতো।
জনশ্রুতি আছে—সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের 'শাস্তি' হিসেবে এসব জেলায় পাঠানো হতো। চাকরির শুরুতে কাউকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাঠানো হলে তা 'নেতিবাচক' হিসেবে দেখা হতো।
তবে অতীতের 'পিছিয়ে থাকা' পার্বত্য চট্টগ্রাম এখন শিক্ষা, অর্থনীতি ও সামাজিক অগ্রগতির আলোকবর্তিকা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এক সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে হাজার হাজার একর পাহাড়ি জমি অনাবাদি ছিল। এখন সেসব জমিতে ফলছে নানা জাতের ফসল, ফলমূল এমনকি, দামি মসলাও।
ইতিহাস বলছে—কয়েকশ বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি উপত্যকা ও এর মধ্যে সামান্য যে পরিমাণ সমভূমি আছে সেখানে ধান, চা ও তৈলবীজ চাষ করা হতো। মুঘল আমলে কার্পাস তুলার দেশ বা 'কার্পাস মহল' হিসেবে এই অঞ্চলের সুনাম ছিল।
সময়ের পরিক্রমায় বদলে গেছে অনেক কিছু। বদলে গেছে চাষাবাদের পদ্ধতিও। অতীতে এই অঞ্চলে জুম চাষই ছিল একমাত্র উপায়। যদিও ঐতিহ্য হিসেবে তা এখনো রয়ে গেছে। তবে তা এখন আর জীবন ধারণের একমাত্র ব্যবস্থা নয়।
এখন এই অঞ্চলটি সারা বছর কাজু বাদাম, কফি, আনারস, আম, কাঁঠাল, কলা, কমলা, পেয়ারা, ড্রাগন ফল, স্ট্রবেরি, লেবু, পেঁপে, আতা, বেল, আদা ও হলুদসহ সব ধরনের ফসলে সমৃদ্ধ।
এখানে উৎপাদিত অধিকাংশ শাকসবজি অরগানিক। কেননা, মাটি প্রাকৃতিকভাবে বেশ ঊর্বর থাকায় রাসায়নিক সার ছাড়াই প্রচুর ফলন হয়। বর্তমানে পাহাড়ে ফল চাষও হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় এখন দেশের মোট ফলের প্রায় ২০ শতাংশ উৎপাদিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। এটি আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের সুফল।
পার্বত্য চট্টগ্রামে এক সময় বিরল দৃশ্য ছিল—আধুনিক সেচ ব্যবস্থার সঙ্গে পাম্প, পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর ও উন্নত জাতের বীজের মেলবন্ধন। ঐতিহ্যবাহী চাষের পরিবর্তে আধুনিক পদ্ধতি জায়গা করে নিয়েছে।
খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক মোহাম্মদ বসিরুল আলম দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, এখানে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ চার হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে আম চাষ করছেন।
অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, এ বছর খাগড়াছড়িতে প্রায় ৪৯ হাজার টন আম উৎপাদন হবে। এখানে বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকার আম উৎপাদন হয়।
খাগড়াছড়িতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের পার্বত্য কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং 'কাজু বাদাম ও কফি গবেষণা প্রকল্পের' প্রকল্প পরিচালক মো. আলতাফ হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ও উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা থাকায় গত ১৫ বছরে তিন পার্বত্য জেলায় ফলের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।'
তিনি জানান, এক সময় রাজশাহী থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আম আনা হতো। কিন্তু এই তিন জেলা এখন আমের চাহিদার ২০ শতাংশের বেশি পূরণ করছে।
যদিও ঠিক কোন সময় এমন পরিবর্তন শুরু হয়েছিল তা সুনির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তবে ২০০৮ সালে এই অঞ্চলে মোবাইল নেটওয়ার্ক আসায় নিঃসন্দেহে তা ব্যাপক অবদান রেখেছে।
২০০৯ সাল থেকে সড়ক ও সেতু প্রশস্তকরণসহ বেশকিছু অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের কল্যাণে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ে যোগাযোগ বেড়েছে। আরেকটি প্রধান ভূমিকা রেখেছিল জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডের সঙ্গে এসব জেলার সংযোগ।
এ ধরনের সাহসী উদ্যোগ শিক্ষিত তরুণদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনে। তারা বিনিয়োগ থেকে মুনাফা পেতে শুরু করে। সেই সাফল্য দেখে পরবর্তী প্রজন্ম কৃষিতে বিনিয়োগে উৎসাহিত হয়।
যেমন, খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার শান্তিপুর গ্রামের বাসিন্দা ও পানছড়ি ফল বাগান মালিক সমিতির সভাপতি দেবাশীষ চাকমার কথাই ধরা যাক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শেষ করে প্রায় ১০ বছর কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছিলেন তিনি।
২০১২ সালে সঞ্চয়ের টাকায় পরিবারের ১৫ একর জমিতে আম, কমলালেবু ও পেয়ারার বাগান করেন।
দেবাশীষ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মুনাফা পাওয়ার পর চাকরি ছেড়ে পুরোদস্তুর কৃষি উদ্যোক্তা হয়ে উঠি।'
তিনি জানান, বছরে আয় প্রায় ২৫ লাখ টাকা। তার বাগানে সারা বছর অন্তত ১০ জন কাজ করেন। জেলায় এক হাজারেরও বেশি উচ্চশিক্ষিত কৃষি ব্যবসায়ী আছেন। তারা অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছেন।
দেবাশীষের বিশ্বাস, 'এই উদ্যোক্তারা তাদের মূলধন বাড়ানো পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্থনীতিতে পরিবর্তন আনবেন। এটি এখানে কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করবে।'
তিনি আরও বলেন, 'আধুনিক প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের জন্য কৃষিকে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক করে তুলেছে। এমনকি, উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিরাও ব্যবসায় তাদের প্রতিভা খাটাচ্ছেন।'
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এলএলবি পাস করা প্রু নুয়ে মং আইন পেশায় না গিয়ে কৃষি উদ্যোক্তা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি শৈশব থেকেই কৃষির প্রতি আগ্রহী ছিলেন, কারণ কৃষিকাজ ছিল তার পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস।
তবে তার পরিবার প্রযুক্তি বা আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি ব্যবহার করবে না বলেও জানান তিনি। বলেন, 'আমি মনে করি, পার্বত্য এলাকার কৃষি খাতের উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে। এটি দেশের মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনতে পারে।'
তার মতে, কৃষিতে বিনিয়োগ করলে টাকা দ্রুত তুলে আনা যায়।
মং সামান্য কিছু টাকা বিনিয়োগ করে পর্যায়ক্রমে বান্দরবান সদর উপজেলার কুহালং ইউনিয়নের কুহালং হেডম্যান পাড়ায় ২৮০ শতক এলাকায় ফলের বাগান গড়ে তুলেছেন।
'এক দশক আগেও ম্যান্ডারিন কমলালেবু, পেয়ারা ও ড্রাগন ফলের চাষ করেছি। গত ছয় বছর ধরে বছরে অন্তত আট লাখ টাকা আয় করেছি,' যোগ করেন এই উদ্যোক্তা।
Comments