অর্থনীতির ভুল নীতি ও দুর্বল পরিকল্পনার মাশুল দিচ্ছে দেশ
পদ্মা সেতু ও ঢাকায় মেট্রোরেল চালু এবং শতভাগ বিদ্যুতায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির উদযাপনের বছর হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সাল।
বছরের প্রথমার্ধে দেখা গেছে, সবকিছু পরিকল্পনামাফিকই চলছিল। বিশেষ করে রপ্তানি বাড়ছিল। তারপর মারফির সূত্র অনুসারে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যা যা ভুল হওয়ার ছিল, তার সবই হয়েছে।
করোনা মহামারির সবচেয়ে খারাপ সময়েও দেশের অর্থনীতিকে শক্ত রেখেছিল যে রেমিট্যান্স, সেটা এই বছর কমেছে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমেছে শ্বাসরুদ্ধকর গতিতে। বছরের শুরু থেকেই আলোচনা ছিল যে, দেশের রিজার্ভের যে পরিমাণের কথা বলা হচ্ছে, আসলেই তা পর্যাপ্ত কি না। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল তা পর্যাপ্ত ছিল না।
রিজার্ভ ক্ষয় রোধ করতে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। ফলাফল হিসেবে যা দাঁড়িয়েছে তা হলো- জ্বালানির জন্য কারখানা মালিকদের হাহাকার এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিহীনতা।
এর কারণে দেশের খেলাপি ঋণ একটি নতুন রেকর্ড ছুঁয়েছে। নগদ অর্থের অভাবে চাপে পড়েছে দেশের ব্যাংকগুলো।
স্মরণকালের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতিতে মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে, সংসারের খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ।
এমন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই কমে গেছে রাজস্ব আদায়। যার ফলে, কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি গ্রহণের পাশাপাশি বাজেট সহায়তার জন্য সব উন্নয়ন সহযোগীদের দরজায় কড়া নেড়েছে সরকার।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, ২০২২ সালে নীতিনির্ধারকদের ভুল নীতি, দুর্বল পরিকল্পনা, নিষ্ক্রিয়তা ও অবহেলার কারণে অর্থনৈতিক অবস্থার চরম পরিণতি দেখেছে বাংলাদেশ।
২ বছর ধরে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারির প্রকোপ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলস্বরূপ অর্থনীতির এমন অবস্থা— এ কথা বলে সহজেই সব দায় কাটিয়ে দেওয়া যেতেই পারে। তবে আসলে এর সবই এসেছে অতীতের ভুলের সূত্র ধরেই।
বাংলাদেশ ব্যাংক যদি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট এবং ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম৬) অনুসারে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গণনা করতো, যা পৃথিবীর বাকি সব দেশ অনুসরণ করে, তাহলে কি রিজার্ভ সম্পর্কে ভুল আস্থা তৈরি হতো?
কয়েক বছর আগে যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিনিময় হার সুরক্ষায় তার নীতি পরিত্যাগ করতো, তাহলে কি রিজার্ভ এত অল্প সময়ের মধ্যে কমে যেত?
তেমনটি করা হলে, টাকার মান এই বছর যে পরিমাণ কমেছে, ততটা কমতো না। এমনকি, এত বেশি পরিমাণে রেমিট্যান্স অবৈধ পথে আসার মতো ঘটনাও ঘটত না।
মহামারির প্রকোপ কমতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে সরকার যদি ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে কার্যকর করা সুদের হারের সীমা প্রত্যাহার করে নিতো, তাহলে মুদ্রাস্ফীতি কি এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছাতো?
সরকার যদি আরও আগে জ্বালানি ভর্তুকি বন্ধ করে স্বয়ংক্রিয় জ্বালানির মূল্য নির্ধারণ শুরু করতো, তাহলে কি এখন মানুষের জীবনযাত্রায় সংকট তৈরি হতো? গত ৫ আগস্ট হঠাৎ করেই জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ধাক্কা মানুষের ওপর এতটা পড়ত না।
যদি ভর্তুকির বোঝা ও ব্যয় এত বেশি না হতো এবং কর রাজস্ব দীর্ঘসময় ধরে এত কম না হতো, তাহলে কি সরকারকে উন্নয়ন অংশীদারদের কাছ থেকে বাজেট সহায়তা হিসেবে ঋণ নিতে হতো?
সরকার যদি আন্তরিকতার সঙ্গে গ্যাস অনুসন্ধান করতো, তাহলে দেশের কারখানাগুলো এখন গ্যাসের অভাবে বসে থাকতো না।
সরকার যদি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে আরও কঠোর হতো এবং বিদ্যুতায়নের লক্ষ্য অর্জনে আরও কৌশলী হতো, তাহলে কি ক্যাপাসিটি চার্জের এত বড় বোঝা বইতে হতো?
শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দেওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরেই সারাদেশ কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুতহীন ছিল। ফলে, এই অর্জনটিও পড়েছে প্রশ্নের মুখে।
ব্যাংকিং খাত, কর প্রশাসন এবং প্রকল্প নির্বাচন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের শিথিল অবস্থানের কথা অনেক আগে থেকেই বলা হচ্ছে।
কিন্তু সে বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে ব্যাংকিং খাত ক্রমাগত খেলাপি ঋণে জর্জরিত, কর থেকে রাজস্ব জিডিপি বিশ্বের সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে এবং প্রকল্প ব্যয় ও সময়সীমা ক্রমাগত বাড়ছে।
যদি এসব সমস্যা সমাধান করা যেতো, তাহলে এমন কৃচ্ছ্রসাধনের কোনো প্রয়োজনই হয়তো হতো না।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, চলতি বছরে অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ছিল অনেক। কিন্তু সরকারের কাছে এখন আইএমএফের কর্মসূচির মাধ্যমে সেগুলো সংশোধনের সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশকে ৪২ মাসের মধ্যে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনভিত্তিক বহুপাক্ষিক ঋণদাতা সংস্থাটি প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কারের জন্য বেশ কিছু শর্ত দিচ্ছে।
সরকার আন্তরিকভাবে আইএমএফের শর্ত মেনে চলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। জানুয়ারিতে চূড়ান্ত হতে যাওয়া এসব শর্তের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে৷
ইতোমধ্যেই গ্লোবাল রেটিং এজেন্সি মুডি'স বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের ক্রেডিট রেটিং কমানোর প্রস্তুতি নিয়েছে।
বাংলাদেশের রেটিং কমানোর পাশাপাশি মুডি'স ৭টি ব্যাংকের রেটিং পর্যালোচনার করছে।
মুডি'স যদি বাংলাদেশের রেটিং কমিয়ে দেয় তাহলে অপর ২টি প্রধান ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি ফিচ ও স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর একই কাজ করবে।
তেমন কিছু হলে বাংলাদেশের বৈদেশিক লেনদেন ও ঋণ পাওয়ার পদ্ধতি মৌলিকভাবে আরও খারাপ হবে।
একটি দেশের অর্থনীতি একবার মুখ থুবড়ে পড়লে তা উঠে আসতে সময় লেগে যায় কয়েক বছর, এমনকি পুরো দশকও। এক কথায়, দেশ পিছিয়ে যেতে পারে কয়েক দশক। যেকোনো মূল্যে এটা এড়ানো উচিত।
Comments