‘ব্যাপক দুর্নীতিই ছিল নিয়ম, ব্যতিক্রম নয়’

দুর্নীতি
সেলিম জাহান। ছবি: সংগৃহীত

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থনৈতিকনীতি সব সময় সমতার ওপর ভিত্তি করে চলেনি। বরং সরকারের নীতি ও উদ্যোগে ছিল শহুরে-বিত্তশালীদের প্রতি মারাত্মক পক্ষপাতিত্ব। এটি বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ সেলিম জাহান।

ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন অফিস ও দারিদ্র্য বিভাগের সাবেক পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক সেলিম জাহান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ধনীরা অনেক সুবিধা পেয়েছে। কম আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য ছিল নিম্নমানের সেবা।'

তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের চ্যালেঞ্জ নিয়েও কথা বলেন। এসব বাধা দূর করতে তিনি পাঁচ দফা কর্মকৌশলও তুলে ধরেন।

তার মতে, গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের নীতির তিনটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রথমটি হলো—অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ও নিয়ম-কানুন লঙ্ঘন।

'কোনো বস্তুনিষ্ঠ যাচাই ছাড়াই মেগা প্রকল্পগুলো ইচ্ছামতো নেওয়া হয়েছে,' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'দ্বিতীয়ত—স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার কাঠামো ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এসবের অভাবে অর্থনৈতিক কাঠামোর সর্বস্তরে ব্যাপক দুর্নীতি নিয়মে পরিণত হয়েছে, ব্যতিক্রম নয়।'

'এটি কেবল সম্পদ চুরির বিষয়টিই তুলে ধরে না, সমাজের মূল্যবোধকেও ধ্বংস করে।'

'তৃতীয় বিষয় হলো—অধিকাংশ সময় প্রয়োজন অনুযায়ী কর্মসূচি এবং প্রকল্পের যথাযথ ও বস্তুনিষ্ঠ পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করা হয়নি।'

সুতরাং, অর্থনৈতিক বিষয়ে সিদ্ধান্তগুলো অনেক সময় অস্থায়ী ছিল। এতে জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হতো না। এগুলো মূলত আমলারা নিতেন। সবার অংশগ্রহণ ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে এগুলো ছিল টপ টু ডাউন, বটম টু আপ নয়।

পরিকল্পনা কমিশনের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করা সেলিম জাহান জানান—তথ্য, মূল্যায়ন ও বাস্তবতার ভিত্তিতে কৌশল নেওয়া হয়নি। কখনো কখনো কৌশল নেওয়া হয়েছে ধারণার ভিত্তিতে।

অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থাকে এড়িয়ে গেছে আওয়ামী লীগ

সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থনৈতিক নীতিগুলো ধনীদের সুবিধা দিয়েছে। ঋণখেলাপি, কর ফাঁকি ও দুর্নীতির মাধ্যমে তাদেরকে সম্পদ বাড়ানোর সুযোগ দিয়েছিল।

সেলিম জাহান বলেন, 'রাষ্ট্রযন্ত্র এবং ব্যবসায়ী ও ধনীদের একটি অংশ জবাবদিহিতা ছাড়াই জনসাধারণের সম্পদ চুরি করেছে। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধানকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।'

গণতন্ত্রের প্রতি পূর্ববর্তী সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে এই অর্থনীতিবিদের ভাষ্য, 'গণতন্ত্র ও উন্নয়নকে আলাদা করে দেখার কিছু নেই।'

তিনি বলেন, 'গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত মূল্য আছে। উন্নয়নের ওপর এর প্রভাব আছে। সরকার দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর জোর দিয়ে কর্তৃত্ববাদী শাসনকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।'

তার মতে, গণতন্ত্র স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই উন্নয়নকে উৎসাহিত করে।

'বাংলাদেশকে অবশ্যই গণতন্ত্র ও উন্নয়নের পথে হাঁটতে হবে। উন্নয়নের স্বার্থে গণতন্ত্রকে বিপর্যস্ত করার ধারণা গণমানুষের স্বার্থবিরোধী।'

প্রকৃত উন্নয়ন বিকশিত হয় অংশগ্রহণমূলক ও গণতান্ত্রিক কাঠামোর মাধ্যমে।

বাংলাদেশের আকর্ষণীয় জিডিপি প্রবৃদ্ধি পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারেনি। বিশেষ করে, শিক্ষিত তরুণদের জন্য। অর্থনীতি ছয় শতাংশ হারে বাড়লেও এই প্রবৃদ্ধি যথার্থ ছিল না।

'পুঁজিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো তরুণদের কাজের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে। ফলে বেকারত্ব বেড়েছে। সাধারণ মানুষের কাছে প্রবৃদ্ধি অর্থহীন হয়ে পড়েছে।'

পূর্ববর্তী সরকার অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশগতভাবে টেকসই প্রবৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষা করে উচ্চ প্রবৃদ্ধির হারকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। ফলে অর্থনৈতিক সুবিধা সবাই পাননি। আর্থিক প্রবৃদ্ধি প্রায়শই দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাঠামো ও পরিবেশগত উদ্বেগকে উপেক্ষা করেছে।

তিনি 'উন্নয়ন'র সঙ্গে 'অগ্রগতি'র তুলনা করে বলেন, 'বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করলেও গুণগত উন্নয়নকে উপেক্ষা করেছে।'

অব্যাহত বৈষম্য

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি, এর চ্যালেঞ্জ ও টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ প্রসঙ্গে সেলিম জাহান বলেন, '১৯৭১ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে ২০২৩ সালে ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির দিকে বাংলাদেশের যাত্রা ছিল উল্লেখযোগ্য।'

১৯৯১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি গড়ে প্রায় ছয় শতাংশ হলেও দেশের অর্থনীতি বেড়েছে ১৩ গুণ। প্রায় ৩৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ৪৪৭ বিলিয়ন ডলারের মতো হয়েছে।

দারিদ্র্যের হার ১৯৯০ সালের ৫৮ শতাংশ থেকে ২০২৩ সালে ১৯ শতাংশে নেমে এসেছে। এই প্রবৃদ্ধি স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অবকাঠামোগত অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করেছে। গড় আয়ু ৫৮ বছর থেকে ৭৩ বছর ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার ৯৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

সেলিম জাহান আরও বলেন, 'মানব উন্নয়ন সূচকেও বাংলাদেশ প্রতিবেশীদের ছাড়িয়ে গেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৯ সালে প্রতি হাজারে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুর হার দাঁড়িয়েছে ৩১ জনে। ভারতে ৩৪ ও পাকিস্তানে ৬৭ জন।'

উপরন্তু, বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন সূচকের মান ১৯৯০ সালের শূন্য দশমিক ৩৯৪ থেকে বেড়ে ২০১৯ সালে শূন্য দশমিক ৬৬১ এ দাঁড়িয়েছে। ২০১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা পায়। ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় আসার কথা আছে।

সেলিম জাহানের মতে, এই সাফল্যের পাশাপাশি বঞ্চনাও অনেক। ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রায় তিন কোটি ১০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেছে। অনেকে নিরাপদ খাবার পানি ও স্বাস্থ্যের মতো প্রয়োজনীয় সেবা যথাযথভাবে পাননি।

তিনি বলেন, 'শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আয়ের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ব্যবধানসহ অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে গেছে। যেমন, ২০২৩ সালে দরিদ্রতম পঞ্চমাংশে পাঁচ বছরের কম বয়সী মৃত্যুর হার ছিল প্রতি হাজারে ৪৯ জন। এটি সবচেয়ে ধনী পঞ্চমাংশের দ্বিগুণেরও বেশি।'

'লিঙ্গ ও আঞ্চলিক বৈষম্যও আছে। গ্রামের মানুষ শহরের বাসিন্দাদের তুলনায় বেশি দরিদ্র।'

দেশে আয় বৈষম্য অনেক অনেক বেড়েছে। জনসংখ্যার শীর্ষ ১০ শতাংশ জাতীয় আয়ের ৩৮ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। নিচের ৪০ শতাংশের হাতে আছে জাতীয় আয়ের মাত্র ১৭ শতাংশ।

তিনি এই বৈষম্যের তিনটি প্রাথমিক কারণ চিহ্নিত করে বলেন, 'শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের অসম সুযোগ, নীতিগতভাবে পক্ষপাত ও ধনীদের হাতে নিয়ন্ত্রণহীন সম্পদ।'

সরকারি, অভিজাত বেসরকারি ও মাদ্রাসা—এই তিন স্বতন্ত্র শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের দক্ষতায় প্রভাব ফেলেছে। এটি বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

পাঁচ দফা কৌশল

সেলিম জাহান বলেন, 'রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকার উচ্চ মূল্যস্ফীতি, শিল্প উৎপাদন কমানো ও ধুঁকতে থাকা ব্যাংকিং খাতসহ বেশকিছু অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়েছে।'

যদিও সরকার মুদ্রানীতি কঠোর করেছে, বিনিময় হার স্থিতিশীল করার পাশাপাশি রেমিট্যান্স বাড়িয়েছে, তবুও সমস্যার কার্যকর সমাধানের জন্য এর পেছনের কারণগুলো বোঝা দরকার বলে মনে করেন তিনি।

তার ভাষ্য, মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় আর্থিক কঠোরতার তুলনায় বেশি প্রয়োজন কাঠামোগত সমাধান। এখানে পণ্য সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে কাজ করে সিন্ডিকেট।

একযোগে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের পক্ষে মত দিয়ে এই অর্থনীতিবিদ তাত্ক্ষণিক, স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী সংস্কারের জন্য পর্যায়ক্রমে ও অগ্রাধিকারমূলক পদ্ধতির সুপারিশ করেছেন।

তার মতে, কায়েমি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলো ও বর্তমান সংকট মোকাবিলায় সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার ওপর সার্বিক সাফল্য নির্ভর করে।

তিনি বৈষম্য দূর করতে ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জনে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য পাঁচ দফা কৌশল প্রস্তাব করেছেন।

প্রথমত, ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা নির্ধারণে অতীতের নীতিগুলোর যথাযথ মূল্যায়ন।

দ্বিতীয়ত, জাতীয় সংলাপে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করতে হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য সম্মিলিত দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে।

তৃতীয়ত, তিন বছর মেয়াদি পরিকল্পনায় কম আয়ের মানুষদের কাজের সুযোগ হয় এমন খাতগুলোর প্রবৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দেওয়া।

সেলিম জাহান বলেন, 'দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট ক্ষেত্র ও গোষ্ঠীর তথ্যের ওপর জোর দিয়ে কৌশল করা প্রয়োজন।'

দরিদ্র মানুষের সহায়তার জন্য সমন্বিত সামাজিক সুরক্ষা কৌশল প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English
NCP will not accept delay in Teesta master plan

Won’t accept any implementation delay: Nahid

National Citizen Party Convener Nahid Islam yesterday said his party would not accept any delay or political maneuver over implementing the Teesta master plan.

8h ago