ইভ্যালি থেকে অর্থ পাচার, তদন্তের সুপারিশ পরিচালনা পর্ষদের

ইভ্যালির ব্যাংক হিসাব থেকে তোলা গ্রাহকদের বিপুল পরিমাণ অর্থের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। এই টাকার সন্ধানে আদালত নিযুক্ত পরিচালনা পর্ষদ ইভ্যালির বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের তদন্ত করার সুপারিশ করেছে।

ইভ্যালির ব্যাংক হিসাব থেকে তোলা গ্রাহকদের বিপুল পরিমাণ অর্থের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। এই টাকার সন্ধানে আদালত নিযুক্ত পরিচালনা পর্ষদ ইভ্যালির বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের তদন্ত করার সুপারিশ করেছে।

আদালতে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে ৫ সদস্যের পর্ষদ বলেছে, ব্যাংক থেকে দৈনিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানটি যে বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ উত্তোলন করেছে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই টাকা কোথায় গেছে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি ফার্ম হোদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং পরিচালিত অডিট রিপোর্টের ভিত্তিতে এই সুপারিশ করা হয়েছে।

গত ২১ সেপ্টেম্বর ৫ সদস্যের পর্ষদ ৪ হাজার পাতার অডিট রিপোর্টের পাশাপাশি তাদের পদত্যাগ ও কোম্পানির নিজস্ব প্রতিবেদন জমা দেয়। দ্য ডেইলি স্টারের কাছে অডিট রিপোর্ট ও বোর্ডের রিপোর্টের একটি অনুলিপি রয়েছে।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিপুল পরিমাণ অর্থের হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। যার ফলে অর্থ পাচারের বিষয়ে সুস্পষ্ট প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, যা সরকারি তদন্তের বিষয়।

উদাহরণস্বরূপ, অডিটে দেখা গেছে, ইভ্যালির কর্মীরা মোট ৭৯ কোটি ১০ লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন। অনেকে বার বার নগদ অর্থ উত্তোলন করেছেন। প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের তালিকা থেকে তাদের মধ্যে ৪ জনের নাম চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে।

অডিটে বলা হয়েছে, নগদ উত্তোলন করা এই অর্থ কোম্পানির প্রয়োজনেই উত্তোলন করা হয়েছে, এর সত্যতা যাচাই করা যায়নি।

১ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন নিয়ে ২০১৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু করে ইভ্যালি। তবে, প্রতিষ্ঠানটির প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (সিএফও) ছিল না বা কোনো হিসাব-নিকাশ বিধি অনুসরণ করা হয়নি বলে অডিটে উল্লেখ করা হয়েছে।

মোহাম্মদ রাসেল তার স্ত্রী শামীমা নাসরিনের সঙ্গে ইভ্যালি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও সিএফও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন রাসেল। প্রতিষ্ঠানের ভারসাম্যের জন্য সিএফও ও সিইও একই ব্যক্তি হতে পারেন না।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইভ্যালি একটি পারিবারিক সংস্থা, যা স্বামী ও স্ত্রীর দ্বারা গঠিত এবং এর পরিচালনা পর্ষদ কারো কাছে দায়বদ্ধ ছিল না।

পরিচালনা পর্ষদ যখনই ইভ্যালির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে কিছু জানতে চেয়েছে, তখন তাদের জবাব ছিল, 'রাসেল স্যার সব জানেন। আমরা কিছুই জানি না।'

গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) রাসেল ও শামীমাকে গ্রেপ্তার করে। তখন থেকে রাসেল কারাগারে আছেন।

৮ সেপ্টেম্বর বোর্ডের কাছে হস্তান্তর করা অডিট রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইভ্যালি সম্পর্কিত ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড চাওয়া হলে রাসেল বলেছিলেন, এসব তথ্য লেখা একটি ডায়েরি তিনি সালাউদ্দিন নামে একজনের কাছে হস্তান্তর করেছিলেন। সালাউদ্দিন উইনস কোর্টের জমির মালিক, যেখানে ইভ্যালির অফিস রয়েছে।

কিন্তু সালাউদ্দিনের কাছে এ ধরনের কোনো ডায়েরি ছিল না।

হাইকোর্ট নিযুক্ত ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুব কবির মিলন নিরাপত্তাকর্মীদের সহায়তায় অফিসের একটি ড্রয়ার খুলে কিছু অব্যবহৃত চেকবই পান। তবে, কোনো ডায়েরি খুঁজে পাননি।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, এটি বিশ্বাসযোগ্য নয় যে কোম্পানির আইটি সফটওয়্যার ও সিস্টেমের ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড কেবলমাত্র সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছেই আছে এবং তাকে ছাড়া সিস্টেমে অ্যাক্সেস সম্ভব নয়।

গুরুত্বপূর্ণ বই ও নথির অভাবে অডিটকারীরা ব্যাংক স্টেটমেন্টের ওপর ভিত্তি করে অডিটের একটি বিকল্প পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন।

সেই পদ্ধতির ক্ষেত্রেও বন্ধুর পথ তৈরি করা হয়।

অডিটকারীরা দেখেছেন, ইভ্যালি খুব নিম্নমানের, অবিশ্বস্ত, অসংগঠিত, অসম্পূর্ণ বই ও রেকর্ডের মাধ্যমে ৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি লেনদেন করেছে।

যেসব গ্রাহক ইভ্যালিকে আগাম অর্থ দিয়েছে, তাদের তালিকা বা পণ্য সরবরাহকারীদের তালিকাও পাওয়া যায়নি।

অডিটকারীদের ইনভেন্টরি রিপোর্ট, ইনভেন্টরি ভেরিফিকেশন রিপোর্ট, অপ্রচলিত পণ্যের তালিকা, ডেলিভারি ও অর্ডার ক্লোজিং রিপোর্ট এবং ভাউচার রিপোর্টসহ অন্যান্য নথি সরবরাহ করা হয়নি।

ফলে, গ্রাহক ও পণ্য সরবরাহকারীদের যে পরিমাণ পাওনা ছিল তা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে জমা টাকা ছাড়া আর্থিক ব্যাপারে কোনো কাজ করা যায়নি বলে অডিট রিপোর্টে বলা হয়েছে।

ইভ্যালিতে আসা অর্থের বেশিরভাগই বিকাশ, নগদ ও রকেটের মাধ্যমে এসেছে। গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রোভাইডারদের কাছে ইভ্যালির অ্যাকাউন্টে ৪ হাজার ৮৬৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা জমা হয়েছে।

কোনো বিক্রয় চালান, অর্ডার, রশিদ, ভাউচার বা অন্যান্য নথি পাওয়া যায়নি, যার মাধ্যমে এই অর্থ কোন খাত থেকে এসেছে তা হিসাব করা সম্ভব।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই আমানতগুলোর উত্স ও উদ্দেশ্য অস্পষ্ট।

এর মধ্যে ৪ হাজার ৭০২ কোটি ৫০ লাখ টাকা ইভ্যালির ১৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়েছে, যার মধ্যে ৩৭ কোটি ১০ লাখ টাকা পাওয়া যায়নি।

অডিটকারীদেরকে ১১টি অ্যাকাউন্টের ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেওয়া হয়েছিল, যেখানে ৬ হাজার ৫২ কোটি ৬০ লাখ টাকা আমানত ছিল।

কিন্তু নথির অভাবে বেশিরভাগ অর্থের উত্স নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।

এর মধ্যে ৩৮ শতাংশ (২ হাজার ৩০৭ কোটি ৮ লাখ টাকা) উত্তোলন করা হয়েছে কিন্তু কোনো নথি খুঁজে না পাওয়ায় এই অর্থ প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন খরচের জন্য উত্তোলন করা হয়েছিল কি না তা নিশ্চিত হতে পারেনি অডিটকারীরা।

পরিচালনা পর্ষদ তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, এটা স্পষ্ট যে ব্যবসা পরিচালনার উদ্দেশ্য অসৎ ছিল।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠান ও মালিকরা গ্রাহকদের সরলতার সুযোগ নিয়েছে এবং প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন।

ইভ্যালি কোনো ঋণ নেয়নি। শুধু গ্রাহকের কাছ থেকে অর্ডারের আগাম অর্থ নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি তার কর্মীদের ভালো অর্থ প্রদান করেছে, ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে তারকাদের নিয়োগ দিয়েছে, ক্রিকেট টুর্নামেন্টে স্পনসর করেছে এবং প্রচুর বিজ্ঞাপন দিয়েছে।

রিপোর্টে আরও বলা হয়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী গ্রাহক ও পণ্য সরবরাহকারীদের অর্থ ব্যয় করেছে। ইভ্যালির ব্যবসায়িক লেনদেন বিবেচনা করার সময় এটি প্রকাশ করে যে কোম্পানির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল যেকোনো কৌশলে গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নেওয়া। অর্থাৎ, গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করা।

পরিচালনা পর্ষদ ইভ্যালির ব্যবসায়িক মডেলকে একটি পঞ্জি স্কিম বলে অভিহিত করেছে।

তাদের রিপোর্টে বলেছে, ইভ্যালির স্পনসররা প্রথম থেকেই জানতো যে ব্যবসাটি যখন বন্ধ হয়ে যাবে, ততদিনে স্পনসররা তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করে নিতে পারবে।

রাসেল ও তার স্ত্রী বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন। একটি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম চালানোর জন্য যে অভিজ্ঞতা দরকার, তা তাদের ছিল না।

ব্যবসা পরিচালনার বিষয় সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা ছাড়াই তারা ব্যবসা শুরু করে বলে মন্তব্য করেছে পরিচালনা পর্ষদ।

অডিট রিপোর্টে বলা হয়েছে, আমরা এই উপসংহারে আসতেই পারি যে, স্পনসর, শেয়ারহোল্ডার বা কোনো সম্ভাব্য বিনিয়োগকারী পর্যাপ্ত প্রয়োজনীয় নগদ অর্থ বিনিয়োগ না করা পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠান পুনরুজ্জীবিত করার সুযোগ দেখি না।

বিডিজবস ডটকম ও আজকেরডিলের সিইও এ কে এম ফাহিম মাশরুরের মতে, এটা অসম্ভব।

তিনি বলেন, 'একজন বিনিয়োগকারী এমন একটি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করতে চাইবেন না যার কোনো সঠিক ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্ট পর্যন্ত নেই।'

Comments

The Daily Star  | English

Former planning minister MA Mannan arrested in Sunamganj

Police arrested former Planning Minister MA Mannan from his home in Sunamganj's Shatiganj upazila yesterday evening

3h ago