ডলারের প্রাধান্য কমাতে ব্রিকস মুদ্রা আসছে?

ব্রিকস মুদ্রা
(বাম থেকে) দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ব্রিকস সম্মেলনে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা দিলভা, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেরগেই লাভরভ। ছবি: রয়টার্স

বিশ্ববাণিজ্যে প্রায় ৮০ বছর ধরে অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই চলছে মার্কিন ডলারের আধিপত্য। কিন্তু, এই আধিপত্য আর কতদিন চলবে?

গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি পরাশক্তি রাশিয়া প্রতিবেশী ইউক্রেনে 'বিশেষ সামরিক অভিযান' চালানোর পর পশ্চিমের দেশগুলো মস্কোর ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় 'ডলারের আধিপত্য' কমানোর প্রসঙ্গটি বেশ জোরালোভাবে সামনে আসে।

গত মঙ্গলবার দক্ষিণ আফ্রিকায় ৫ জাতির ব্রিকস সম্মেলনে জোটের অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য দেশ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার ভিডিও-বক্তব্যে ডলারের আধিপত্য ঠেকানোর কথা বলেছেন।

গত বৃহস্পতিবার সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রিকস সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন, ডলারবিরোধী যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তা 'ঠেকিয়ে রাখা যাবে না'।

এই প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে 'গতিশীল হচ্ছে' বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের ব্যবহার ৮০ শতাংশের বেশি উল্লেখ করে প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়, চলতি বছরের শুরুতে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা যখন প্রশ্ন তুলেছিলেন, কেন সব দেশকে ডলারে বাণিজ্য করতে হবে, তখন এক শীর্ষ রুশ কর্মকর্তা জানান, ব্রিকস নিজেদের মুদ্রার কথা ভাবছে।

জোটের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ২০০৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকের পাশাপাশি ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এই ৪ দেশের নামের প্রথম বর্ণ নিয়ে 'ব্রিক' গড়ার ঘোষণা দেন। পরে, ২০০৯ সালে রাশিয়ায় এই জোটের প্রথম সম্মেলন হয়। এর পরের বছর দক্ষিণ আফ্রিকা যোগ দিলে এই জোটের নাম হয় 'ব্রিকস'।

প্রায় ১২ বছর ব্রিকস নিয়ে তেমন আলোচনা না হলেও এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এটি আবির্ভূত হয়েছে বেশ জোরেসোরে।

বিশ্বের ৫ উন্নয়নশীল ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে বন্ধুত্ব, সংহতি ও অভিন্ন স্বার্থকে তুলে ধরতে এই জোটের জন্ম। বর্তমানে, এই জোটে আছে বৈশ্বিক জনসংখ্যার ৩০ শতাংশের বেশি মানুষ। ভৌগলিক আয়তনে এটি বিশ্বের ২৩ শতাংশ, বৈশ্বিক জিডিপির ২৩ শতাংশ ও বিশ্ববাণিজ্যের ১৮ শতাংশ।

গত বৃহস্পতিবার আর্জেন্টিনা, মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতকে এই জোটের নতুন সদস্য হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। আগামী ১ জানুয়ারি এই দেশগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে সদস্যপদ পেলে নিঃসন্দেহে সবদিক থেকেই জোটের পরিধি বাড়বে।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়, বর্তমানে ৫ সদস্যের এই জোটের মোট জিডিপি উন্নত দেশগুলোর জোট জি৭-র তুলনায় বেশি।

একই দিনে ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে বলা হয়, ব্রিকসের পরিধি বাড়লে তা দিন শেষে রাশিয়া ও চীনের জন্যেই সুবিধা। কেননা, এসব দেশে চীনের বাণিজ্য বাড়বে। অন্যদিকে, ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর দায়ে আন্তর্জাতিকভাবে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া রাশিয়া খুঁজে পাবে নতুন বন্ধু।

তবে গণমাধ্যমটি মনে করে, চীনের সঙ্গে ক্রমবিকাশমান বাণিজ্য বজায় থাকায় নতুন সদস্য রাষ্ট্রগুলো তাৎক্ষণিকভাবে জোটের সুবিধা না পেলেও জোটের 'নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক' থেকে পরবর্তীতে কোনো সুবিধা আসতে পারে। বর্তমানে ব্যাংকটির পরিধি ছোট হলেও ইন্টার-আমেরিকা ডায়ালগের এশিয়া ও লাতিন আমেরিকা কর্মসূচির পরিচালক মার্গারেট মেয়ার মনে করেন, এটাকে 'গুরুত্বহীন' ভাবা যাবে না।

ব্রিকস মুদ্রা কত দূর?

আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, পৃথক ব্রিকস মুদ্রা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের সিনিয়র ভিজিটিং ফেলো শিরলি জি ইউ সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, 'ব্রিকস মুদ্রা আনতে গেলে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা জরুরি। আবার সেসব প্রতিষ্ঠানের মান বজায় রাখার বিষয়টিও মনে রাখতে হবে। এগুলো করাটা বেশ কঠিন। তবে তা অসম্ভব নয়।'

রাশিয়া ও ইউরেশিয়ার অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা ম্যাক্রো-অ্যাডভাইসরির বিনিয়োগ বিশ্লেষক ক্রিস ওয়েফার সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, 'অনেক সদস্য দেশের সরকারে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা মনে করেন যে ব্রিকস মুদ্রার কোনো সম্ভাবনা নেই। এমনকি, সুদূর ভবিষ্যতেও।'

তার মতে, ডলারের বিকল্প হিসেবে ব্রিকস মুদ্রার ভাবনা যেন 'অলীক কল্পনা'। তিনি একে 'অবাস্তব' বলেও মন্তব্য করেন। এই বিষয়ে জোটের ৫ প্রধান দেশের মধ্যেই মতবিরোধ আছে বলেও জানান তিনি।

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব স্কলারশিপের অধ্যাপক ড্যানি ব্র্যাডলো মনে করেন, যদি ব্রিকস একক মুদ্রা চালু করে, তাহলে সেখানে জোটের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশটিই প্রাধান্য পাবে। সেই দেশটি হচ্ছে চীন।

তার প্রশ্ন, ছোট দেশগুলো কি তাদের অর্থনীতি বা অর্থনৈতিক নীতিমালা চীনের হাতে সঁপে দেবে?

ব্র্যাডলো বলেন, 'এটি অনেক ঝুঁকি তৈরি করবে। দেশগুলোর স্বাধীনতা সীমিত করে দেবে। যা কারো কাছেই হয়তো গ্রহণযোগ্য হবে না।'

দক্ষিণ আফ্রিকার ব্রিকস রাষ্ট্রদূত অনিল শুকলাল আল জাজিরাকে জানান, আসলে ডলারকে সরিয়ে দেওয়া নয়, সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হচ্ছে বিশ্ববাসীকে নতুন কিছু দেওয়া।

তিনি বলেন, 'ব্রিকস পশ্চিমবিরোধী কোনো জোট নয়। আমরা পশ্চিমের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করছি না। আমরা ডলারের বিরুদ্ধেও নই। তবে ডলার বিশ্বব্যাপী যে আধিপত্য বজায় রেখেছে আমরা এর বিরুদ্ধে।'

গত বৃহস্পতিবার দক্ষিণ আফ্রিকার অর্থমন্ত্রী এনোক গডনংওয়ানার বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ জানায়, ব্রিকস মুদ্রার বিষয়টি কখনোই আলোচনায় ছিল না।

মন্ত্রী গডনংওয়ানা সংবাদমাধ্যমটিকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, 'ব্রিকস মুদ্রার বিষয়টি নিয়ে কেউ কখনই আলোচনা করেননি। এমনকি, অনানুষ্ঠানিকভাবেও তা আলোচনায় আসেনি।'

তিনি আরও বলেন, 'একটি একক মুদ্রার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রয়োজন। নিজ নিজ দেশের মুদ্রানীতি বিসর্জন দেওয়াও দরকার। আমার মনে হয় না এখন কোনো দেশ এসব করতে প্রস্তুত।'

এমন পরিস্থিতিতে এ কথা বলা যেতে পারে যে, ডলারের বিকল্প হিসেবে যারা ব্রিকস মুদ্রা নিয়ে আশাবাদী, তাদের হয়তো আরও অনেক সময় অপেক্ষা করতে হবে। ব্রিকস মুদ্রা আসলে কতদূর, তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।

Comments

The Daily Star  | English
Reforms vs election

Reforms vs election: A distracting debate

Those who place the election above reforms undervalue the vital need for the latter.

8h ago